ফ্ল্যাট - বাড়ি - প্রমোটারী - ইতিকথা

সোমবার, জুন ২৯, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

কারণে অকারণে আমি মাঝে মধ্যে পৌঁছে যাই পুরানো কলকাতার অলিতে গলিতে, কোনও এক অজানা টানে, আর চোখ ভরে দেখি পুরানো দিনের ভাস্কর্য, মিশ্রিত শিল্প কলার নিদর্শনে তৈরি এই শহরের বাড়িগুলি, আর ইতিহাসের গন্ধ শুঁকে চলতে থাকি। কিছুদিন আগেই দেখলাম পিকু সিনেমাটা, যদিও আমি কলকাতায় বড় হইনি, তবুও বাংলা বইয়ে পড়া গল্পগুলির থেকে তৈরি হওয়া এক নস্টালজিয়া আমায় ঘিরে ধরল। সতিই কলকাতার ইতিহাস আর তার এই প্রাচীন নিদর্শন বাড়িগুলি কি আর বেঁচে থাকবে ?সেই লম্বা ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে নিচ দিয়ে চলে যাওয়া ট্রামের ঘন্টা শোনার দিনগুলি যে আর মাত্র কিছুদিন সে কথা হলফনামা দিয়ে বলা যায়। 

বিগত পঁচিশ বত্সর যাবত রাজনৈতিক দলগুলির আশীর্বাদে, মস্তানদের পেশিবলে, ও বিদেশী পুঁজির শক্তিতে বলীয়ান হয়ে প্রমোটারী ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে, এবং বর্তমানে শিল্পে মন্দা চলা পশ্চিম বাংলায় মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর পছন্দের শিল্প তেলে ভাজার দোকানের চেয়েও তীব্র গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে এই শিল্পের।  তার সাথে যুক্ত হয়েছে পাড়ার কাউন্সিলর থেকে এলাকার বিধায়ক থেকে পুলিশ, আমলা, মন্ত্রী, সান্ত্রী সবাই। আর এর ফলেই আগ্রাসিত হয়েছে কলকাতা শহরের বেঁচে থাকা ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি।  একের পর এক এলাকায় পুরানো বাড়িগুলির শরিকদের অন্তর্দ্বন্ধ কে কাজে লাগিয়ে বাড়িগুলি কোলাবরেশনের নামে হাতিয়ে সেগুলি ভেঙ্গে নির্মিত হচ্ছে বিশাল বিশাল ফ্ল্যাট - এপার্টমেন্ট এবং বর্গ ফিট এর হিসাবে খেলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামিয়ে নিছে প্রমোটার চক্র।  আর হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস। 

যখন ছোট ছিলাম তখন দেখতাম চারদিকে খেলার মাঠ, সেই মাঠ পেরিয়ে পাঁচিলের ভিত্তি, পরে একটু বড় হতে হতে দেখলাম যে সেই মাঠ ঢেকে গেছে একের পর এক উঁচু বিল্ডিং এ আর পুকুর বুঝিয়ে তৈরি হয়েছে শপিং কমপ্লেক্স থেকে ফ্ল্যাট বাড়ি। আরও বড় হয়ে মাঠ, ঘাট, সবুজ আর জল সব হারিয়ে যেতে দেখলাম চোখের সামনে, আর তার পর আজ দেখছি পুরানো বাড়ি ভেঙ্গে নতুন বাড়ি গড়ার প্রক্রিয়া। এতদিন জমি থাকায় প্রমোটারদের নজর বাড়িগুলির উপর পরেনি, কিন্তু জমির সংখ্যা কমতেই দিল্লি ও মুম্বাই এর কায়দায় এই শহরের প্রমোটার গোষ্ঠীগুলির নজর পরেছে শহরের বাড়িগুলির উপর, বিশেষ করে পুরানো বাড়িগুলির উপর।  সরকার চিরকালই প্রমোটার সম্পর্কে উদাসীন থাকে, কারণ চাঁদা থেকে পেশী শক্তির যোগান তো প্রমোটার গোষ্ঠী ছাড়া একক ভাবে খুব কম গোষ্ঠিই তাড়াতাড়ি যোগান দিতে পারে, তার সাথে আবার পাড়ার ক্লাব - শাসক দলের নেতা - রিয়েল এস্টেট দালাল -প্রমোটার চক্রটি একটি সফল মিলিজুলি সরকার চালিয়ে এসেছে, যা কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যস্তরে গঠিত যে কোনও সরকারের চেয়ে বেশি টেকসই।  

বর্তমানে ফ্ল্যাট বাড়ি গড়ে ওঠার পিছনে কাজ করছে কয়েকটি কারণ, যেমন শহরে ক্রমাগত জনসংখ্যার চাপ, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি ও তার স্বাধীন ভাবে থাকার ইচ্ছা, জমির অপ্রতুলতা ও বেড়ে চলা দাম, ইত্যাদী।  জমির দাম কে কেন্দ্র করে বাড়ি বা ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ করার প্রবণতা মার্কিন মুলুক থেকে এই দেশে আমদানি হয়েছে, এবং এর পিছনে যে অর্থনৈতিক সুত্র কাজ করে তা হলো যে ভবিষ্যতে যখন রিয়েল এস্টেটের দাম আরও বাড়বে তখন বেশি টাকায় ফ্ল্যাট বা বাড়ি বেচে দেওয়া।  এই কারণেই ধনিক ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যে প্রবল হয়েছে রিয়েল এস্টেট শিল্পে বিনিয়োগ। তার দুটি প্রধান ধরন হচ্ছে হয় ফ্ল্যাট কিনে ফেলে রাখা বা ভাড়ায় তুলে দেওয়া ভবিষ্যতে দাম বাড়া অবধি, নয়তো, রিয়েল এস্টেট কোম্পানির শেয়ার বা প্রজেক্টে এক লপ্তে মোটা টাকা বিনিয়োগ করা।  বলাই বাহুল্য যে এই সমস্ত স্কিমে গরিব - নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ বিনিয়োগ করতে অপারগ, এবং শহর জুড়ে চলতে থাকা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় গরিব মানুষের মাথার উপর ছাদের বন্দোবস্ত কোনওদিন হবে না।  বরং প্রতিদিন বেশি বেশি করে ধনিক ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষ এই শিল্পে বিনিয়োগ করতে থাকবে বেশি লাভের আশায়।  ভারতবর্ষের নতুন গড়ে ওঠা বড় বড় রিয়েল এস্টেট প্রজেক্টগুলির উপর করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে প্রায় ৪০ শতাংশের উপর বিক্রিত আবাসে মানুষ বাস করে না, বরং ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে এই বাড়িগুলি কেনা হয়েছে ভবিষ্যতে দাম বাড়ার আশায়।  এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে আর একটা বৃহত সাব প্রাইম ক্রাইসিস এর মতন অবস্থা। কারণ যে হিসেবে রিয়েল এস্টেট শিল্পে বৃদ্ধি হচ্ছে এবং একের পর এক জায়গায় সারি বেঁধে গজিয়ে উঠছে সুউচ্চ অট্টালিকাগুলি, এবং সেই তুলনায় যখন ব্যাপক জনগণের ক্রয় ক্ষমতা দিনে দিনে হ্রাস হচ্ছে, তখন অচিরেই একদিন আসবে যখন প্রয়োজনের তুলনায় যোগান যাবে বেড়ে, ফলে দাম যাবে কমে, এবং এর ফলে বিনিয়োগকারীদের আশায় জল পড়বে অঝরে। আর যেহেতু বিনিয়োগকারীদের সিংহ ভাগই ঘরের টাকা না লাগিয়ে ব্যাঙ্কের ঋণ লাগিয়েছে এই সম্পত্তি কিনতে তাই ব্যাঙ্কের টাকা ডুববে জলে।  যদিও বা ব্যাঙ্ক সমস্ত সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে ফেলে সেখানে ব্যাঙ্কের দায় বেড়ে যাবে কারণ সেই সমস্ত সম্পত্তির কর দিয়ে নতুন ক্রেতা খুঁজে সেই সম্পত্তি বিক্রি করেও লাভ তো দূরস্থান, মূল ঋণের টাকা আদায় করতে নাকানি চোবানি খেতে হবে ব্যাঙ্ককে।  

ব্যাঙ্কগুলি, বিশেষত সরকারী ব্যাঙ্কগুলি যদি এই সংকটে পড়ে তাহলে তাদের ঋণের বোঝা লাঘব করে তাদের ঘরে টাকার যোগান দেওয়ার দায় হবে সরকারের এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের করের টাকা ঢুকবে উচ্চ বিত্ত ও ধনিক শ্রেনীর ফাটকা খেলার মাশুল হিসাবে।  তখন এই প্রমোটার চক্রকে দেখা যাবে না কোনও ভাবে দেশের স্বার্থে দাঁড়াতে। কারণ টাকা তুলে তারা তখন নিজের ঘর ঠিক গুছিয়ে নেবে, শুধু অর্থনৈতিক মন্দায় ভুগে পিষে যাবে সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণ। অর্থনীতির এই সাধারণ সুত্র ধরেই আমেরিকায় ২০০৮ সালে নেমে এসেছিল ভয়াবহ মন্দা যার জেরে বিশ্ব অর্থনীতিকে ভুগতে হয় দীর্ঘ দিন, এমনকি আজও বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার থেকে মুক্ত হয়ে ওঠেনি।

পাঠক প্রশ্ন করবেন যে এত সাধারণ যদি সুত্র হয় তাহলে কি তাঁবর তাঁবর ব্যাঙ্ক, পুঁজিপতিরা কি এই সম্পর্কে অবহিত নয় ? নিশ্চয় তারা অবহিত, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি - লাভের লোভের। গত এক শতাব্দী ধরে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ রূপ - একচেটিয়া পুঁজি বা লগ্নি পুঁজি পৃথিবীর উপর রাজত্ব করছে।  তার মূলমন্ত্র শুধু লাভ করা নয় বরং চরম লাভ করা।  এই চরম লাভের লোভেই সে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছুটে বেড়ায় এবং যেখানে লাভের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা দেখে সেখানেই লগ্নি করে বসে। তাই ভারতের রিয়েল এস্টেট শিল্পেও এসেছে বিদেশী লগ্নি পুঁজির বিনিয়োগ, এর ফলে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে ডিএলএফ থেকে শুরু করে মাঝারি ছোট অনেক সংস্থার, এবং তীব্র গতিতে বেড়েছে জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে কোলাবরেশনের খেলা।  আর এই লাভের গুড়ের লোভেই পরিচালিত হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি এবং তাই মন্দা এখানে নিত্য নৈমিত্ত একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।                                                       

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে