ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি ও ভারতের অব্যবস্থা

সোমবার, জুলাই ২৭, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

ইয়াকুব মেমন কে ফাঁসি দিতে উদগ্রীব হয়েছে ফডনবীসের নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্র সরকার এবং বিজেপি আরএসএস  সমর্থকগণ সমগ্র দেশ জুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও মুসলমান ঘৃণার ঢেউ তোলার জন্যে সচেষ্ট হয়েছে এই ফাঁসির সাজা কে ঘিরে। আমাদের সামনে সমস্ত কর্পোরেট প্রচার মাধ্যমগুলি আজ ইয়াকুব মেমন কে এক খুনি, সন্ত্রাসী, হত্যাকারী, ইত্যাদি বলে চিত্রিত করে চলেছে এবং আমরাও মুড়ি চানাচুর বা পাস্তা খেতে খেতে সেই সব খবরের নির্যাস বেমালুম গিলে ফেলছি। মনে হচ্ছে এক ইয়াকুব কে ফাঁসি দিলেই সন্ত্রাসবাদীরা ভিজে বেড়ালের মতন কাঁপতে কাঁপতে এসে ভারতের প্রতিটি থানায় আত্মসমর্পণ করবে, আইএসআই আর পাকিস্তান কোনো ঘুটি খুঁজে পাবে না এই দেশে নাশকতা চালাবার জন্যে। সব সমস্যার সমাধান একটি ফাঁসি, যেমন একদিন কলকাতায় ধনঞ্জয়কে ধরে লটকানো হয়েছিল ফাঁসিকাঠে, তেমনি এবার ইয়াকুবের ফাঁসি হবে মুখরোচক চানাচুর। এই ভাবেই একটি জাতির মানসিকতার ধরন গড়তে ও যে কোনো ঘটনার সমর্থন বা বিরোধিতা সৃষ্টি করতে সিদ্ধহস্ত হয়েছে এই কর্পোরেট মিডিয়াগুলি। তাই এরা আজ তামাম দুনিয়ার পুঁজিপতি ও রাজনৈতিক নেতাদের খুবই আদুরে রক্ষিতা। 
  
ইয়াকুব মেমনের কোথায় ফিরে আসলে দেখব যে আসলে ইয়াকুব কে এবং কেন তাঁর এই পরিনতি। ইয়াকুব কোনো বিপ্লবী, বিদ্রোহী বা জন নায়ক নয়, সে হল মুম্বাইয়ের ত্রাস দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গী টাইগার মেমনের ভাই। যে টাইগার মেমন দাউদের সাথে মাইল ১৯৯৩ সালে মুম্বাইয়ের জায়গায় জায়গায় ঘটিয়েছিল ভয়াবহ বিস্ফোরণ এবং প্রথমবার ভারতবাসীদের পরিচিত করিয়েছিল আরডিএক্স, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল একে ৪৭ ইত্যাদী নামের সাথে। এই বিস্ফোরণের পরিপ্রেক্ষিতে ছিল বোম্বাই, অধুনা মুম্বাই শহরের দাঙ্গা, যা শুরু হয়েছিল ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২ এ বিজেপি - আরএসএস কতৃক অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়ার পর।  এই দাঙ্গায় শিবসেনা ও বিজেপির যৌথ আক্রমনে বহু মুসলমান মানুষের প্রাণ যায়, অনেকের বাড়ি ঘর জ্বলে যায় এবং বহু মানুষ আহত হন।  এই দাঙ্গার সুযোগেই ঘোলা জলে মাছ ধরতে দাউদ ও টাইগার কে হাত করে মার্কিন সাহায্যপ্রাপ্ত পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আই এস আই এবং এদের মাধ্যমেই ঘটায় একের পর এক বিস্ফোরণ। এই ঘটনার আগেই টাইগার সপরিবারে ভারত ছেড়ে প্রথমে দুবাই ও পরে পাকিস্তানে যায় ভারতীয় আইন থেকে বাঁচতে, দাউদ এবং টাইগার পায় আইএসআই এর নিরাপদ আশ্রয়, এবং এখানেই ইয়াকুবের সাথে টাইগারের দ্বন্ধ শুরু হয়।  ইয়াকুব ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা 'র' কে জানায় যে সে এবং তার স্ত্রী টিভিতে বিস্ফোরণের খবর শোনে এবং জানতে পারে যে তাদেরও পুলিশ হন্য হয়ে খুঁজছে। এই ঘটনা জেনে পেশায় চার্টার্ড একাউন্টেন্ট মেমন ভারতে ফেরার পরিকল্পনা করে এবং সেই মত সে আইএসআই এর চোখে ফাঁকি দিতে নেপাল পাড়ি দেয়, এবং ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট এ ইচ্ছে করেই নিজের ব্যাগ থেকে এক গাদা পাসপোর্ট ফেলে দেয়।  ওখানে তাঁকে গ্রেফতার করলে সে পুলিশ কে জানায় যে সে ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায়, পরে তাকে সেখানে 'র' এর এজেন্টরা জেরা করে এবং ভারতে নিয়ে আসে।  
কিন্তু ভারতে আসতেই দিল্লি পুলিশ দাবি করে যে ইয়াকুব মেমন কে তারা নয়া দিল্লি রেল স্টেশন থেকে গ্রেফতার করেছে। সেদিন থেকে শুরু হলো মেমনের উপর টাডা আইনে বিচার, অত্যাচার, স্বীকারোক্তি আদায় এবং শেষমেষ ফাঁসির সাজা। কিন্তু কেন হটাত করে ইয়াকুবের উপর এই শাস্তির খাঁড়া নামল ?

এর একটাই কারণ ছিল, ভারতের সরকার ভালো ভাবেই জানত যে দাউদ বা টাইগার তাদের খপ্পরে কোনও দিনই পড়বে না, মুম্বাই বিস্ফোরণের কেস সলভ করাও দায় হবে মুম্বাই পুলিশের, এবং এই সময়ে ইয়াকুবের মতন বলির পাঁঠা পেলে কজনে ছেড়ে দেবে ? 

হয়তো একটু বিচক্ষণতার পরিচয় দিলে ভারত সরকার এবং তার কূটনৈতিক কর্মীদের দ্বারা ইয়াকুবের সাহায্যে সারা দুনিয়ায় পাকিস্তানের সরকার ও তার গুপ্তচর সংস্থার কার্যকলাপ বহু আগেই ফাঁস করে দেওয়া সম্ভব হত, জানানো সম্ভব হতো দুনিয়ার আঙ্গিনায় দাউদ ও টাইগারকে সরকারী ভাবে পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। বিশেষত যখন ইয়াকুব সেই কারণেই ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।  সে তো পাকিস্তানের নিরাপদ আশ্রয়ে চিরকালের জন্যে বউ বাচ্চা নিয়ে থাকতে পারত, কিন্তু তার দেশের কথা ভেবে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র ফাঁস করার চেষ্টাই দায় হয়ে দাঁড়ালো। এই গন্ডমূর্খামির ফলে ভারত আজও দাউদ ইব্রাহিম বা টাইগার মেমনের কলার ছুঁতে পারল না, তারা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে করাচিতে, তাদের কোনো ভয় নাই কারণ তারা জানে ভারত সরকার তাদের ধরতে পারবে না এবং ইয়াকুবের মতন কিছু বলির পাঁঠাকে যূপকাষ্ঠে চড়িয়ে হাততালি দিয়ে বাহবা কুড়োবে।                 
ভারতীয় সরকার ও তার রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে কোনো সন্ত্রাসবাদী ঘটনার জন্যে একটাই বাঁচার রাস্তা আছে, কিছু মুসলমানকে গ্রেফতার করো, তাদের চার্জশিট দাও, কেস চালাও এবং যে কোনও প্রকারে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে প্রতিপন্ন করো।  এভাবেই একদিন পুলিশের হাতে ধরা পরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর গিলানি কে জেল খাটতে হয়, নিরীহ আফজাল গুরুকে নির্মম ভাবে মার খেয়ে স্বীকারোক্তি দিতে হয় যে সে সন্ত্রাসবাদী এবং শেষে ফাঁসিতে চাপতে হয়।  কারণ এই দেশের আইন মানে মুসলমানকে সন্ত্রাসবাদী বানিয়ে জেলে চালান করে দেওয়া এবং তদন্তের ইতি টানা। তাই শ্রীকৃষ্ণ কমিশনে দোষী সাব্যস্ত হয়েও বোম্বাইয়ের গুন্ডা দাঙ্গাবাজ বাল ঠাকরে বহুদিন বুকফুলিয়ে শাসন করে আইন কে কাঁচকলা দেখিয়ে পটল তোলে, গুজরাট দাঙ্গায় দোষী সাব্যস্ত বিজেপি কর্মীদের সাজা মকুব হতে থাকে আদালতে, তিস্তা শেত্লাবাদের মতন দাঙ্গাপীড়িতদের সাহায্যকারীদের পড়তে হয় অমিত শাহ - রাজনাথ সিংহের দ্বারা পরিচালিত সিবিআই এর তদন্তের রোষানলে।  
        
বিজেপি - আর এস এস ক্ষমতায় আসার পর এই ঘটনা আরও বাড়বে। বর্তমানে ইয়াকুবের পক্ষে মানুষের আওয়াজ শুনতে চাইছে না বিজেপি সরকার। তাদের দাবি যে সকল মানুষ ফাঁসির সাজা মকুবের ডাক দিচ্ছে তারা সবাই পাকিস্তান যাক। নায়ক সলমান খান যখন টাইগার এর ফাঁসির দাবি তোলে তখনি তার বাড়ির সামনে মিছিল করে দাঙ্গাবাজ শিবসেনা ও আরএসএস।  কিন্তু ওদেরই পুলিশ এবং জাতীয় তদন্ত সংস্থা (নিয়া) অন্যদিকে মালেগাঁও বোমা বিস্ফোরণের দায়ে অভিযুক্ত আরএসএস সমর্থিত সন্ত্রাসবাদী সংস্থা 'অভিনব ভারত' ও তার সদস্য বিজেপির বিদ্যার্থী পরিষদের নেত্রী সাধ্বী প্রজ্ঞা, আরএসএস প্রচারক অসীমানন্দ, কর্নেল পুরোহিত ইত্যাদীদের বিরুদ্ধে নরম হয়ে কেস হেরে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে সরকারী কৌসুলি কে। মা' কে দেখার বাহানায় সরকারী খরচায় আরএসএস এর সন্ত্রাসবাদী সাধু অসীমানন্দ পশ্চিমবাংলার বাঁকুড়া জেলায় সরকারী অতিথিশালায় চর্ব-চোষ্য- লেহ্য-পেয় সেবন করে আয়েশ করতে পারে। সর্বোপরি দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ায় এবং প্রশাসনকে মানুষ হত্যায় ব্যবহার করার অপরাধে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারে।  তার কারণ এই দেশের শাসকশ্রেণী বড় বড় পুঁজিপতি ও জোতদার - জমিদারদের ভীষণ প্রয়োজন এক ব্রাহ্মন ফ্যাসিবাদী শাসনের, যাতে তারা ভারতবর্ষের মানুষের মনে সাম্প্রদায়িকতা, জাতি ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে শোষণ - লুণ্ঠনের প্রক্রিয়াকে জিইয়ে রাখতে পারে।

এই হিন্দু ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি করে এবং এর প্রচার ও প্রসারের কাজে আরএসএস এর সাথে যুক্ত হয়েছে কর্পোরেট মিডিয়া, যাদের লাগাতার প্রচার শেষমেষ মধ্যবিত্ত ও গরিব হিন্দু মানুষকে এটা বিশ্বাস করতে শেখাবে যে সমস্ত মুসলমান মানুষ ভারতবাসীর শত্রু, তারা সবাই পাকিস্তানের গুপ্তচর, এবং তারা ভারত ভেঙ্গে আর একটা পাকিস্তান বানাতে চায়।  এই তথ্যের নাই কোনো ভিত্তি, নাই কোনো সারবত্তা, শুধু আছে কথার মারপ্যাঁচ।  আর যত বেশি করে হিন্দু গরিব ও মধ্যবিত্ত কর্পোরেট মিডিয়ার প্রচার গিলবে তত বেশি করে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদটা স্পষ্ট করা যাবে।  যার দ্বারা মোদী ও তার মালিকদের সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও মেরুকরণের নীতি বাস্তব হবে। 

কিন্তু এই নীতির ফলে বেশি বেশি করে মুসলমান মানুষ এই কথাটা বিশ্বাস করতে শিখবে যে ভারতবর্ষে তার সমান অধিকার নাই, সে এই দেশে ব্রাত্য, তাকে সবাই ঘৃনা করে।  এর ফলে লাভ কুরবে ওয়াইসি মার্কা মোল্লাহতান্ত্রিক দালালরা, যারা মুসলমান খেপিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাতে থাকবে।  এই বিভাজন ও মেরুকরণের ফল কিন্তু হবে ভয়াবহ।                                 
        
সব কথার শেষে এটা উল্লেখ করা দরকার যে ২১ বছর জেল খাটার পর এখন ইয়াকুবের অপেক্ষা ফাঁসি কাঠে ঝোলার।  ভারতে আসার সময়ে ইয়াকুবকে টাইগার বলে যে 'তুমি ভারতে যাচ্ছ গান্ধী হয়ে, ওরা তোমায় ফাঁসি দেবে গডসে বানিয়ে'। আর এই দুনিয়াতে টাইগারদের কথাই যে সবসময় সঠিক হয়ে ওঠে সেটাই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার।                            

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে