মানুষ খেঁকো গরু ও ভারতের রাজনীতি

সোমবার, অক্টোবর ১৯, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

ছোটবেলায় ইস্কুলে গরুর উপর রচনা আমরা প্রায় সকলেই লিখেছি। পেন্সিলের ডগা চিবিয়ে খাতায় লিখতাম গরু একটি গৃহপালিত পশু, গরুর চারটি পা, দুইটি শিং, গরু ঘাস খায়, ইত্যাদী। ছোটবেলা থেকেই জানতাম গরু শান্তশিষ্ট স্বভাবের পশু, এর কোনো আক্রোশ নাই, এবং মূলত গরু তৃণভোজী প্রাণী।  কিন্তু আজ আমার চোখের সামনে সেই তৃণভোজী গরু ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে সাংঘাতিক এক মানুষ খেঁকো প্রাণী, অক্টোবরের শুরু থেকে আজ অবধি প্রায় তিনটি মানুষ কে গরু খেয়ে ফেলেছে, শুধু তাই নয় সারা দেশ জুড়ে মানুষ খেঁকো গরু এক আতঙ্কের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। 

মহাম্মদ আখলাক নামক উত্তর প্রদেশের দাদরি জেলার এক বাসিন্দা কে গরু মাতার সন্তানেরা দল বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করে প্রথমে। তাঁর দোষ ছিল যে তিনি নাকি গরু মাতার মাংস ভক্ষণ করেছিলেন, যাই হোক যদিও পরবর্তী কালে প্রমাণিত হয় যে তাঁর ফ্রিজে রাখা মাংস গরুর না বরং পাঁঠার, তবুও তাঁকে প্রাণ হারাতে হয়। উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর জেলার এক যুবক নোমান কে শিমলার কাছে গরু ছানারা পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে গরু পাচারের অভিযোগের ভিত্তিতে, তাও আবার পুলিশের চোখের সামনে। বিজেপি শাসিত রাজ্যের গরু ভক্ত পুলিশ বীর বিক্রমে নোমানের সাথীদের গ্রেফতার করে জেলে পোরে, যদিও হত্যাকারীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কারণ তারা বানর সেনার (ওই বজরং দল আর কি) সদস্য। এই খুনের রেশ মিটতে না মিটতেই ফের ১০ দিন ধরে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে হার মানেন কাশ্মীরি যুবক জাহিদ, যার ট্রাকে করে গরু পাচার হচ্ছে বলে গাড়িতে পেট্রল বোমা ছোড়ে জাতীয়তাবাদী নিরামিষাশী সন্ত্রাসবাদী ওরফে সংঘ সমর্থকরা।  

এই সকল হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে দেশজোড়া প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবাদে সামিল হলেও, মোদী জমানায় বিজেপি ও তার পিতৃদেব আরএসএস এর তাতে বয়েই গেল। বুক ফুলিয়ে আরএসএস মুখপত্র পাপী গো মাংস ভক্ষণকারীদের মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত করার বিধান দেয় তার অনুগত নন্দী ভৃঙ্গীদের। কুত্সিত চিত্কার করে পথে নামে গেরুয়া বসনধারী গো সন্তানেরা। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী আদেশ দেন যে গো মাংস ভক্ষণ ত্যাগ করলে তবেই মুসলমানরা ভারতে বাস করবে। যদিও তিনি উত্তর পূর্ব ভারত, কেরল ও গোয়া সহ বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে গো মাংস ভক্ষণকারী হিন্দু ও খ্রিস্টানরা কি করে ভারতে থাকার লাইসেন্স পাবেন তা নিয়ে মৌন ব্রত ধারণ করেন। এই সুযোগে উচ্চ বর্ণের হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হিমাচল প্রদেশের হাই কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে সমগ্র দেশে গরুর মাংস নিষিদ্ধ করে গরুর রক্ষনাবেক্ষণ হেতু গৌ শালা তৈরি করার আদেশ দেয়।  ঠিক যেমন জম্মু কাশ্মীরের আদালত হঠাত হিন্দু ধর্মের অনুভূতির সুরসুরি দিয়ে কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্রের আইন দ্বারা গরুর মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ করে। 

সারা দেশের মানুষকে হঠাত এই গরু চক্রে বেঁধে বিজেপির কি লাভ হচ্ছে ? প্রাথমিক ভাবে এটা স্পষ্ট যে সারা দেশের ৩১% ভোট পেয়ে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে গত বছর দেশে ক্ষমতা দখল করেছে। বিজেপি নিশ্চিত ভাবে জানে যে তাদের কোনো মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক নাই ফলে যত বেশি করে হিন্দুদের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের পাঁকে ফেলা যাবে তত বেশি করে তারা দেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার চালাতে পারবে। তাই আজ ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণ ভেদের সমর্থক আরএসএস হঠাত করে শোষিত দলিত ও আদিবাসী সমাজকে তাদের দিকে টানার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে একের পর এক প্রচার কার্য চালাচ্ছে। দলিত ও আদিবাসীদের একটা বড় অংশ কে টেনে আনতে পারলে বিজেপির হিন্দু ভোটের সমীকরণের রাজনীতির ষোলো আনায় আঠারো আনা আদায় হবে এবং কর্পোরেট পুঁজির কাছে আদিবাসী অধ্যুষিত পাহাড় - জঙ্গল - নদী জলের দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে। 

দ্বিতীয়ত: বিজেপির সরকারের সামগ্রিক ব্যর্থতা আজ দেশের আপামর জনগণের সামনে প্রকাশ্য হচ্ছে। নির্বাচনের পূর্বে মোদীর বড় বড় ভাষণের ফানুস  আজ মানুষের সামনে ফেটে পড়েছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের লাগাম ছাড়া মূল্য বৃদ্ধি, গণ বন্টন ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার প্রয়াস, সামাজিক প্রকল্পের খাতে ব্যাপক ব্যয় সংকোচ, খেটে খাওয়া মানুষের উপর শোষনের রোলার চালানো, বিদেশী পুঁজির কাছে ভারতবর্ষের সম্পদকে পাইকারী মূল্যে বেচে দেওয়া, ইত্যাদি যখন সরকারের উপর মানুষের আক্রোশ বাড়ছে, বিশেষ করে ২রা সেপ্টেম্বর দেশ জোড়া ধর্মঘটে ব্যাপক হারে শ্রমিক শ্রেনীর সামিল হওয়ায় কর্পোরেট পুঁজি ও তাদের রক্ষিতা বিজেপির শ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগার ঠিক তখন সরকারের কাছে হয় যুদ্ধ লাগানো না হয় দাঙ্গা লাগিয়ে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিজেদের শোষণ শাসনের নীতি প্রণয়ন করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নাই। 

এই উপরোক্ত কারণগুলির জন্যে আজ সারা দেশ জুড়ে গরুকে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার আবরণ হিসাবে ব্যবহার করছে বিজেপি ও তার পিতা আরএসএস। যত বেশি করে মানুষের উপর শোষণ ও অত্যাচারের বোঝা বাড়বে তত বেশি করে এদের এই প্রচেষ্টায় ঘি ঢালবে গেরুয়াধারীদের চাঁদা যোগানকারী বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলি, দেশী জোতদার -জমিদার ও মুত্সুদ্দি পুঁজিপতিরা। মুসলমান নিধন ধর্মের চেয়ে বেশি কর্মের তাড়না এই সত্যটি মানুষের কাছে অবশ্য বেশি দিন গোপন থাকবে না। কারণ গরুর আবরণ চিরকাল মানুষের দৃষ্টি থেকে আরএসএস এর কুকর্ম কে আড়াল করবে না। তৃণ ভোজী গরু যখন গণ আন্দোলনের ঠেলায় ক্ষিপ্ত হয়ে শিং বাগিয়ে আরএসএস - বিজেপি ও তাদের বানর সেনার পিছনে ছুটবে তখন কিন্তু গেরুয়া বসনধারী মেকি সন্ন্যাসী ও সাধুদের বাঁচাতে স্বর্গ থেকে কোনও দেবদূত বা অবতার আসবে না।  এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।   
                         

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে