দুর্গাপুজোর চাঁদা, পুজোর নামে মোচ্ছব, ক্লাব কাহিনী ও অন্যান্য

শুক্রবার, অক্টোবর ১৬, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

দূর্গা পুজো যাকে আমরা মূলত শারদ উত্সব হিসেবে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের প্রধান জাতীয় উত্সব হিসেবে জানি, তা আজ বানিজ্যকরণ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের এক অস্ত্র হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করেছে। মূলত হিন্দু সমাজের উচ্চ জাতির সামন্ত প্রভুদের এই উত্সব বিগত শতাব্দীর তিরিশের দশক অবধি মূলত জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালানে অনুষ্ঠিত হত, এবং চিত্তরঞ্জন দাস ও সুভাষ বোসের প্রচেষ্টায় মূলত একটি বারোয়ারি পুজো হিসেবে কলকাতার মধ্যবিত্তদের পাড়ার গলিতে প্রবেশ করে। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে বারোয়ারি দুর্গাপূজার হিরিক বাড়ে প্রথম যুক্ত ফ্রন্ট সরকারের আমল থেকে, মানে সেই ১৯৬৭ সাল থেকে যখন জ্যোতি বোস প্রথম গৃহ মন্ত্রী হয়ে পুলিশ দিয়ে শ্রমিক - কৃষক আন্দোলন দমন করা শুরু করে। ১৯৭৭ এ বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই বারোয়ারি পুজোর ব্যাপ্তি শহর ছাড়িয়ে মফত্সল ও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, সরকারী দান ধ্যানে ও সিপিএম এর লোকাল কমিটির নেতাদের বদনত্যায় ব্যাঙের ছাতার ন্যায় বহু ক্লাব ঘর গজিয়ে ওঠে এবং দূর্গা পুজোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। বলা বাহুল্য এই সকল ক্লাবের রাজনৈতিক সমীকরণের বদল হয় মমতাময়ী মা - মাটি - মানুষ সরকারের আমলে। পাড়ার কাউন্সিলর থেকে তৃণমূলী নেতারা পুজো কমিটির মাথায় বসে, এবং তথাকথিত বামপন্থীদের নাস্তিক সাজা ন্যাকামি বাদ দিয়ে এই দক্ষিণপন্থীদের নেতৃত্বে পুজো কমিটিগুলি হয়ে ওঠে অতি মাত্রায় আগ্রাসী ও পুজোর ব্যয় বেড়ে চলে হুহু করে সাথে চলে ক্লাবের দাদাদের মোচ্ছব। 

চাঁদা না তুললে দূর্গা পূজা বারোয়ারি ভাবে হয় না।  চাঁদা না দিলে দাদাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে সুরসুরি লাগে এবং তারা তখন বাড়ির দরজার সামনে ছিল চিত্কার জুড়ে দেন, কখনো দিদির দুষ্টু ভাইদের ন্যায় চাঁদা দিতে অপারগ প্রতিবেশীর দেওয়ালে বা গ্রিলের সামনে হিসি করে দিয়ে পালিয়ে যায়, বা বাজারে ও গলিতে অশ্রাব্য শ্লোক পাঠ শুরু করে গৃহ কর্তা কে দেখে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিজেপির মোদী সরকারের যোগ করা হিন্দু ধর্মের আগ্রাসী ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিস্ট দর্শন, যার ফলে এখন চাঁদা চাওয়াটা এক রকম সংবিধানিক অধিকারে দাঁড়িয়েছে।  চাঁদা তো দাদা হিন্দু ধর্মের স্বার্থে, না দিলে আপনি দেশদ্রোহী, দিলে অবশ্যই দেশ প্রেমী। 

ধরুন আপনি অ-হিন্দু এক মুসলমান বা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ এবং পাড়ার দাদারা আপনার দরজায় রসিদ নিয়ে হাজির। আপনি বললেন যে আপনি হিন্দু নন, তাহলে কি? মা তো সবার, টাকা ছাড়া কি চলবে বন্ধু ধর্ম তো সব এক! তখন আপনি জানতে চাইলেন যে ধরুন আমি পাড়ায় একটি মিলাদ শরিফ বা খ্রিস্টমাস উদযাপন করতে চাই এবং এর জন্যে যদি ঘর প্রতি এক শত টাকা চাঁদা তুলি? তখন আপনাকে জানানো হবে যে আপনার ধর্মটি এই দেশের বা এই রাজ্যের ধর্ম নয় এবং ওই সব উত্সবের খরচা কোনও ভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ গর্বিত হিন্দুরা দিতে রাজি নয়। আপনি বললেন যে তাহলে আমি কেন অন্য ধর্মের উত্সবে চাঁদা দিতে বাধ্য ? তখনই ঝুলি থেকে বেড়াল বেড়িয়ে আসবে, সংখ্যালঘু প্রীতি দেখানো দিদির ভাইরা আপনাকে আরএসএস এর কায়দায় চোখ রাঙিয়ে জানিয়ে দেবে, এই দেশ হিন্দু দেশ এবং এখানে থাকতে গেলে আপনাকে অবশ্যই হিন্দু ধর্মের (তথাকথিত শ্রেষ্ঠতার দর্শনের) স্বার্থে দাদাদের মদ মাংসের টাকা যোগাতে হবেই।      

চাঁদার রসিদ মোটামুটি পাঁচশো টাকার আসেপাশে ঘোরাঘুরি করছে, যার ফলে সাধারণ গরিব শ্রমজীবি মানুষ, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ নিদারুণ সংকটে পড়ছেন। চাঁদা না দিলে পাড়ায় থাকা যাবে না, চলতে বসতে আপনাকে অপমানিত হতে হবে, তাই ছেলের দ্বিতীয় জামার বদলে ওই ক্লাবের ছেলেদের চাঁদার নামে তোলা দেওয়ায় শ্রেষ্ঠ পন্থা হয়ে ওঠে। এই অত্যাচারে একপ্রকার সকলেই অতিষ্ঠ, তবুও মানুষ আগ্রাসী তৃণমূলী সন্ত্রাসের ভয়ে, নিজের পাড়ায় এক ঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়ে, বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সন্ত্রাসের ভয়ে চুপচাপ ফুলে ছাপের মতনই নীরব থাকা শ্রেষ্ঠ মনে করেন।  

পুজোর নামে এই সন্ত্রাসী আক্রমণ চলবে দূর্গা থেকে সরস্বতী পুজো অবধি, প্রতি মাসে আপনাকে গুনতে হবে অসংখ্য টাকা শুধু পাড়ার ছেলেদের মদ - মাংস খাওয়ানোর টাকা যোগাতে। কেন দিতেই হবে পুজোর চাঁদা ? এতে সাধারণ গরিব মানুষের কি লাভ ? যে গরিব কৃষকের ফসল মারা গেল, যে বন্ধ কারখানার শ্রমিক পেট চালাতে দিন মজুরের কাজ করছে তাঁর এই পুজোর মোচ্ছবে কি লাভ হচ্ছে ? পুজোয় শুধু লাভের মুখ দেখে একের পর এক পুজো কমিটি যারা পুজোর চাঁদার টাকার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করছে, লাভ তোলে কংগ্রেসী (তৃণমূলী সহ) ও গৈরিক বাহিনীর নেতারা যাদের বদন্যতায় পুজো কমিটিগুলি মোচ্ছব করতে পারে লোকের টাকায়। এই ক্লাবগুলি থেকে বেড়িয়ে আসে ভোটের পদাতিক বাহিনী যারা আপনাকে বুথে কোন বোতাম টিপতে হবে তা জানিয়ে দেয়।  এই কারণেই এদের তোয়াজ করে চলে সমস্ত ভোট বাদী দলের নেতৃত্ব এবং সেই সমর্থনের ছাতার তলায় এই সব ক্লাব মানুষের ওপর শোষণ অত্যাচারের রোলার চালিয়ে বারোয়ারি পুজোর নামে মোচ্ছব করার টাকা তোলে।  

যত দিন এই আধা সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থা ও তার অনুষাঙ্গিক পঁচা সমাজ ব্যবস্থা টিকে থাকবে ততদিন চলবে ধর্মের নামে এই শোষণ ও অত্যাচারের রোলার, যার সাথে সত্যিই মিলিয়ে দেখলে ওই দাদরীতে গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে ঘটিত হত্যাকান্ডের কোনও ফারাক নাই। আজকের নতুন প্রজন্মের যুব সমাজের উচিত মানুষের টাকায় এই ভাবে শহর ও রাজ্য জুড়ে চলতে থাকা বাত্সরিক মোচ্ছব উত্সবের তীব্র বিরোধিতা করা এবং মানুষকে সংঘবদ্ধ করে এই প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। এ না হলে সারাজীবন শুধু কষ্টে অর্জিত টাকা তথাকথিত ধর্মীয় আবেগের সুরসুরি মেটাতে চলে যাবে, আর ফুলে ফেঁপে উঠবে কিছু মদন মিত্তির।        

           

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে