ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে আজ বাঙালি কে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তেই হবে

শনিবার, এপ্রিল ১৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-



বাংলার ১৪২৪ সালে বাঙালি জাতি আজ প্রবেশ করলো। নানা দিকে মহা ধুমধামে শুভ নববর্ষ পালন করতে দুই বাংলার মানুষ উঠে পড়ে লেগেছেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ, এই দুই বাংলার মানুষের উপর আজ নেমে আসছে অসংখ্য আক্রমণ, এই দুই বাংলার মানুষের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি কে আজ পদদলিত করে নিঃশেষ করে দিতে চাইছে আগ্রাসী হিন্দি ও আরবি মৌলবাদ। ভারতবর্ষের শাসক শ্রেণীর দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম ভাষা হিন্দি ও তার আনুষঙ্গিক সংস্কৃতি আজ পশ্চিমবঙ্গের বুক থেকে বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি কে শেষ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। অন্যদিকে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের পদলেহী জামাতি সালাফিরা আজ বাংলাদেশের বুকে সহি ইসলামের নাম করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কে যেমন জোর করে মোছার চেষ্টা চালাচ্ছে আরবি আগ্রাসনের মাধ্যমে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে বাঙালি শাসক শ্রেণী আজ বাংলাদেশের আদিবাসী ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপর জোর করে বাংলা ভাষা কে চাপিয়ে তাঁদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে শেষ করে দিতে চাইছে।  

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ এই দুই জায়গায় ধর্মীয় মৌলবাদ আধুনিক নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির হাত ধরে ভীষণ শক্তিশালী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দুই জায়গার সংখ্যালঘুরা আজ আক্রান্ত এবং আতঙ্কিত।  তাঁরা আজ ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন, কারণ  কখন যে তাঁদের উপর আক্রমণ শুরু করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের মৌলবাদী শক্তি, তার কোন ঠিক নেই।  অন্যদিকে নিজেদের বেশ ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল হিসেবে চিহ্নিত করা মমতা বন্দোপাধ্যায় বা শেখ হাসিনা কিন্তু গোপনে সেই মৌলবাদী শক্তিদেরই হাত ধরে রেখেছে যাদের বিরুদ্ধে দিন রাত তাঁরা গলা ফাটাচ্ছে মাঠে ময়দানে। তাই মমতা বন্দোপাধ্যায় আজ নিজের লোকেদের যেমন বাজারে হনুমান পুজো করতে নামাচ্ছে তেমনি শেখ হাসিনা গোপনে জামাতিদের বাংলা নববর্ষের উৎসবে হামলা করতে টাকা দিচ্ছে।

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি এক হওয়া সত্বেও শাসক শ্রেণীর নিজ স্বার্থে বাংলার মানুষ কে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে রাখা হয়েছে, বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর কে বিগত দুইশো বছর ধরে আরও উঁচু করা হয়েছে এবং বর্তমানে নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির স্রোতে গা ভাসিয়ে বাংলায় আগমন হওয়া উগ্র হিন্দুত্ববাদ আর সালাফিবাদ বাংলার মানুষ কে আবার অন্ধকার অতীতে নিয়ে যেতে চাইছে, নিয়ে যেতে চাইছে সেই ভয়াবহ ১৯৪৬ সালে, যখন ধর্মের দোহাই দিয়ে আরএসএস-হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগ বাঙালি কে দিয়ে বাঙালি কে মেরেছিল, গরিব বাঙালি কে দিয়ে তাঁর অন্য্ ধর্মের গরিব বাঙালি ভাই কে হত্যা করিয়েছিল দেশভাগের ঘৃণ্য খেলা খেলতে। এই হিংসা ও রক্তপাত দিয়ে যে পথ চলা অধুনা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ শুরু করে সে পথের প্রতি কোন প্রতি প্রান্তরে শুধুই ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষবৃক্ষের সারি দেখা যায়।

আজ সেই ঘৃণা ও বিদ্বেষের হাত ধরে দিলীপ ঘোষ, কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, ইত্যাদী হিন্দি ভাষী ও তাদের দালালেরা আজ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের  উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে নিজেদের সংস্কৃতি ও ভাষা কে, নিজেদের উগ্র হিন্দু ধর্মের প্রকরণ কে আর শেষ করে দিতে চাইছে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক মৈত্রী ও ঐক্য কে।জোর করে অশ্রুত হনুমান পুজো, রাম নবমীর সশস্ত্র মিছিল থেকে শুরু করে সমস্ত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় মসজিদে শুয়োরের মাংস ফেলে আর মন্দিরে গরুর মাংস ফেলে সেই এক শতাব্দী পুরানো কায়দায় দাঙ্গা লাগাচ্ছে বিজেপি, আরএসএস, ভিএইচপি, বজরং দল ও হিন্দু সংহতির মতন ঘৃণ্য ফ্যাসিবাদী দল।  

ঠিক একই ভাবে আজ সৌদি আরবের টাকায় বলীয়ান হয়ে জামাতি সালাফিরা আজ বাংলাদেশের নারী-শিশু-বৃদ্ধ সকলের উপর নামিয়ে আনছে সহি ইসলামের খাঁড়া, যে কেউ তাদের নিম্ন মানের চেতনা কে প্রশ্ন করছে তাদের কল্লা ফেলছে অন্ধকারে চাপাতির কোপে। ধর্মের দোহাই দিয়ে সারা বাংলাদেশ জুড়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সংখ্যালঘু হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর আর সালাফি মোমিনের খুন ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। এপারে মমতা আর ওপারে হাসিনা তবুও নির্বিকার চিত্তে মনুষ্যত্বের শত্রুদের এই বিভীষিকা দেখে চুপ করে বসে তালে তাল ঠুকছে।

অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতন বাঙালির নিজস্বতা আজ হিন্দুত্ব ও সালাফি ইসলামের আক্রমণে চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সহজেই স্বল্প চেতনার মানুষগুলো কে ভুল বুঝিয়ে হিন্দুত্ববাদী ও ইসলামী শক্তিরা আজ বাংলার সংস্কৃতি ও মৈত্রীর বন্ধনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে আর বাঙালি কে দিয়ে বাঙালি কে খুন করিয়ে নেপোয় মারে দই’র মতন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।  এই ষড়যন্ত্রের ফলে আসতে আসতে বাঙালির মনন থেকে ও চেতনা থেকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে আর হিন্দি ও আরবি ধীরে ধীরে নিজের ঘাঁটি গেড়ে বসবে। যে বাঙালি পঞ্চাশ বছর আগে সংগ্রাম করে নিজের ভাষা ও নিজের পরিচয় কে আদায় করে নেওয়ার স্বার্থে এক নদী রক্ত বিসর্জন দিয়েছিল, সেই বাঙালি আজ কেন পদদলিত হয়ে পড়ে থাকবে পর-জাতির সামনে? কেন বাঙালি নিজের পরিচয় কে নিয়ে পয়লা বৈশাখের পরে আর গর্বিত হবে না ? কেন সে নিজের ভাষায় কথা বলা, প্রার্থনা করা, গান গাওয়া, থেকে কাজ করার অধিকারের জন্যে গলা ফাটাতে পারছে না ? কেন মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে দাবি জানাতে পারছে না ?

এই সবের কারণ হলো বাংলা ও বাঙালির নয়া ঔপনিবেশিক শাসনের বেড়াজালে আটকে পড়া। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের স্লোগান তোলা ভারতের শাসক শ্রেণী ও সালাফি ইসলামের রক্ষাকারী বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী আজ বাঙালি জাতিকে বৃহৎ একচেটিয়া বিদেশী পুঁজির কাছে বন্ধক রেখেছে। বাংলার শ্রম, সম্পদ, ও প্রকৃতি কে ধ্বংস করতে আজ বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির পোষা কুকুরের ভূমিকা পালন করছে দুই বাংলার শাসক শ্রেণী। তারা জানে যে নানা ভাষা ও নানা সংস্কৃতি কে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও দেশি মুৎসুদ্দিরা পছন্দ করে না, বরং তারা চায় একটি ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ, যাতে ওদের পক্ষে সব সময়ে সহজেই নিজেদের পণ্য উৎপাদন করানো ও বন্টন করানো সম্ভব হয়। আর বাঙালি কে এই জন্যেই টেনে আনা হচ্ছে হিন্দি আর আরবির জালে, যাতে অর্থনৈতিক ভাবে পরাধীন বাঙালি জাতি তাঁর নিজস্বতা কে হারিয়ে দাস হয়ে যায় শাসক শ্রেণীর ভাষা ও সংস্কৃতির।

বাংলা ও বাঙালির উপর এই আগ্রাসন কে শুধু মেকি বুদ্ধিজীবিদের সভা সমিতি করে বা পয়লা বৈশাখের উচ্চ মধ্যবিত্ত সুলভ কার্নিভাল করে রোখা সম্ভব নয়। বাংলা ও বাঙালির নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি, যা দুই বাংলার আপামর খেটে খাওয়া মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি, তাকে রক্ষা করতে আজ বাঙালি কে গড়ে তুলতেই হবে এক প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বাংলা ও বাঙালির শত্রুদের বিরুদ্ধে এবং ওদের দালাল বাঙালি সামন্তশ্রেণী ও মুৎসুদ্দি শক্তির বিরুদ্ধে। একমাত্র গরিব বাঙালির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই পারবে এক নতুন বাংলার নির্মাণ করতে আর সেই বাংলা কে গড়ে তুলতে আজ দুই বাংলার প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক মানুষ কে সাম্প্রদায়িক ও বিভেদকামী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।     

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে