পুরুলিয়ায় বিজেপি কর্মীদের হত্যা কি সংঘ পরিবারের স্বার্থে?

রবিবার, জুন ০৩, ২০১৮ 0 Comments A+ a-



সম্প্রতি, পুরুলিয়া জেলায় দুই বিজেপি কর্মীর দেহ কিছুদিনের ব্যবধানে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে এবং তারপর থেকেই রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা অবনতির ও তৃণমূলের হিংসাত্মক রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলে বিজেপি ও সংঘ পরিবার বাজার গরম করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও পুরুলিয়া পুলিশের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুসারে দ্বিতীয় মৃত ব্যক্তি, দুলাল কুমার (৩০), আত্মহত্যা করেছেন, তবুও রাজ্য সরকার এই মৃত্যুর তদন্তের ভাঁড় সিআইডি’র হাতে তুলে দিয়েছে। বিজেপির নিশানার তীর তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে আর তৃণমূলের নিশানার তীর বিজেপি থেকে মাওবাদী, প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই।  পুরুলিয়া জেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস গো হারা হারায় মমতা বন্দোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দোপাধ্যায় জেলাকে বিরোধী শূন্য করতে চান বলে বিজেপির অভিযোগ। 

কয়েকদিনের ব্যবধানে সংগঠিত এই জোড়া মৃত্যু বাংলার জনমানসে বিজেপির পক্ষে কতটা সহানুভূতির জোয়ার এনে দেবে তা বিতর্কের বিষয়, কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য যে এত সরল ভাবে সমাধান হবে তা কিন্তু যে কোন সমালোচক সাংবাদিকের পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর। বিজেপির অভিযোগ নিঃশর্ত ভাবে মেনে নেওয়া অনেকটা হয়ে যাবে রাষ্ট্রের হাতে খুন হওয়া মানুষেরা এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ারে মরেছে সেটা স্বীকার করে নেওয়ার মতন। 

বিজেপি এই রাজ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিদ্বন্ধি হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেস কে আজ টেক্কা দিতে পারছে তার কৃতিত্ব যেমন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দ্বারা ১৯৯৮ সালে বিজেপি কে খাল কেটে বাংলায় ঢুকতে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেওয়ার ঘটনায় নিহিত, ঠিক তেমনি, অধঃপতিত সংশোধনবাদী সংসদীয় বামপন্থী দলগুলির, যাদের পান্ডা হলো সিপিএম, তাদেরও চরম দেউলিয়াপনা ও অক্ষমতায় নিহিত। 

রাজনৈতিক হিংসার মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখা ও বিরোধীদের নিকেশ করে দেওয়ার রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস পার্টি ১৯৫০ এর দশকে আমদানি করেছিল কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে, শ্রমিক ও কৃষকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্যে। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতা দখল করতে পারে কারণ ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর পদলেহী শ্বাপদ সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সরকার যে নৃশংস তান্ডব লীলা পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭২ থেকে চালিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে নকশালপন্থীদের প্রতিরোধ সংগ্রাম ও বন্দিমুক্তি সংগ্রামের লাভটা জ্যোতি বোস ও সিপিএম সেদিন নেপোয় মারে দই করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পেরেছিল বলে। ঠিক তেমনি, মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১ সালে বামফ্রন্টের সামাজিক-ফ্যাসিবাদী শাসন কে উচ্ছেদ করে এক প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিবাদী সরকার গঠন করতে পেরেছিল কারণ মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ও মাওবাদীদের সাহায্যে তৃণমূল কংগ্রেস সিপিএমের হার্মাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে লালগড়ের নানা প্রান্তে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিল এবং তার ফলে একটি চরম দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দল হওয়া সত্বেও তৃণমূল মানুষের কাছে নিজেদের একটি প্রতিবাদী ও প্রতিরোধী ভাবমূর্তি গড়ে সমর্থন কুড়োতে পেরেছিল। আজ বিজেপি ঠিক সেই পথেই চলে, সিপিএমের খালি করে যাওয়া ময়দানে সিপিএমের প্রাক্তন কর্মী ও সমর্থকদের সমর্থনে বলীয়ান হয়ে তৃণমূলের নৃশংস সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারছে। 

এখানে বিজেপি যে শুধু হিন্দুদের সমর্থন আদায় করছে তাই নয়, ২০১৪ সালে সমগ্র বীরভূমের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে বিজেপি নিজের সংগঠন কে শক্ত করে গড়ে তোলে এবং সেই সংগঠনের উপর ভর করে দুধ কুমার মন্ডলের মতন জোতদার অনুব্রত’র (কেষ্ট) মতন সাংঘাতিক সন্ত্রাসবাদীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে জমি দখলের। এই রাজায় রাজায় যুদ্ধে যে অসংখ্য উলুখাগড়ার প্রাণ যায় তাঁদের অধিকাংশই কিন্তু সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের নয়তো আদিবাসী বা নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের গরিব মানুষ। ঠিক কেশপুরের মতন আজ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তৃণমূলের ক্ষমতা ধরে রাখার ও বিজেপির ক্ষমতা দখল করার হিংসাত্মক সংঘর্ষ চলছে। এরই মধ্যে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে তীব্র হিংসা কে উপেক্ষা করেও বিজেপি যে পুরুলিয়া দখল করতে পেরেছে তার শ্রেয় কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে দিন দিন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বেড়ে চলা ক্ষোভ কে দিতে হয়। 

বীরভূম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জুড়ে আজ বিজেপি গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে যাচ্ছে আরএসএস এর সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্ক কে ব্যবহার করে এবং এই কাজে তৃণমূলের একটা বড় অংশই কিন্তু বিজেপি কে সাহায্য করছে রাতের আঁধারে। এই ধরুন বাঁকুড়ার তালডাংরার কথা, বিজেপি এখানে প্রবেশ করে ১৯৯৮ সালে তৃণমূলের কোলে চেপে আর আজ আরএসএস এর অসংখ্য সন্ত্রাসী শিবিরের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে বিজেপি হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদী ফৌজ খাড়া করেছে এবং তোলা আদায়, নারী পাচার থেকে বিভিন্ন বেআইনি কারবারে নিজের একচেটিয়া অধিকার কায়েম করে ফেলেছে । তৃণমূল এখানে বিজেপির সাথে রফা করে ফেলেছে আর কোথাও কোথাও অস্তিত্বের সঙ্কটে ধুঁকতে থাকা সিপিএম বিজেপির সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে লুটের বখরার উপর অধিকার কায়েম করতে। 

সিপিএম আজ কংগ্রেসের লেজুড় হয়ে যেটুকু অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছিল তাও আজ বিশ বাওঁ জলে এবং এর ফলে সিপিএমের কর্মীরা দলে দলে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছে প্রাণ ও জমি বাঁচাতে। বর্তমানে যদি আবার বিধানসভা নির্বাচন হয় তাহলে সিপিএম পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্রের থেকে ধুয়ে মুছে যাবে এবং বিজেপি তৃণমূলের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলার ঔদ্ধত্ব দেখাবে, এই কথা বলার জন্যে কোন বড় রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দরকার পড়বে না, কারণ একথা আজ গ্রামের শিশুরা পর্যন্ত বলতে পারবে।  

এর মধ্যে যদি তৃণমূল কে নিজের ঘাঁটি ও ক্ষমতা বাঁচাতে হিংসায় জড়াতে হয়, তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস কে রাতের অন্ধকার অবধি অপেক্ষা করতে হবে না, বরং দিনের আলোয়, ভাঙড়ের মতনই, যে কোন জায়গায় যে কোন ব্যক্তি কে হত্যা করার ক্ষমতা আজ মমতা বন্দোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের আছে। তৃণমূলের হিংসার সাথে সমগ্র রাজ্য পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরিচিত হয়েছিল ভালো ভাবেই আর তাই বিজেপির দুই চুনো পুঁটি কে দিনের আলোয় নিকেশ করতে তৃণমূলের কোন বিশেষ সমস্যা হতো না। পুরুলিয়ার মতন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাউকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক পরেই রাতের অন্ধকারে বাইকে করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে খুন করে গাছে টাঙিয়ে মৃতের জামায় হুমকি লিখে আসার মতন বেদনাদায়ক পরিশ্রম তৃণমূলের হার্মাদ বাহিনী এই মুহূর্তে করবে এটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হবে। 

বিগত দিনে, বামফ্রন্ট আমলে, পুরুলিয়ার ওই সকল অঞ্চলে মাওবাদীদের হাতে বেশ কিছু সিপিএম নেতা ও কর্মীর প্রাণ যায়, যার সাথে কিন্তু বর্তমানের বিজেপি কর্মীদের হত্যার কোন সাদৃশ্যতা খোঁজা শিশুসুলভ আচরণ হবে। মাওবাদীরা যাঁদের আজ অবধি খুন করেছে তাঁদের মৃতদেহের পাশে তাঁরা পোস্টার লিখে নিজেদের দ্বায়িত্ব স্বীকার করেছে এবং সেই পোস্টারগুলির নিচে মাওবাদীদের সাংগঠনিক পরিচয় থাকতো। নিজেদের নামে কাউকে হত্যা করতে মাওবাদীরা কুন্ঠিত বোধ করে না কারণ তাঁদের দল অনেক দিন ধরেই নিষিদ্ধ এবং নির্বাচনের কোন বালাই মাওবাদীদের নেই। যদিও মাওবাদীরা বর্তমানে পুরুলিয়ায় ফের নিজেদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তবুও এই দুই মৃত্যুর দায় তাঁদের ঘাড়ে চাপানো যায়না, কারণ তাঁরা যদি এদের মেরেই থাকতো তাহলে সেই মৃত্যুর দায় নিয়ে প্রশাসনের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা আতঙ্কের স্রোত বইয়ে দিতে পারতো মাওবাদীরা।  

যদি তৃণমূল এবং মাওবাদীরা এই দুই জন কে না মেরে থাকে তাহলে কে এদের মারতে পারে? সিপিএম আর কংগ্রেসের এখন সাইনবোর্ডটুকুও পুরুলিয়া জেলায় নেই। তৃণমূলের সন্ত্রাসে এই দলগুলির অস্তিত্ব অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। তবে যে দলের শক্তি এই মুহূর্তে পুরুলিয়ায় বেড়েছে তা হলো বিজেপির এবং এর সাথে সাথে আরএসএস এর। নিজ দলের লোক কে কোরবানির পাঁঠা বানানো বিজেপির কাছে নতুন কিছু না। হরেন পান্ড্যা থেকে গোপীনাথ মুন্ডে, দীনদয়াল উপাধ্যায় থেকে প্রমোদ মহাজন, যখন যাকে খরচের খাতায় ফেলার দরকার বিজেপি বা আরএসএস এর হয়েছে তখন সেই মরেছে কোন না কোন আততায়ীর হাতে, দোষটা অবশ্যই অন্য কারুর উপরে চাপানো হয়েছে। এত বড় বড় মহীরুহ যাঁরা কেটে ফেলতে পারে অবলীলায়, তাঁরা যে দুটি নটে গাছ মাড়িয়ে দেবে না সে কথা শিশুও বিশ্বাস করবে না। 

সম্প্রতি, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে, নিজের পক্ষে সমর্থনের জোয়ার আনতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের দরকার হয়ে পড়ে বিজেপির এবং তাই পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য এলাকার মতন পুরুলিয়াতেও রাম নবমীর মতন অবাঙালি, উত্তর ভারতীয় উৎসব কে ঘিরে দাঙ্গার আগুন লাগায় সংঘ পরিবার। এই কাজে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে বজরং দলের জেলা নেতা ও বিজেপির যুব নেতা গৌরাব সিংহ, যে আবার প্রাক্তন এসএফআই কর্মী। তীব্র মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে মানুষে মানুষে ঘৃণা ছড়াতে ওস্তাদ গৌরাব সিংহ, পুরুলিয়ার রাম নবমীর দিনে সশস্ত্র মিছিলের মাধ্যমে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গার আগুন জ্বালায় এবং এই হিংসায় এক মুসলিম যুবকের মৃত্যু হয় বজরং দলের কর্মীদের আক্রমণে। হিন্দি-ভাষী উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় আরএসএস নেতাদের ভাড়াটে গুন্ডা হিসেবে গৌরাব সিংহ ইতিমধ্যে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠেছে জমির দালালি থেকে নানা অপরাধে সামিল হয়ে। এহেন গৌরাব সিংহ গ্রেপ্তার হওয়ায় তাঁর স্বরূপ যাতে জনগণের সামনে না আসে, পুরুলিয়ার থেকে বিজেপির নারী পাচার থেকে মাদক পাচারের মতন অপরাধের হিসেব যাতে জনগণ বা দেশের মানুষ না জানতে পারেন, তাই হয়তো হঠাৎ দুটি মৃতদেহ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল। 

বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিন্তু এই ঝুলন্ত দেহ পাওয়ার পর থেকেই নিজেদের প্রচার কে তুঙ্গে নিয়ে গেছে এবং তৃণমূলের সাথে সাথে শ্রমজীবি মানুষের স্বার্থে আন্দোলন করা, দলিত ও আদিবাসী জনগণের স্বার্থে কথা বলা শক্তিগুলি কে নিজেদের আক্রমণের নিশানা বানিয়েছে। আসানসোলে মার্চ মাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাবার হোতা, সুপ্রিয় বড়াল ওরফে বাবুল সুপ্রিয় কিন্তু সোজা আক্রমণ সেঁধেছে বামপন্থীদের উপর এই বলে যে বিজেপির দলিত ও আদিবাসী কর্মী হত্যার বিরুদ্ধে তাঁরা কেন প্রতিবাদ করছেন না। বিজেপি বলছে যে তাঁদের কর্মীদের উপর আক্রমণ আসলে ফ্যাসিবাদ এবং এর প্রতিবাদ সকল বাম ও গণতান্ত্রিক মানুষদের করা উচিত। 

হয়তো বাবুল সুপ্রিয়ের মনে নেই যে বিজেপি বা আরএসএস এর নেতৃত্বাধীন কোন সংগঠনে যোগ দেওয়ার সাথে সাথে দলিত ও আদিবাসী সমাজের কিছু দলছুট মানুষ সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর পদাতিক বাহিনীর সদস্য হয়ে ওঠে। তাঁরা যে শুধু মুসলিম বা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক আক্রমণ চালায় তাই নয়, বরং অন্যান্য দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধেও তাঁরা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, যেমন টাটা ও বেদান্তের পয়সায় পরিচালিত হওয়া ছত্তিশগড়ের সালোয়া জুডুম এর খুনি সন্ত্রাসীরা সকলেই কিন্তু আদিবাসী সমাজ থেকে আগত আরএসএস এর সস্তা পদাতিক ছিল। তাই যে আদিবাসী বা দলিত আরএসএস সন্ত্রাসী হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের ঝান্ডা উত্তোলন করার জন্যে প্রাণ দেয়, তাঁদের সাথে শোষিত, নিপীড়িত ও অত্যাচারিত দলিত ও আদিবাসীদের কোন সম্পর্ক থাকে না। ফলে সেই গেরুয়া বাহিনীর কাছে বিকিয়ে যাওয়া আদিবাসী বা দলিতের স্বার্থের সাথে সমগ্র আদিবাসী ও দলিতদের স্বার্থের কোন সম্পর্ক থাকে না এবং তাই কোন গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তি এহেন মৃতদের পক্ষে আন্দোলন করে না। 

বিজেপির পক্ষে খরচের যোগ্য যে কোন আদিবাসী বা দলিত কর্মী কে আরএসএস এর দক্ষ সন্ত্রাসবাদীদের দিয়ে খুন করিয়ে গাছে টাঙিয়ে, ভাঙা ভাঙা বাংলা বক্তব্য লিখে একটা সেনসেশন ছড়ানো সংঘ পরিবারের পক্ষে কোন বড় ব্যাপার নয়। পুরুলিয়ার সাথে, পুরুলিয়ার আদিবাসী সমাজের সাথে বিজেপির কোন প্রত্যক্ষ বা আবেগের সম্পর্ক নেই। পুরুলিয়ার দরিদ্র মানুষ কি ভাবে দিন কাটান, কি ভাবে আদিবাসী জনগণ সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন মাত্র ভাত খেয়ে বাস করেন, তা নিয়ে বিজেপির কোন মাথা ব্যাথা নেই। বিজেপির কাছে পুরুলিয়ার প্রয়োজনীয়তা হলো নকশালপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করার জন্যে, সমস্ত জোতদার ও জমিদারদের নিজের নেতৃত্বে নিয়ে আসার জন্যে এবং অসংখ্য আদিবাসী যুবকদের টাকা, মদ ও মহিলার প্রলোভন দেখিয়ে আরএসএস এর সন্ত্রাসী বানিয়ে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে পদাতিক বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে। 

বিজেপি এখন পশ্চিমবঙ্গের থেকে বামপন্থার রেশটুকু, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের রেশটুকু শেষ করে দিয়ে শুধু মাত্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মাধ্যমে নিজের পালে জোর হাওয়া টেনে প্রধান বিরোধী দল হতে চায়। মমতা বন্দোপাধ্যায় এবং কংগ্রেস পার্টিও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ভারতের যে কোন রাজ্যের মতন শুধু দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ময়দান হওয়ার পক্ষপাতী। অন্যদিকে অস্তিত্বের সঙ্কটে হতাশ সামাজিক-ফ্যাসিবাদী সিপিএম ও অন্যান্য সংসদীয় বাম দলগুলির সুবিধাবাদের পাঁকে ডুবে শেষ হয়ে যাওয়া দেখে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের মধ্যেই বামপন্থা নিয়ে এক বিরূপ মনোভাবের জন্ম হয়েছে। এই সঙ্কট কালে কোন বিপ্লবী বামপন্থী শক্তির শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনতার মধ্যে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রচার আন্দোলনের অভাবে, লেগে পড়ে থেকে তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণ কে, বিশেষ করে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের, আদিবাসী জনগণকে ও নমঃশূদ্র মানুষদের জাগিয়ে না তোলার ফলে আজ হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শক্তি ও ইসলামিক মৌলবাদী শক্তি গ্রামাঞ্চলে প্রশ্রয় পেয়ে নিজেদের দুর্গ গড়ে তুলছে। 

আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের সমর্থন পাওয়ার জন্যে বিজেপি ও আরএসএস অনেক রক্ত বইয়ে দিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দি-ভাষী অঞ্চলগুলোয় কি ভাবে উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খন্ড এবং বিহার থেকে গুন্ডা বাহিনী এনে দাঙ্গা লাগিয়ে মেরুকরণ চালাচ্ছে বিজেপি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আসানসোল ও রানিগঞ্জের রাম নবমীর উপলক্ষ্যে লাগানো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আজ এই ঘৃণার বীজ কে আরএসএস বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে আদিবাসী অঞ্চলে রোপন করছে এবং এখনই এদের কে প্রতিরোধ করে পরাস্ত না করতে পারলে আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে এমন বিষবৃক্ষ ফলে উঠবে যা আমাদের ভবিষ্যৎ কে বিষ বাতাসে ভরিয়ে দেবে এবং হিংসা ও মৃত্যুর ঘৃণ্য তান্ডব এই বাংলার পরিচয় উঠবে। হয় আমাদের আজ বাংলার ভবিষ্যতের জন্যে রুখে দাঁড়াতে হবে আর না হয় হিন্দি-ভাষী হিন্দুত্বের ধ্বজ্জাধারীদের পদদলিত হয়ে চিরকাল বাস করতে হবে।   

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে