ভারতের অর্থনৈতিক সর্বনাশের ও লুঠের কান্ডারী মোদী সরকার

রবিবার, জুন ০৩, ২০১৮ 0 Comments A+ a-

 


বলা হচ্ছে উন্নয়ন থুড়ি “ভিকাস” নাকি শুধু দাঁড়িয়েই নেই বরং এমন দ্রুত গতিতে দৌড়োচ্ছে যে ধরার জো নেই, আর ধরার জো নেই বলেই যা কেষ্ট বা মুকুলে দেখতে পায় তা সাধারণ মানুষে দেখতে পায়না। বলা হচ্ছে যে সমালোচনা বন্ধ করুন কারণ নরেন্দ্র মোদীর কোন বিকল্প নেই আর হিন্দু রাষ্ট্র আজ ব্রাক্ষণ জাতির চাই চাই, ফলে আজ আবার আপনি গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা বা গরিবের স্বার্থের কথা বলে শিবাজী রাজার ₹৩,০০০ কোটি টাকার মূর্তি বা চীন থেকে আমদানি করা বল্লভভাই প্যাটেলের কয়েক হাজার কোটি টাকার মূর্তির মধ্যে থেকে দৃশ্যমান হওয়া উন্নয়নের রথযাত্রা কে ভঙ্গ করতে পারবেন না। বলা হচ্ছে আপনি দুর্বল কারণ জোটবদ্ধ হয়ে কংগ্রেসের কোঁচড় ধরে না ঝুলে আজ আপনি বিজেপির রথ কে বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার থেকে রুখতে পারবেন না। বলা হচ্ছে চুপ করুন কারণ উন্নয়ন আপনার কথায় বিরক্ত হচ্ছে। 

এই যে তুতিকোরিন শহরে যে ১৩ জন মানুষ বেদান্ত কোম্পানির লোভ ও লালসা চরিতার্থ করার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গুলি খেয়ে শহীদ হলেন, বা এই যে অলীক চক্রবর্তী বা ভাঙ্গরের গণআন্দোলনের অন্যান্য কর্মী সমর্থকদের মুক্তির দাবিতে পথে নেমে যাঁরা আজ আরাবুলের মতন গুন্ডাদের সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন, এই যে কৃষকেরা গ্রামে গ্রামে বিজেপির কর্পোরেট স্বার্থ-রক্ষাকারী চরিত্রের বিরুদ্ধে ও কৃষক-বিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে আজ গর্জে উঠেছেন, এই যে কৃষকেরা মধ্যপ্রদেশ থেকে মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে বিজেপির ঘৃণ্য নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন, এই যে জাট সম্প্রদায়ের কৃষকেরা আখের দাম না পেয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে কেরানা উপনির্বাচনে গর্জে উঠলেন, এই যে দিকে দিকে ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বৃহৎ সংগ্রাম গড়ে উঠছে, এই যে দিকে দিকে মানুষের মধ্যে তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে এত অসন্তোষের জন্ম নিচ্ছে, এই সব কিছু কে মোদীর উন্নয়নের ধারা রুখে দিতে পারবে তো?

সহি নিয়ত - মানে হলো সঠিক ইচ্ছা, বা সঙ্কল্প। তো এই সঠিক সঙ্কল্প নিয়ে উন্নয়ন (ভিকাস) করার যে বিজ্ঞাপন আজ বিজেপি সরকার নরেন্দ্র মোদী কে শিখন্ডি করে জনগণের ট্যাঁকের পয়সা খরচ করে সংবাদপত্র থেকে শুরু করে টিভি বা ইন্টারনেটে দিচ্ছে, সেই উন্নয়ন কে অনুব্রতের উন্নয়নের ন্যায় দেখতে পাওয়া যাবে তো? কেষ্ট বাবুর উন্নয়নের মতন এই উন্নয়নের বা ভিকাসের হাতেও ব্যাটাম রয়েছে নাকি? এই সকল উত্তর জানার জন্যে আপনাকে দেখতে হবে ভারতবর্ষের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতির দিকে, যার মধ্যে দিয়ে আপনি দেখতে পাবেন যে কি চরম সঙ্কটে আজ ভারতেবর্ষ ডুবে আছে। “ভিকাস” যে আসলে একটি সঙ্কটের নাম, তা আপনি বুঝতে পারবেন।  

গত আর্থিক বছরে, অর্থাৎ ২০১৭-১৮ সালে ভারতের মোট গ্রাহস্থ্য উৎপাদ ৬.৭৪ শতাংশে নেমে এসেছিল, যা নরেন্দ্র মোদী সরকার গঠনের পরবর্তী সময়কালের সবচেয়ে নিম্ন বৃদ্ধির হার। যদিও স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদেরা এই সঙ্কটের কারণ হিসেবে ২০১৬ সালের ₹৫০০ ও ১,০০০ টাকার নোট বাতিল করা ও জিএসটি প্রচলন করা কে চিহ্নিত করেছেন, মোদী সরকারের পেয়াদা অর্থনীতিবিদেরা তা মানতে অস্বীকার করেন। দেশীয় অর্থনীতি কে চালনা করার ক্ষেত্রে মোদী সরকারের কাজ হচ্ছে নিজের কাল্পনিক উন্নয়নের কাহিনী প্রকাশ করে জনগণ কে বোকা বানানো এবং সরকারি ব্যাঙ্কের অর্থ দিয়ে, বিভিন্ন ধরণের কর ছাড় দিয়ে ও নানা ধরণের সুযোগ সুবিধা দিয়ে বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে, দেশি মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে প্রচুর পরিমাণের মুনাফা আয় করার পথ করে দেওয়া।

মোদী সরকারের বিগত চার বছরের কার্যকলাপে যদি সত্যিই কারুর লাভ হয়ে থাকে তাহলে তা হয়েছে আম্বানি, আদানি থেকে শুরু করে রামদেবের পতঞ্জলির। দেশের এক শতাংশ মানুষের কাছে আজ ভারতের ৭৫ শতাংশ অর্থ কুক্ষিত রয়েছে আর অন্যদিকে দেশের ছয়টি রাজ্যে আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চলের থেকে বেশি ক্ষুদার্থ মানুষ বাস করেন। ভারতের ৬০ শতাংশ মানুষের মাথাপিছু গড় যায় দিনে $১.০০ এর চেয়ে কম এবং অপুষ্টিতে ভারতের অধিকাংশ ০ থেকে ৫ বৎসর বয়সের শিশুরা ভুগছে। ভারতের ৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করলেও বছরের পর বছর কৃষির জাতীয় মোট গ্রাহস্থ্য উৎপাদে অবদান কমে যাচ্ছে এবং ১০ শতাংশের নিচে মানুষ কে কর্মসংস্থান দেওয়া পরিষেবা ক্ষেত্রের অবদান প্রায় ৫০ শতাংশের উপর রয়েছে, যার সিংহভাগ আসে তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের থেকে, যা জাতীয় স্বার্থে কোন সম্পদ সৃষ্টি করে না, বরং বিদেশী পুঁজির স্বার্থ রক্ষায় শ্রম ব্যয় করে। 
নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনের ইস্তাহারে জনগণ কে কথা দিয়েছিলেন যে তেলের দামের ভয়ানক কামড় থেকে তিনি জনগণ কে রক্ষা করবেন, রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে তো নয়ই, নিজের শহরে এবং গ্রামে মানুষ কিন্তু আজ তেলের ভয়ানক মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভীষণ ভাবে জর্জরিত। হিন্দু আজ সত্যিই বিপদে পড়েছে, হিন্দু সত্যিই “ক্ষত্রে মেইন হ্যায়” কারণ মোদী সরকারের তেল নিয়ে দিশাহীনতার কারণে আজ দেশের সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় ভীষণ সঙ্কটে পড়েছেন। এর উপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা মারার মতন ₹৯ করে ভর্তুকি-প্রাপ্ত সিলিন্ডারে এবং ₹৪২ করে ভর্তুকিহীন রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের চরম আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে এবং দেশের বেশির ভাগ জনগণ সেই লোকটিকে আজ পুরস্কৃত করতে চান যিনি “হিন্দু ক্ষত্রে মেইন হ্যায়” স্লোগান প্রথম তুলেছিলেন। 

অবশ্যই বড় বড় মাড়োয়ারি-গুজরাটি বেনিয়াদের, বড় অফিসে কাজ করা, গাড়ি চাপা সাহেব ও মেমসাহেবদের, সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটিদের, ফ্লপ বাজারি সিনেমার পরিচালক ও প্রাক্তন গায়ক ও কমেডিয়ানদের এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে কোন কষ্ট হবে না। তাঁরা বলবেন, বা বলা চলে কটাক্ষ করবেন, যে আপনার যদি তেল কেনার পয়সা না থাকে তাহলে গাড়ি বা স্কুটার-মোটরসাইকেল চড়বেন না, আপনার যদি গ্যাস কেনার সাধ্য না থাকে তাহলে আপনি বাড়িতে গ্যাসে রান্না করবেন না (কেরোসিন কিন্তু বন্ধ) আর আপনার যদি মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেশি অসুবিধা হযে থাকে তাহলে আপনি পাকিস্তান চলে যান। 

অথচ যেই প্রশ্ন উঠবে যে কৃষকেরা যে ট্রাক্টর চালাবার জন্যে তেল কিনতে অপারগ হচ্ছেন বা ফসল ও সবজি গ্রাম থেকে বাজারে বা থোক বাজার থেকে খুচরা বাজারে আনতে গাড়ি ভাড়া বেশি গুনতে হচ্ছে, তেমনি মোদী ভক্ত হনুমানের দল খা খা করে তেড়ে এসে বলবে যে কৃষকেরা দেশের বোঝা কারণ তাঁরা নাকি কর দেননা এবং দেশের সকল সুবিধা ভোগ করেন যা শুধু মাত্র বড় গাড়ি ঘোড়া চড়া, বাংলো বা ফ্ল্যাটবাড়িতে বাস করা সাহেব ও মেমসাহেবদের একচেটিয়া অধিকার হওয়া উচিত।

ফিরে আসি অর্থনীতির সমীক্ষায়। দেখতে পারবো বছরের পর বছর শুধু মাত্র পরিসংখ্যান আর পরিমাপের কারচুপি করে বিজেপি দেখাতে চাইছে যে মোদী সরকারের আমলে জনগণের এত কল্যাণ হয়েছে যা নাকি বিগত ছয় দশকে হয়নি। যেমন ধরুন জনধন যোজনায় জনগণের জন্যে ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলার দাবি। যদি আপনি একটু গভীরে ঢুকে দেখেন, তাহলে দেখবেন যে প্রায় ৩০ কোটির উপর যে ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলানো হয়েছিল এই যোজনায়, তার প্রায় ৩৩ শতাংশ বা ১০ কোটি একাউন্ট এ আজ অবধি কোন লেনদেন হয়নি। নোট বাতিল অবধি, অর্থাৎ ৯ই নভেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত, এই বাকি ২০ কোটি একাউন্টগুলিতে মোট ₹৪৫,৬৩৬ কোটি জমা ছিল এবং ২৮শে ডিসেম্বর ২০১৬ তে, নোট পরিবর্তনের সময়কালে এই একাউন্টগুলির মোট পরিমাণ হয় ₹৭১,০৩৬ কোটি। আয়কর বিভাগ ঘোষণা করেছিল যে তারা নাকি অনেক এমন একাউন্ট ফ্রিজ করে দিয়েছে যেগুলিতে অসামান্য পরিমানের লেনদেন হয়েছে। তবুও প্রায় ₹৪,৪৩০ কোটি টাকা এই একাউন্টগুলির থেকে বের হয়ে গেছে যা এক বৃহৎ অঙ্ক। 

এই একাউন্টগুলি নিয়ে প্রতিটি ব্যাঙ্ক এখন চিন্তিত এবং প্রায় সমস্ত ব্যাঙ্কগুলি এই জনধন যোজনার একাউন্ট খোলা এখন বন্ধ করে দিয়েছে কারণ নানা বিধিনিষেধ সম্বলিত এই একাউন্টগুলির রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেক। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মতে এই একাউন্টগুলির রক্ষণাবেক্ষণ খরচ প্রতি বছর প্রায় ₹৭৭৪.৮৬ কোটি। এর ফলে আজ আর গরিব মানুষের ব্যাঙ্ক একাউন্ট হচ্ছে না বরং যাদের হয়েছে তাঁদের একাউন্ট এর উপর এত বিধি নিষেধ চাপানো হয়েছে যে তাঁদের পক্ষে এই একাউন্ট এ টাকা রাখা অসাধ্যকর হয়ে উঠেছে। ফলে আখেরে এই ব্যাঙ্ক একাউন্ট করে লাভ কার হলো? কারা এই ব্যাঙ্ক একাউন্ট এ জমা টাকার ফলে সুবিধা লাভ করলো?

সরকারি সমস্ত ব্যাঙ্ক থেকে প্রচুর পরিমাণের ঋণ নিয়ে আজ বসে আছে বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা আর বৃহৎ ফাটকাবাজরা। ভারতের জনগণের টাকায় চলা সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে লগ্নি করা হচ্ছে শেয়ার বাজারে, বড় রিয়েল এস্টেট প্রকল্পে বা বিদেশে ব্যবসা বৃদ্ধির কাজে। বিজয় মালিয়া থেকে নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ নীরব মোদী ও মেহুল চোকসি হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ ফেরত না দিয়ে খুব সহজেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে এবং আজ আমাদের কর্পোরেট-মালিকানাধীন মূলধারার সংবাদ মাধ্যম এদের ফিরিয়ে এনে, এদের সম্পত্তি বিক্রি করে জনগণের টাকা ফেরত আনার কথা বলে না, বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা ফেরত আনার মোদীর প্রতিশ্রুতির কথা তো ভুলেই যান। যারা পালিয়েছে টাকা নিয়ে তারাই শুধু যে লাভ করেছে তাই নয়। ২০১৬ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট অনুসারে ২০১৫ সালে সরকারি ব্যাঙ্কগুলি একত্রে প্রায় ₹১৩০,০০০ কোটির বকেয়া ঋণ কে “ব্যাড লোন” বা অপুনরুদ্ধারযোগ্য ঋণ হিসেবে গণ্য করে নিজ খাতা থেকে মুছে ফেলেছে। জনধন যোজনার মাধ্যমে মোদী শুধু চেষ্টা করেছে ব্যাঙ্ক এর খাতায় বেশি করে টাকা ঢুকিয়ে এই লোকসানের বহর কে কৃত্রিম ভাবে কম করতে। 

অরুণ জেটলি বাবু পৃথিবীর সেই অল্প কয়েকজন দিগ্গজদের মধ্যে একজন, যাঁরা পেশায় উকিল হয়েও ভালো অর্থনীতিবিদ সাজার প্রচেষ্টা করে। যেমন উনার আগে একসময়ে বেদান্তের চাকুরে পি চিদাম্বরম করতেন। সেই অরুণ জেটলি বারবার সরকারি ব্যাঙ্কগুলি কে মূলধনের যোগান দিয়ে (recapitalisation) চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন যাতে  বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের সরকারি ব্যাঙ্কের থেকে পুনঃ ঋণ পেতে কোন অসুবিধা না হয় এবং বেশি বেশি অর্থ “ব্যাড লোন” বা অপুনরুদ্ধারযোগ্য ঋণের খাতে দেখানো যায়। অপুনরুদ্ধারযোগ্য ঋণের খাতে কোন বৃহৎ পুঁজিপতির ঋণ চলে যেতেই সেই ঋণ মাফ হয়ে যায় এবং সেই পুঁজিপতি সেই টাকা সোজা বাংলায় পুরোপুরি মেরে দেয়। 

জেটলি বাবুর কীর্তি এই করেই থামেনি, বরং “bail in” বা ব্যাঙ্কের অপুনরুদ্ধারযোগ্য ঋণের বোঝা কম করতে সাধারণ গ্রাহকদের জমানো খাতায় ব্যাঙ্ক কতৃপক্ষ কে থাবা মারার সুযোগ করে দিয়ে আম্বানি-আদানি বা বেদান্তের আগারওয়ালদের লুটের খেসারত সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপিয়েছেন। এই ভাবে সাধারণ মানুষের ক্ষতি যখন করা হচ্ছিল তখনই মুসলিম বিদ্বেষ তীব্র ভাবে ছড়ানো হচ্ছিল, সংবাদ মাধ্যম জুড়ে বিজেপি ও সংঘ পরিবারের নানা নেতার নানা সাম্প্রদায়িক বয়ানবাজি চলছিল, আর চলছিল দেশপ্রেমের ধুয়ো তুলে বিরোধীদের বিরুদ্ধে কুৎসা করা। কায়দা করে এই হাঙ্গামার মধ্যে দিয়ে মোদী সরকার জনগণ কে শূলে চড়ানোর বন্দোবস্ত করে রাখলো আর সংবাদ মাধ্যমও জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল। ফলে সাপও মরলো আর মোদীর লাঠিও ভাঙলো না।  

ফসল বীমার থেকে স্বাস্থ্য বীমার নানা যোজনা প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে বিপুল ঢাক ঢোল পিটিয়ে বাজারে ছাড়া হলো, অথচ এই সকল বীমা প্রকল্পেই কিন্তু বীমা কোম্পানিগুলিকে প্রচুর মুনাফা আয় করার রাস্তা করে দেওয়া হলো আর জনগণের জন্যে হাতে রইলো শুধু পেন্সিল। বিপুল অর্থের টাকা সরকারি কোষাগার থেকে জনস্বাস্থ্য বীমার জন্যে খরচ করা হচ্ছে আর আবার জনতার থেকেও সেই বীমার জন্যে টাকা নেওয়া হচ্ছে আর এই সকল অর্থ জমা পড়বে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোমে, যাদের মালিকানা আবার অনেক ক্ষেত্রেই সেই বীমা কোম্পানিগুলির মালিক গোষ্ঠীর হাতেই রয়েছে। 

মোদী কেয়ার নামক যে স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প অরুণ জেটলি কংগ্রেস আমলের স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পকে নতুন ভাবে সাজিয়ে পেশ করেছেন, তাতে ৫০ কোটি মানুষ কে স্বাস্থ্য বীমার অধীনে আনা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার পরেই কিন্তু স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানিগুলির শেয়ারের দাম হুহু করে বেড়ে যায়। প্রতি বছর  মাথা পিছু প্রায় ₹২২০ করে খরচ করে যে বৃহৎ বীমা প্রকল্প সরকার জনগণের করের টাকা দিয়ে গড়ে তুলতে চাইছে, সেই অর্থ কে সঠিক ভাবে ব্যবহার করে যদি সরকারি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা কে সক্রিয় করে তোলা যেত, যদি সেই অর্থে সরকারি হাসপাতালগুলির পরিকাঠামো, সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিকাঠামো ও মেডিক্যাল কলেজগুলির পরিকাঠামো কে সঠিক ভাবে উন্নত করা যেত, তাহলে ভারতবর্ষের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশ্বের শ্রেষ্ঠদের তালিকায় জায়গা করে নিতে পারতো। 

স্বাস্থ্য খাতে মোদী সরকার প্রতি বছরের বরাদ্দে কোন বিশেষ বৃদ্ধি করেনি এবং রাজ্যে রাজ্যে এইমস গঠন করে সেরা স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার যে বন্দোবস্ত প্রাক্তন সরকার করেছিল, সেই খাতে কোন বিশেষ পদক্ষেপ মোদী সরকার নেয়নি। জনগণের স্বাস্থ্য কে বেসরকারি হাঙ্গরদের হাতে ছেড়ে দিয়ে, ওষুধ ও জরুরী পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচের উপর কোন সঠিক সিলিং না বসিয়ে, মোদী সরকার জনগণ কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। হোমিওপ্যাথি, উনানী, আয়ুর্বেদিক ও অন্যান্য বিজ্ঞান অসম্মত ধারার চিকিৎসা পদ্ধতির উপর বেশি জোর দিয়ে এলোপ্যাথি চিকিৎসার উপর খাঁড়ার ঘা মারা হয়েছে মোদী সরকারের আমলে। 

চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল আরও খারাপ করতে এবার মোদী সরকার উনানী, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের মাত্র এক বছরের ব্রিজ কোর্স করিয়ে এলোপ্যাথি চিকিৎসা করতে অনুমোদন দেবে এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, এর ফলে রোগীরা ভীষণ সঙ্কটে পড়বেন, কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক ধারা থেকে এসে এলোপ্যাথি কোন ভাবেই এক বছরের মধ্যে কেউ রপ্ত করতে পারবে না এবং তৈরি হবে প্রচুর সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত হাতুড়ে ডাক্তার। যেহেতু গ্রামে গঞ্জে ও শহরের শ্রমিক মহল্লায় বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও দলিত-আদিবাসী অঞ্চলে এই চিকিৎসকদের সংখ্যা শ্রেণী ও জাতিগত কারণে বেশি তাই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় এই সমস্ত শ্রেণীর ও সম্প্রদায়ের মানুষেরাই পড়বেন। 

হেঁসেলের কথা আগেই হয়ে গেছে, আর বলা হয়েছে তেলের মূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে। যেটা উপরে বলিনি সেটা হলো যে ক্ষমতায় এসে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম হতে থাকার সুফল কিন্তু জনতা কে দিতে চাননি নরেন্দ্র মোদী। বলেছিলেন যে তেলের দাম বেশি রাখা হয়েছে কারণ সরকার নাকি একটি করপাস তহবিল তৈরি করছে লাভের টাকা দিয়ে, যে অর্থ নাকি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পেলে ভর্তুকি হিসেবে ব্যবহার করে দেশের জনগণ কে তেলের দামের আগুন থেকে বাঁচাতে ব্যবহার করা হবে। 

অথচ আজ যখন আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে  $৮০ প্রতি ডলার, তখন সেই করপাস তহবিলের টাকা কোন নেপোয় মেরেছে সেই প্রশ্ন চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। অয়েল ইন্ডিয়া কর্পোরেশন এর মতন বৃহৎ তেল বিক্রির কোম্পানিগুলি কিন্তু চরম মুনাফা করছে আর মোদী সরকার তেলের উপর থেকে কোন কর কমানোর কথা কল্পনাতেও আনতে চাইছে না, কারণ সরকারের মতে যদি ₹১ কর কমানো হয় তাহলে সরকারি তহবিলে ₹১৩,০০০ বাৎসরিক ঘাটতি হবে। যে জিএসটি কে নিয়ে এত নাচ গান, এক দেশ - এক করের এত মহিমা ও গুণগান গাওয়া হলো, সেই জিএসটির অন্তর্গত কিন্তু তেল কে করা হচ্ছে না আর তার কারণ সরকার নিজের তহবিলে এক পয়সাও ঘাটতি হতে দিতে চায়না, তাতে যদি জনগণের পকেটে আগুন লাগে, তাহলে তাই হোক।

তেলের দামের উপর কর যে ভাবে চাপানো আছে তাতে তেলের দাম বাড়লে যদিও সরকারের বিদেশ থেকে আমদানি করার খাতে খরচ বেড়ে যায়, সরকারের আয়ও কিন্তু বেড়ে যায় কারণ ক্রেতা যে হারে পেট্রোল বা ডিজেল ক্রয় করেন সেই দামের ৪৯ শতাংশই আসলে কর। এই ঘাড় মটকে আদায় করা টাকা দিয়ে পুলিশ-মিলিটারি পোষা হয় জনগণের উপর লাঠি-গুলি চালানোর জন্যে, এই অর্থেই বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে চুরি করা অর্থের ঘাটতি মেটানো হয়, এই অর্থ দিয়েই বৃহৎ বীমা কর্পোরেশনগুলির মুনাফার পাহাড় বাড়ানো হয়। এই করের টাকা দিয়েই কিন্তু ভারতের বৈদ্যুতিন মাধ্যম থেকে সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় মোদী সরকার নিজের দামামা বাজিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়, কোটি কোটি টাকা খরচ করে মন্ত্রী-সান্ত্রীদের রাজকীয় জীবনযাপন করায়। 

তেলের দামের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে আজ যখন এশিয়ার দেশগুলি বিপুল হারে ভর্তুকি দিয়ে একটি মূল্য-নির্ধারণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে, মোদী সরকার ও তার ভক্তরা কিন্তু কোন ভাবেই বাজারের হাত থেকে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে একটি মূল্য নির্ধারক কমিটির উপর ছেড়ে দিতে পারছে না, কারণ আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগে অটল বিহারি বাজপেয়ীর সরকার এমনই এক প্রাইজ কন্ট্রোল মেকানিজম কে শেষ করে বাজারি শক্তির হাতে, অর্থাৎ বৃহৎ তেল কর্পোরেশনগুলোর হাতে, ভারতের বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার ছেড়ে দেয়। বিশ্ব ব্যাঙ্ক-আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার-বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কে চটিয়ে সেই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার মুরোদ মোদী সরকারের নেই, শুধু মোদী ভক্তদের মুরোদ আছে এই দাবি কে সমাজতন্ত্রী বলে গালাগাল করার এবং আসল ইস্যুর থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার। 

মোদী সরকার ভারতবর্ষের উপর চেপে বসা একটি জোঁক, যার মাধ্যমে ভারতের জনগণের, শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে আম্বানি-আদানি-টাটা-বেদান্ত থেকে শুরু করে বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি। মোদী সরকারের ঘাড়ে চেপেই কৃষকের ঘাড় মটকাচ্ছে জোতদার আর জমিদারেরা, ভারতবর্ষকে নিজেদের সামরিক ঘাঁটি বানাচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, জায়নবাদী ইজরায়েল ও সাম্রাজ্যবাদী-ফ্যাসিস্ট জাপানিরা। আজ ভারতের সার্বভৌমত্ব বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই, কারণ নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির স্বার্থে সার্বভৌমত্ব কে জলাঞ্জলি দিয়েছে শাসকশ্রেণী এবং ভারতবর্ষ কে পরিণত করেছে সাম্রাজ্যবাদী লুটেরাদের স্বর্গরাজ্যে। 

২০১৯ সালের নির্বাচনে মোদী হারবে কি হারবে না সেটা আজ বড় রাজনৈতিক প্রশ্ন নয়। বিশেষ করে যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সাথে যুক্ত, তাঁদের ভেবে দেখতে হবে যে কোন এমন সরকার ভারতে নির্বাচনী পথে বিরোধীরা স্থাপন করতে পারবে যা মোদী সরকারের চাপানো জনবিরোধী অর্থনৈতিক নীতিগুলি কে খারিজ করে দেবে? আসলে এমন কোন সরকার আজ নির্বাচনী পথে সম্ভবই নয়, কারণ যে কোন সংসদীয় দলই আজ নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির, বিশ্ব ব্যাঙ্ক-আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার-বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার পদলেহী দালাল। 

ভারতের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা নিজেদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রভূত উন্নয়ন দেখেছে বিগত ২৫ বছরের নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির কারণে। আজ যদি ভারতে এক প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হয় তাহলে সেই সরকার কে আসলে হতে হবে এই নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির বিরোধী, সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এক সরকার যা ক্ষমতার ভরকেন্দ্র কে সরিয়ে আনবে জনগণের হাতে আর সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অর্থনীতি কে গড়ে তুলবে। কৃষকদের কৃষি সমস্যার সমাধান করবে সেই সরকার, করবে শ্রমিকদের প্রকৃত কল্যাণ, যা হলো সমস্ত বৃহৎ শিল্পের উপর সামাজিক মালিকানা স্থাপন। একমাত্র এই পথেই শুধু আমাদের দেশকে অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে উদ্ধার করা সম্ভব এবং এক উন্নত দেশে, ধর্ম নিরপেক্ষ, পরমত এবং পরধর্ম সহিষ্ণুতার আদর্শ ভূমিতে পরিণত করা সম্ভব। 

এই লক্ষ্য ততদিন পুরো হতে পারবে না যতদিন আমরা আমাদের মুক্তি খুঁজবো পার্লামেন্টের আসনের গণিতে, বিভিন্ন জোটের দেওয়া-নেওয়ার হিসেবে, বিভিন্ন সংগঠনের পদ নিয়ে দর কষাকষির মধ্যে। আমাদের দেশের শত্রু হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ, যার চূড়ামণি হচ্ছে মোদী সরকার ও যার পৃষ্টপোষক হচ্ছে জোতদার-জমিদার, বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা, শহুরে উচ্চবিত্তরা ও বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি; আর এই ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করতে গেলে জনগণ কে টেনে আনতে হবে গণ সংগ্রামের রণভূমিতে। জনগণ কে শিক্ষিত করে তুলতে হবে এবং তাঁদের লড়াইয়ে আগুয়ান বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তাঁরা একত্রে, ঐক্যবদ্ধ ভাবে, ক্ষেতে-খামারে-কারখানায় আর রাজপথে লড়াই করে ক্ষমতার থেকে ছুড়ে ফেলতে পারে শাসকশ্রেণী ও তার পদলেহী হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের। একমাত্র জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামই আজ দেশের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ-ধর্মীয় বিদ্বেষ ও অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্ত হওয়ার চাবি কাঠি।      

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে