৩৭০ ধারা বিলোপ, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান নাকি আন্দোলনের নবজাগরণ?

বুধবার, আগস্ট ০৭, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


জঙ্গী হামলা হওয়ার আগাম খবর আছে, তাই নাকি ছাত্র, পর্যটক সহ সমস্ত বহিরাগতদের কাশ্মীর ছাড়ার নির্দেশ দিল নরেন্দ্র মোদী'র নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার। বন্ধ করে দেওয়া হলো হিন্দুদের পবিত্র অমরনাথ তীর্থ যাত্রা, যার উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কাশ্মীরী মানুষ। বন্দুকধারী বাহিনী আর কাঁটাতার দিয়ে আরো বেশী ছেয়ে দেওয়া হল কাশ্মীর। বন্ধ করে দেওয়া হল ফোন, মোবাইল সংযোগ, ইন্টারনেট এর মত সমস্ত যোগাযোগের মাধ্যম।  ঠগীর কাছে বোকা বনে গিয়ে নির্মল আনন্দ উপভোগ শুধুমাত্র নির্বোধ ভক্ত ছাড়া আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। সুতরাং কাশ্মীরিরা বিশ্বাস করল না কেন্দ্র সরকার’কে। তাঁরা আশংকা করল গোটা কাশ্মীর কে বন্দুকের নলের মুখে দাঁড় করিয়ে, কাঁটাতার দিয়ে বেঁধে বিলোপ ঘটানো হবে সংবিধানের ৩৭০ ধারা।

শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে কাশ্মীরীদের আশংকাই সঠিক প্রমাণিত হল। মিথ্যা প্রচারে সেনা আধিকারিকদের ব্যবহার করল বিজেপি সরকার, দেশের জনতাকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার গল্প শুনিয়ে সন্ত্রস্ত করে তাড়াতাড়ি  সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হলো । কাশ্মীরের জনগণ বা স্বাধীনতাকামী হুরিয়াত কনফারেন্স দূরে থাক, ভারতপন্থী নির্বাচিত কাশ্মীরী নেতাদের সাথেও কোনো রকম মতামত বিনিময় হল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছিলেন যে কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ ফারুক আবদুল্লাহ নিজের ইচ্ছায় পার্লামেন্ট আসেননি। তারপর ফাঁস হল যে তাঁকে গৃহবন্ধী করে পার্লামেন্টে আসতে দেয়নি সরকার।  


এই  সরকারি গণ প্রতারণা প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করল যে নাগরিকদের  দ্বারা নির্বাচিত বলে দাবি করা হয় এমন সরকার আদৌ তার নাগরিকদের সম্মান করে কিনা? মধ্য যুগের রাজা জমিদারদের আমলের মতন রাষ্ট্র জনগণের ঊর্ধ্বে নাকি রাষ্ট্র হল জনগণকে সেবা করার সংস্থা? জাতিসত্তাগুলো তাদের ভাগ্য ও জীবনযাপনের সাথে জড়িয়ে থাকা সিদ্ধান্ত সমুহ নিজেরা নেবে নাকি বাইরের কোনো শক্তি তাদের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে?  ভারতপন্থী বা ভারত বিরোধী সমস্ত কাশ্মীরি নেতাদের গ্রেফতারী আর সমগ্র কাশ্মীর জুড়ে কার্ফু জারি করে নাগরিকদের আটক করে রাখার মধ্যে দিয়ে কি এইটা প্রমাণ হল না যে কাশ্মীরের কোনো অংশের মধ্যেই সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে জন সমর্থন নেই? জনমত ছাড়া সিদ্ধান্ত চাপিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক আগ্রাসন ভিতরে এবং বাইরে সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠন করবে না কি?  


নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের মতো ৩৭০ ধারা বিলোপে উচ্ছ্বসিত হয়েছে হিন্দুত্ববাদী উগ্রজাতীয়তাবাদীরা।  তারা প্রশ্ন করছেন কাশ্মীর কেন বিশেষ সুবিধা পাবে? কিন্তু তারা এই প্রশ্ন করছেন না যে বাকি প্রদেশগুলোও কেন ঐ সুবিধাগুলো পাবে না! ৩৭০ ধারা নিয়ে নানা মুনির নানা মত (কাশ্মীরী মানুষদের বাদে) থেকে পৃথক করে বস্তুগত ভাবে বর্তমান সংকট কে বুঝতে সংক্ষেপে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক আধুনিক কাশ্মীরের ইতিহাস ও  ৩৭০ ধারার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর।         


১৮৪৬ সালে প্রথম ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধে  শিখরা ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়। ব্রিটিশদের দাবি মত যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ দেড় কোটি টাকার পুরোটা দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় শিখেরা জম্মুর হিন্দু ডোগরা শাসক  গুলাব সিংহ কে কাশ্মীর বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। ডোগরা হিন্দু শাসকরা যেহেতু জম্মুতে বসে কাশ্মীর শাসন করতেন, তাই জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের উদ্ভব। ডোগরা শাসকরা ব্রিটিশ শাসকদের সম্মানজনক নজরানা পাঠাবে এবং ব্রিটিশরা জম্মু ও কাশ্মীরের শাসক হিসেবে ডোগরা শাসকদের স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা দেবে, এই ছিল বোঝাপড়া। ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার আগে এরকম ৫৬২ টা দেশীয় রাজ্য ছিল, যেগুলো সরাসরি ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনের আওতায় ছিল না। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীর ছিল বৃহত্তম। 


১০০ বছরের ডোগরা শাসন কাশ্মীরী চাষীদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। সাধারণত রাজা বা সামন্তপ্রভুরা যেমন হয় আর কি। কাশ্মীরে করের বোঝা বরাবরই মাত্রাতিরিক্ত ছিল, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল স্বৈরতান্ত্রিক অত্যাচার। সামন্ত মহাজনরা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন উচ্চবর্ণ হিন্দু আর গরিব কৃষক কারিগরেরা মুসলমান। জি এন কাউল এর রচনায়, ১৯২০ সালের কাশ্মীরী সমাজের যে বিবরণ পাওয়া যায় সেখান থেকে জানা যায় যে অন্ততঃ ৯০ শতাংশ মুসলমানের বাড়ি হিন্দু মহাজনের কাছে বন্ধক পড়ে ছিল।  ১৯৪৭ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৭৭% ছিলেন মুসলমান। আর কাশ্মীর উপত্যকার ৯৩% মানুষ ছিলেন মুসলমান। ফলে শ্রেণী শোষণে যারা পিষ্ট হচ্ছিল সেই কাশ্মীরী শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা গরিষ্ঠই কিন্তু মুসলমান ছিলেন। 


জম্মু ও কাশ্মীরে ডোগরা রাজবংশ, জায়গিরদার, মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনের এক বড় ঐতিহ্য আছে। যেটা জোরদার হতে থাকে বিংশ শতাব্দী’র তিনের দশক থেকে। শেখ আবদুল্লাহ’র নেতৃত্বে কাশ্মীরে সামন্তবাদ-বিরোধী ব্যাপক ভূমি সংস্কার তারই প্রতিফলন। ব্রিটিশ শাসকেরা যে ভারত ছেড়ে চলে যাচ্ছে এই খবর ১৯৪৬ সাল নাগাদই হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছিল। যেহেতু ব্রিটিশরা নজরানার বিনিময়ে রাজাকে নিরাপত্তা প্রদান করত তাই ব্রিটিশ শাসন  শেষ হওয়ার আভাস পেয়ে কাশ্মীরে শুরু হয় রাজতন্ত্র বিরোধী "কাশ্মীর ছাড়ো" আন্দোলন। পুঞ্চ অঞ্চলের কৃষকরা রাজা গুলাব সিংহ’র আমল থেকেই বিদ্রোহ করে এসেছে। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, পুঞ্চ অঞ্চলের কৃষক অভ্যুত্থান সংগঠিত আকার ধারণ করে, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে রাজা হরি সিংহ’র অত্যাচার। এর আগে বার বার কাশ্মীরে হিন্দু মৌলবাদীদের সাথে জিন্নাহ পর্যন্ত রাজা হরি সিংহ কে চোখ বন্ধ করে সমর্থন করে এলেও ,পুঞ্চের এই বিদ্রোহের সময় পাকিস্তান তার নীতি বদল করে। 


১৯৪৭ সালের ২৪ অক্টোবর পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের  এক বিরাট সংখ্যক “উপজাতি” জঙ্গী বাহিনী কাশ্মীর আক্রমণ করে। আর এই হামলাকারিদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় পুঞ্চের জনতা। পাকিস্তান’ও অঘোষিত ভাবে সেনা বাহিনী পাঠিয়ে দেয় হামলাকারী ও বিদ্রোহীদের সাথে।  রাজা বিপাকে পড়েন এবং নব্যগঠিত ভারত রাষ্ট্রের কর্ণধার নেহরু ও প্যাটেলের কাছে সাহায্য চান। সাহায্যের বদলে ভারত কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি দাবি করে আর চাপে পড়ে হরি সিংহ তা মেনে নেন। ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭ এ জম্মু ও কাশ্মীর এবং ভারত সরকারের মধ্যে Instrument of Accession চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মুল কথা হল এই যে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, ও যোগাযোগ, এই তিনটে ক্ষেত্রে  জম্মু ও কাশ্মীর সরকার ভারতের কর্তৃত্ব মেনে নেবে। কিন্তু এই চুক্তি চূড়ান্ত হবে জম্মু ও কাশ্মীরে গণভোটের পর। 


সেই দিনই কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা পৌছলে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে শেখ আবদুল্লাহ’র ন্যাশনাল কনফারেন্স এর স্বেচ্ছাসেবকরা। ১৯৪৭ সালের ২ নভেম্বর, নেহরু তার বেতার ভাষণে কাশ্মীরের ভারত ভুক্তির বিষয়টি কাশ্মীরের মানুষের গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে বলে ঘোষণা করেন। ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি নেহরু রাষ্ট্র সংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীরে গণভোটের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। নেহরুর গণভোট সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ৬ জানুয়ারি নিরাপত্তা পরিষদে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে, ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্র সংঘ কাশ্মীরে গণভোট সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে তাতে ভারত এবং পাকিস্তান উভয় গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারনের বিষয়টি মেনে নিয়েছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত রাষ্ট্র সংঘ কাশ্মীরের গণভোট নিয়ে অন্তত আটটি প্রস্তাব নিয়েছে। এমনকি ১৯৪৮ সালের ১১ ডিসেম্বর গণভোট সংক্রান্ত রূপরেখা তৈরি হওয়ার পর, ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে। যদিও সেই গণভোট আজও করা হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্র সংঘে ভারতীয় প্রতিনিধি ঘোষণাই করে দিলেন যে কোন অবস্থাতেই তার সরকার গণভোট করাতে রাজি নয়।


১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের সংবিধান সভা ভারতীয় সংবিধানের  ৩০৬-এ ধারা যুক্ত করে জম্মু ও কাশ্মীরের আভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়। একই সাথে বলা হয় যে যতদিন না পর্যন্ত গণভোটের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ  তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ না করেন ততদিন পর্যন্ত বিষয়টি Interim System হিসেবে থাকবে। পরবর্তী কালে ভারতের নবগঠিত সংবিধানে এই ৩০৬এ ধারাটি নতুনভাবে ৩৭০ ধারা হিসেবে যুক্ত হয়। কিন্তু এই ৩৭০ ধারায়  গণভোটের বিষয়টি কে হাপিস করে দেওয়া হয়, ধীরে ধীরে ৩৭০ ধারাটি কে সংশোধনের মাধ্যমে প্রায় বিলুপ্তির পথে নিয়ে গিয়েছে ভারত সরকার।  


৩৭০ ধারার খসড়া দেখার পর শেখ আবদুল্লাহ অসম্ভব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কারণ এ ছিল স্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা। এই সময় থেকে আবার শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরের গণভোট ও কাশ্মীরের স্বাধীনতার কথা তুলতে থাকেন এবং ব্যাপক জনসমর্থন পেতে থাকেন। ১৯৫৩ সালে ভারত সরকার রাজা হরি সিংহ’র পুত্র কাশ্মীরের সদর-ই-রিয়াসত করণ সিংহ’কে দিয়ে কাশ্মীরের জননেতা শেখ আবদুল্লাহ কে গ্রেপ্তার করান। শেখ আব্দুল্লাহ’র মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে কাশ্মীর, নির্মম অত্যাচারে এই আন্দোলন দমন করা হয়। পুলিশের গুলিতে অন্তত ৬০ জন কাশ্মীরী প্রাণ হারান। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৮ সালের বেশিরভাগ সময়টাতেই শেখ আবদুল্লাহ জেলে কাটান।  শেখ আব্দুল্লাহ’র সাথে তার সহকর্মী মির্জা আফজল বেগও জেলে ছিলেন। রাষ্ট্র সংঘের মানবধিকার সনদকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এই দুজনকে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়, কোন অপরাধেই এদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। এর পর দমনের মুখে পুরানো নেতাদের পালটি খাওয়া তাদের জনবিচ্ছিন্ন হওয়া, নতুন প্রজন্মের নেতাদের আবির্ভাব, বামপন্থী সশস্ত্র সংগ্রামী মকবুল ভাটের উত্থান, সেকুলার সশন্ত্র স্বাধীনতাকামী দল হিসেবে জম্মু ও কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের উত্থান তারপর প্রচন্ড দমনের মুখে পড়ে গান্ধীবাদী স্বাধীনতাকামীতে পরিণত হওয়া, স্বাধীনতা সংগ্রামকে হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত করার ভারতীয় প্রচেষ্টা বা ভারতের প্রতি ঘৃণাকে পাকিস্তানের কাজে লাগানো, পন্ডিতদের ইস্যু এই সব নিয়ে বিস্তারিত লেখার অবসর আপাতত নেই।


বলরাজ পুরি, আয়লাস্টে ল্যাম্ব প্রভৃতি সমাজবিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিকদের মতে, প্রথমেই গণভোট হয়ে গেলে কাশ্মীর ভারতের দিকেই আসত। তার একটা বড় কারণ জননেতা শেখ আবদুল্লাহ । যিনি “বন্ধু” নেহরু’র প্রভাবে নিজের দলের নাম মুসলিম কনফারেন্স পাল্টে ন্যাশনাল কনফারেন্স করেছিলেন, ইসলামিক রাষ্ট্রের বদলে “সেকুলারিজম” এ তাঁর ঝোঁক ছিল বেশী। তা ছাড়া পাকিস্তানের সাথে বা পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জনতার সাথে পাঞ্জাবী মুসলমানদের সংস্কৃতিগত মিল থাকলেও এই পাড়ের কাশ্মীর, যেখানে শেখ আব্দুল্লাহ’র প্রভাব ছিল, সেখানে বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, সুফি মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত ইসলাম বিরাজ করতো। তাছাড়া নিরাপত্তার জন্য ভারতের ছত্রছায়া তাদের মেনে নিতে কোন সমস্যা ছিল না।   কিন্তু আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজি ও ভারত সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলোনা রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন যুক্তরাষ্টীয় কাঠামো। শেখ আব্দুল্লাহ’র কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী (মুখ্যমন্ত্রী নয় কিন্তু) হওয়ার পর বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারের হাত থেকে জমি বাজেয়াপ্তকরণ ও ব্যাপক ভূমি সংস্কার আতংকিত করে শাসক শ্রেণীকে। প্রতিরক্ষা পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ছাড়া সমস্ত ক্ষমতা যদি রাজ্যের হাতে থাকে তবে ঐ রাজ্যে উঠতি ব্যবসায়ীদের হাতে ক্ষমতা আসার সম্ভবনা তৈরি হয়, তারা নিজেদের হাতে প্রদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে সুবিধা অনুযায়ী আইন পাস করে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল বৃহৎ পুঁজিপতিদের শোষন প্রক্রিয়ায় বাধা দান করতে পারে। অন্যান্য রাজ্যগুলোও তখন পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চাইবে। প্রদেশের সম্পদের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে ঐ অঞ্চলে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রন। আঞ্চলিক পুঁজিবাদের বিকাশ হবে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে  অবাধ শোষনের জন্য তৈরি নয়া উপনিবেশিক কাঠামো তথা অতি বৃহৎ পুঁজি।        


 ভারতীয় বলে কোনো জাতি হতে পারে না। ভারত বহু জাতিসত্তার দেশ। ফলে ক্ষমতাশালী কেন্দ্র সরকারের বদলে অধিক ক্ষমতাশালী রাজ্য সরকারগুলোই জাতিসত্তাগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক বিকাশ ঘটাতে পারে। উল্টো দিকে, ভারতে প্রভাবশালী পশ্চিম ভারতের গুজরাটী, মারোয়াড়ি, পারসি পুঁজিপতিদের প্রয়োজন হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত  এক-কেন্দ্রিক শক্তিশালী কেন্দ্র সরকার। অতীতে পশ্চিম ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের এই আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করতেন মোহনদাস গান্ধী’র নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস নেতৃত্ব। অন্যদিকে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বাংলায় চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষ চন্দ্র বসু সহ বিভিন্ন প্রদেশের কংগ্রেস নেতৃত্ব। পরবর্তীকালে গুজরাটী-মাড়োয়ারী মুৎসুদ্দিরা গড়ে তোলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, হিন্দু মহাসভার মত দলকে যারা আভ্যন্তরীণ গোলযোগ ছাড়াই উগ্রভাবে তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করবে।   


৩৭০ ধারা বিলোপ কাশ্মীরী জনতাকে আরো বেশী ভারত সরকার  বিরোধী অবস্থানে ঠেলবে সন্দেহ নেই। দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতাকামী নেতারা শুধু নয়, ভারতপন্থী মূলধারার কাশ্মীরী নেতারাও এবার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। এই আগ্রাসন ভারতপন্থী বা নরমপন্থী কাশ্মীরী নেতাদের রাজনৈতিক ভাবে বিপন্ন করলো। কেন্দ্রীয় সরকারের এককেন্দ্রিক আগ্রাসন শুধু কাশ্মীর নয় দক্ষিণ ভারতের জাতিসত্তাগুলোর মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি করছে।  বন্দুকের নলের ডগায় ঐক্য সম্ভব নয়, ঐক্য সম্ভব বিচ্ছিন্নতার অধিকার সহ সমস্ত জাতিসত্তা'র সহমত ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে।               

জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে ভারতের জুয়া খেলা চলছে

মঙ্গলবার, আগস্ট ০৬, ২০১৯ 0 Comments A+ a-



ভারতের শাসকশ্রেণীর বিশ্বস্ত দালাল ও ফ্যাসিবাদী নরেন্দ্র মোদী’র সরকার কাশ্মীরের উপর নগ্ন সামরিক শাসন জারি করে, কাশ্মীরি জনগণ ও তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের, এমন কী ভারতের প্রতি বিশ্বস্ত সব দালাল রাজনৈতিক নেতাদেরও, গৃহ বন্দী করে ঘোষণা করল যে ভারতের সংবিধানের ধারা ৩৭০ ও ৩৫এ, যা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শাসকশ্রেণী একদিন কাশ্মীর কে ভাঁওতা দিয়ে অধিগ্রহণ করার সময়ে মেনে নিয়েছিল, খারিজ করা হচ্ছে। সংসদে হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের পান্ডা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) সংসদীয় গণসংগঠন ভারতীয় জনতা পার্টি’র (বিজেপি) নিজের সংখ্যাগত জোর খাটিয়ে এই প্রস্তাব পাশ করায়। ধারা ৩৭০ বাতিল করতে রাষ্ট্রপতির বিজ্ঞপ্তি জারি করে মোদী সরকার, কারণ এ ছাড়া কোন ভাবেই ধারা ৩৭০ কে বাতিল করা সম্ভব ছিল না। অথচ ধারা ৩৭০ বিলোপ করতে রাষ্ট্রপতির প্রয়োজন ছিল জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভার সেই বিষয়ে পাশ করা প্রস্তাব। তবে যেহেতু কাশ্মীরে পুতুল সরকার রাখারও সাহস বিজেপি ও মোদী সরকার বিগত এক বছর ধরে করতে পারেনি, যেহেতু নির্বাচনের নামে চূড়ান্ত সামরিক প্রহসন দিয়ে তথাকথিত গণতন্ত্রের ধ্বজ্জা আর তাঁরা তুলে রাখতে পারেনি, তাই বিধানসভা কে বাদ দিয়ে মোদী’র দ্বারা প্রেরিত রাজ্যপাল তথা প্রাক্তন বিজেপি নেতা সত্যপাল মালিকের প্রস্তাবই যথেষ্ট বলে গণ্য করে রাষ্ট্রপতি’র বিজ্ঞপ্তি জারি করা হল। আর এই চূড়ান্ত রকমের অসাংবিধানিক কাজে কিন্তু উগ্র দেশপ্রেমের ও ইসলাম-বিদ্বেষের বন্যা বইয়ে সমর্থন হাসিল করলো দাঙ্গাবাজ ও খুনের আসামী থেকে দেশের গৃহ মন্ত্রী হওয়া অমিত শাহ।

যে সংবিধান কে চোখের মণির মতন শাসক শ্রেণীর দালালেরা রক্ষা করার কথা বলে, তাদের কেউই কিন্তু এর বিশেষ প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করলো না, পাছে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সাবর্ণ হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কে ধাক্কা লাগে। তাই দলিত রাজনীতি’র তথাকথিত প্রতীক সেজে শোষিত জাতির মানুষ কে ঠকিয়ে কার্যসিদ্ধি করা বহুজন সমাজ পার্টি হোক বা দিল্লির তথাকথিত মোদী-বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, কংগ্রেসের জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া হোক বা নবীন পট্টনায়েকের বিজু জনতা দল, সবাই দল বেঁধে মোদী ও শাহের দ্বারা এভাবে দেশের সংবিধানের শ্লীলতাহানির পক্ষেই জোট বেঁধে দাঁড়াল। 

মোদী’র মোসাহেবদের দিয়ে ও তাঁর ঢোল বাদক মূল ধারার সংবাদমাধ্যমকে দিয়ে জনগণ কে বোঝানো হল যে এই সিদ্ধান্তের ফলে কাশ্মীর সমস্যা নাকি চিরকালের জন্যে মিটে গেল, কাশ্মীরের নাকি এবার শান্তি ফিরবে আর পাকিস্তানের অবস্থা নাকি কাহিল হবে। কাশ্মীর নিয়ে উগ্র ইসলামবিদ্বেষের শিকার হওয়া মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজ ও অনেক গরীব, খেটে খাওয়া শোষিত জনজাতির মানুষও এই প্রচার কে চিরন্তন সত্য মেনে মোদী বন্দনায় রত হলেন। ভারতের শাসকশ্রেণীর মুসলিম-বিদ্বেষী প্রচার ও তার সাথে সাথে সংবাদমাধ্যম, সিনেমা প্রভৃতিতে কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রাম কে কুৎসিত ভাবে চিত্রিত করার মধ্যে দিয়ে শুধু কাশ্মীর বা পাকিস্তান নিয়ে না, ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মধ্যে মুসলিমদের সম্পর্কেও একটি ভ্রান্ত ধারণা দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করা হয়েছে। মোদী ও বিজেপি তারই ফসল। এই ঘৃণার উপর ভিত্তি করেই মোদী সরকার আজ দেশের হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল, প্রতিক্রিয়াশীল ও উচ্চবর্ণের সামন্তপ্রভু ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের এক ছাতার তলায় এনেছে। এই ঘৃণার উপর ভিত্তি করেই আজ দেশের কোনায় কোনায় সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানো হচ্ছে, সংখ্যালঘু মুসলিমদের হয় গরু খাওয়ার নামে না হয় “জয় শ্রী রাম” নামক ফ্যাসিবাদী স্লোগান দেওয়ার বাহানা করে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। 

কাশ্মীর নিয়ে এই মুহূর্তে সবাই কথা বলছে। গুজরাটে কথা হচ্ছে, মহারাষ্ট্রে কথা হচ্ছে, দিল্লি-মুম্বাই-কলকাতা-চেন্নাই সব বড় শহরে আলোচনা হচ্ছে। সবাই নিজের মতামত ও পাল্টা মতামত রাখছেন শুধু কাশ্মীরি জনগণ কে বাদ দিয়ে। তাঁদের কথা বলার অধিকার নেই। তাঁদের জীবনের ব্যাপারে পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিচ্ছে একদল হিন্দি-গুজরাটি ভাষী দাঙ্গাবাজেরা অথচ সেখানে তাঁদের স্থান নেই কারণ “বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ” কাশ্মীরিদের দরজায় তালা দিয়ে সেখানে রাষ্ট্রের সান্ত্রী কে অটোমেটিক রাইফেল হাতে দাঁড় করিয়ে কাশ্মীরি জনগণের ফোন, টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেট প্রভৃতি বন্ধ করে তাঁদের স্বার্থে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কাশ্মীরি জনগণ কাশ্মীর নিয়ে কোন কথা বলবে না এই গণতন্ত্রে এটাই দস্তুর। কাশ্মীর কী খাবে, কী পড়বে, কাকে ভালোবাসবে তা ঠিক করবে দিল্লি, মুম্বাই বা আহমেদাবাদ। এটাই গণতন্ত্রের মহত্ব।  

যে ভাবে একদিন ডাহা মিথ্যা কথা বলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সংস্থা USAID এর দেখানো পথে নোট বাতিল করা হয়েছিল দেশপ্রেমের তুলসীপাতা বাটা খাইয়ে, যেমন একদিন বেড়ে চলা বেকারত্ব ও রাফাল কেলেঙ্কারির থেকে নজর ঘোরাতে করা হয়েছিল বালাকোটের নাটক, ঠিক তেমনি আজ দেশের চরম আর্থিক দুর্দশা, যার ফলে মোদী’র একান্ত ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিরাও আজ চরম ভাবে ক্ষুব্ধ, যে ভাবে আজ বেকারত্বের পরিসংখ্যান ৪৫ বছরের সর্বাধিক, যে ভাবে কৃষি ও কৃষি ঋণের সঙ্কটে আজ জরাজীর্ণ কৃষকের আর্থিক অবস্থা, এমনকি মধ্য কৃষকরাও দলে দলে নেমে আসছে গ্রামীণ সর্বহারা শ্রেণীতে, যে ভাবে আজ সকল শিল্পে চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে যার ফলে উৎপাদন মে মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন হয়েছে সমস্ত core শিল্পে ও কারখানায়, যে ভাবে গাড়ি, গৃহ নির্মাণ, ইস্পাত সহ অন্যান্য শিল্পের তীব্র সঙ্কটের ফলে কাজ হারাচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ, যখন রেলওয়ে ঘোষণা করেছে তিন লক্ষ কর্মী ছাঁটাইয়ের, সমস্ত বড় শিল্পে অস্থায়ী শ্রমিকদের উপর নেমে আসছে ছাঁটাইয়ের কোপ, ঠিক তখন এই কাশ্মীরের ঘটনা মোদী’র টিকে থাকার জন্যে অবশ্যম্ভাবী ছিল। 


ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে জম্মু ও কাশ্মীর

ভারতের চতুর্দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন বিদ্রোহ ও বিপ্লবী সংগ্রাম ফেটে পড়ছে তখন কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে কোন বিপ্লবের সম্ভাবনা কে রোধ করতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে অস্ত্র ছিল দেশ ভাগ করার ও বিপ্লবের কেন্দ্র দুই প্রদেশ — পাঞ্জাব ও বাংলা — কে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা। দেশ ভাগের পরে বিভিন্ন রাজার অধীনে যে সব রাজ্য ছিল তাদের শাসকদের কাছে অধিকার ছিল নিজেদের রাজত্ব কে হয় নবগঠিত ভারতে অথবা পাকিস্তানে বিলীন করে দেওয়া আর নয়তো স্বাধীন থাকা। ভারতের শাসকশ্রেণী — বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি ও সামন্তপ্রভুরা — যাঁরা প্রত্যেকেই সাবর্ণ হিন্দু সমাজের অংশ, তাঁদের প্রতিনিধি জওহরলাল নেহরু আর বল্লভ প্যাটেল কে দিয়ে সমস্ত বৃহৎ রাজত্ব কে ছলে-বলে-কৌশলে নিজেদের শাসনের অন্তর্ভুক্ত করে এক বৃহৎ রাষ্ট্র গঠনের অভিপ্রায়ে, যেখানে শোষণ ও লুন্ঠনের অবাধ সুযোগ থাকবে।

এই সময়ে কাশ্মীরের রাজা হরি সিংহ ভারত ও পাকিস্তান, দুইয়ের হাতেই তামাক খাচ্ছিলেন। একটি মুসলিম-প্রধান দেশের হিন্দু রাজা হয়ে তাঁর ভয় ছিল যে যদি জম্মু ও কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাঁকে ছুড়ে ফেলতে চায় বা পাকিস্তানের অংশ হয়ে যেতে চায় তাহলে তাঁর রাজত্ব ও ঠাঁটবাট দুইই যাবে। তাই তিনি আরএসএস এর সাথে সমঝোতা করে মুসলিম অধ্যুষিত জম্মুতে নিজের ডোগরা সেনাদের সাহায্যে চালালেন এক অমানবিক মুসলিম গণহত্যা। সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ এর সেই গণহত্যায় বেসরকারি মতে দুই লক্ষ মুসলিম কে হত্যা করে ডোগরা ও আরএসএস বাহিনী। এর সাথে সাথে পাঞ্জাবি হিন্দু শরণার্থীদের পশ্চিম পাঞ্জাব (এখন পাকিস্তান) থেকে আনিয়ে জম্মুতে বসত করে দিয়ে জম্মুর জনসংখ্যার ব্যাপক পরিবর্তন করে হরি সিংহের সেনা। এর ফলে জম্মুতে মুসলিমেরা সংখ্যালঘু হয়ে যান এবং পাঞ্জাবি, ডোগরা ও কাশ্মীরি পন্ডিত মিলিয়ে জম্মু অঞ্চলে হিন্দু জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে। 


এই মুসলিম নিধন যজ্ঞের বদলা নিতে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন থেকে দলে দলে আদিবাসী মুসলিম গেরিলারা জম্মু ও কাশ্মীরের উপর আক্রমণ করে এবং গিলগিট বাল্টিস্তান, মুজ্জাফরাবাদ সহ নানা এলাকা দখল করে ফেলে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে হরি সিংহ ভারতের কাছে সাহায্য চায় আর এই সুযোগে, সামরিক সাহায্যের বদলে নেহরু চেয়ে বসে কাশ্মীরের উপর দখলদারি। হরি সিংহ ও নেহরু-প্যাটেল জুটি জানতো ভারত কে জম্মু ও কাশ্মীর দিয়ে দেওয়ার চুক্তি করলে সেটাকে মুসলিম বিরোধী বলে প্রচার করে সারা কাশ্মীরে এক বিদ্রোহ তৈরি হবে তাই তাঁরা খুব কায়দা করে অক্টোবর ১৯৪৭ এ Instrument of Accession বা অন্তর্ভুক্তি’র চুক্তি সাক্ষর করে যার শর্ত ছিল যে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসাবে না, কাশ্মীর একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে ভারতে যোগদান করবে এবং ভারতের সরকার শুধু কাশ্মীরের প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও বিদেশ মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্ব পালন করবে, বাকি সব কাজ হবে জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধান সভার থেকে। এই অন্তর্ভুক্তি’র চুক্তিতে ভারত প্রতিশ্রুতি দেয় যে ভারতের সরকার কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত করবে এবং সেই গণভোটে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ চয়ন করবেন তাঁদের ভবিষ্যৎ, তাঁরা পাকিস্তানের অংশ হবেন, ভারতের অংশ হবেন, না কি একটি স্বাধীন জাতি হবেন। 


এই চুক্তির ভিত্তিতে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা গৃহীত হয় অক্টোবর ১৯৪৯ সালে। এর এক মাস পরে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয় নভেম্বর ১৯৪৯ এ, আর ভারত কে একটি ঝুটো প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয় জানুয়ারি ১৯৫০ এ। এই ধারা ৩৭০ এর মাধ্যমে ভারতের সংবিধান জম্মু ও কাশ্মীরে, যার নিজের সংবিধান, আইন, পতাকা ও শাসনতন্ত্র ছিল, সেখানে প্রয়োগ হতো এবং ভারতের শাসক শ্রেণী নানা কায়দায় বারবার এই ধারায় বদল এনে জম্মু ও কাশ্মীরের উপর নিজেদের ক্ষমতা কে কুক্ষিগত করে। গণভোটের প্রস্তাব কে ভারত নাকচ করে এই বলে যে সেই প্রতিশ্রুতি প্রজাতন্ত্র হওয়ার আগে দেওয়া হয়েছিল মাউন্টব্যাটেন সাহেব গভর্নর থাকাকালীন এবং সংবিধান গৃহীত হওয়ায় সেই সকল চুক্তি নাকি খারিজ হয়ে গেছে। 


ভারতের শাসকশ্রেণী কথা রাখেনি। শেখ আব্দুল্লাহ কে দিয়ে কমিউনিস্ট নিধন করিয়ে তাঁকে প্রথমে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী করেও ষড়যন্ত্র করে গ্রেফতার করে জেলে বন্দী রাখা হয়। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি কে কাশ্মীরে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়, গণভোটের কথা চেপে গিয়ে সামরিক শাসন কে তীব্র করা হয়, বিশেষ করে ১৯৬২ সালে চীন-বিরোধী ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-বিরোধী যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে। জেল আর জেলের বাইরে বার বার আনাগোনা করে ১৯৬৭ সালে শেখ আব্দুল্লাহ যদিও কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবি ভারতের শাসক শ্রেণীর কাছে বিক্রি করে দেয় ও ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে গত শতাব্দীর সাতের দশকে ক্ষমতায় ফেরে, কাশ্মীরের জনগণ কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্ন কে ভুলে যাননি। ভারতের থেকে মুক্তির শান্তিপূর্ণ সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরেই কিন্তু কাশ্মীরের জনগণ সশস্ত্র সংগ্রামে আটের  দশকের শেষের দিকে যোগ দেন এবং পাকিস্তান এই সুযোগ ব্যবহার করে নিজ স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা চালায়। 


নয়ের দশকের শুরুর থেকেই ভারতের শাসকশ্রেণী সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের চরম সঙ্কটের ফলে, মরুযুদ্ধের ফলে বেড়ে চলা তেলের দামের ফলে এবং বেড়ে চলা বিদেশী ঋণের বোঝার ফলে তীব্র আর্থিক সঙ্কটে জীর্ণ হয়। এই সুযোগে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার (আইএমএফ) ভারত কে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অধীনে আনার শর্ত হিসেবে আর্থিক উদারীকরণের নামে জনবিরোধী নীতির বন্যা বইয়ে দিয়ে ভারতের অর্থনীতির চাবিকাঠি চেয়ে বসে, যা তৎকালীন কংগ্রেস সরকার পূর্ণ করে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি কে আঁকড়ে ধরে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক সঙ্কটের পরিণামে উথ্বান হয় হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী আরএসএস ও সংঘ পরিবারের। যেহেতু সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদারি করে যে তথাকথিত প্রগতিশীলতার আর মেকি সমাজতন্ত্রের মুখোশ ভারত রাষ্ট্র নেহরু জমানা থেকে পড়ে ছিল তা আর নতুন পরিস্থিতিতে অকেজো হয়ে যায় তাই দরকার হয় এক নতুন ধরণের রাজনৈতিক শক্তির যা চরম ভাবে রক্ষণশীল হয়েও নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির সাথে, আইএমএফ ও  বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাথে আঁতাত করে ভারতের সম্পদ ও শ্রম কে বিনামূল্যে সাম্রাজ্যবাদের হাতে তুলে দেবে। 


অযোধ্যায় রাম মন্দির গঠনের নামে যে পার্টি দুইটা সাংসদের দল থেকে উত্তর প্রদেশ সহ নানা রাজ্যের রাজনীতিতে একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে উঠে আসে তার পিছনে ছিল হিন্দুত্বের রাজনীতি, যার জনক ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল বিনায়ক সাভারকার। চরম ইসলাম-বিদ্বেষ ছড়িয়ে সেই প্রথম বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সাথে সাথে বিজেপি দাবি তোলে ধারা ৩৭০ বিলোপের। এই হিন্দুত্বের রাজনীতির উথ্বানে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ ও জায়নবাদী ইজরাইলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের হাত ছিল। তাই নয়ের দশকের শুরুতেই বিজেপি’র চাপে ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের শর্তে কংগ্রেস সরকার কে ইজরায়েলের সাথে প্রথমবার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। সাভারকারের স্বপ্ন পূর্ণ সেইদিন থেকে হতে শুরু করে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও জায়নবাদী ইজরায়েলি সমর্থনে বলিষ্ঠ হয়ে বিজেপি ও আরএসএস ভারতে হিংসা ও বিদ্বেষের রাজনীতি ছড়িয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ করে যে ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করা শুরু করে তা মোদী’র সময়ে এসে সবচেয়ে বলিষ্ঠ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। 


যখন এই ঘৃণ্য রাজনীতি ভারতে চলছে, ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ও মেরুকরণের মধ্যে দিয়ে শাসকশ্রেণী সঙ্কট কালে বিপ্লবের পথ বন্ধ করছিল, তখন কিন্তু কাশ্মীরে চলছিল নির্বিচারে গণহত্যা। উগ্রপন্থা দমনের নামে নারীদের গণধর্ষণ থেকে শুরু করে শিশুদের গুলি করে মারা, কিছুই বাদ রাখেনি ভারতের জল্লাদ সেনাবাহিনী। লক্ষ্য তাঁদের একটাই, কাশ্মীরি জনগণের স্বাধীনতার দাবি কে শেষ করা, কাশ্মীরের মুসলিম জনগণ কে হিন্দুত্ববাদী ভারতের শাসকশ্রেণীর পদযুগলে পোষ্য করে বেঁধে রাখা। কিন্তু স্বাধীনচেতা কাশ্মীরিরা তা মেনে নেয়নি কোনদিনই। আটের দশকের শেষে তাঁদের স্বাধীনতার দাবি তীব্র হতেই ভারতের শাসকশ্রেণীর দালালেরা গুলি করে গণহত্যা করে কাশ্মীরি পন্ডিতদের। প্রায় ৩০০’র উপর কাশ্মীরি পন্ডিত খুন হন কাশ্মীরে। এই সুযোগে কেন্দ্রের থেকে প্রেরিত রাজ্যপাল ও পরবর্তীকালে বিজেপি নেতা হওয়া জগমোহন কাশ্মীর থেকে আতঙ্কিত পন্ডিতদের জোর করে উদ্বাস্তু করে এই বলে যে মুসলিমেরা তাঁদের হত্যা করবে। কিন্তু কাশ্মীরি মুসলিমেরা কোনদিনই চাননি তাঁদের কাশ্মীরি পন্ডিত প্রতিবেশীরা চলে যান। সেই কাশ্মীরি পন্ডিতদের দুর্দশা দেখিয়ে, ভারতের হিন্দু সমাজের মধ্যে উগ্র মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়িয়ে কাশ্মীরে গণহত্যা চালাবার ছাড়পত্র বানিয়ে নেয় ভারতের শাসকশ্রেণী। কাশ্মীরের মুসলিমেরা গত তিন দশক ধরে অনুরোধ করলেও হাজার হাজার কাশ্মীরি পন্ডিত কে আর দেশে ফিরতে দেয়নি ভারতের শাসকশ্রেণী। তবে যে পন্ডিতেরা কাশ্মীরে রয়ে গেছিলেন তাঁদের বেশির ভাগই কিন্তু এই স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছেন।


বহু অত্যাচার, গণহত্যা, গণধর্ষণ, গুমখুন ও জখমের পরেও কিন্তু কাশ্মীর ও কাশ্মীরি জনগণ তাঁদের মাথা নত করেননি। জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে কাশ্মীরের মুষ্টিময় কিছু মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া ও বৃহৎ বাগান-মালিকেরা বাদে সমাজের প্রতিটি শ্রেণী আজ লড়াইয়ের ময়দানে। ভারতের লক্ষ লক্ষ সশস্ত্র সেনা, যাদের সৈন্য শাসনের স্বার্থে তৈরি ঔপনিবেশিক আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার এক্ট (আফস্পা) এর অধীনে ইচ্ছা মতন খুন, অত্যাচার বা ধর্ষণ করার অধিকার আছে, যাদের নামে কোন অভিযোগ কোন থানায় গৃহীত হবে না, তাঁদের বিরুদ্ধে কিন্তু কাশ্মীরের মানুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা আজ পাথর নিয়ে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। নির্বাচন বয়কট করে তাঁরা প্যালেস্টাইনের বীর জনগণের সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন এবং নিজ জীবন উৎসর্গ করতেও ভয় পাচ্ছেন না। তাঁদের দেখে মনে পড়ে চেয়ারম্যান মাও সেতুঙের কথা, মনে পড়ে ভিয়েতনামের কথা, তাঁরা যেন চিৎকার করে বলে ওঠেন “কে কাকে ভয় পায় আজ?”


ভারতের শাসকশ্রেণী কাশ্মীরের মানুষের সংগ্রাম কে পাকিস্তানের টাকায় চলা সন্ত্রাসবাদ বলে নৃশংস দমনপীড়ন করতে এবং ইসলাম-বিদ্বেষ তীব্র করতে অতীতে ভারতের নানা প্রান্তে নিজেদের লোকেদের দিয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালিয়ে সেই দায় কাশ্মীরের ঘাড়ে এরা চাপিয়েছে। ভারতের শ্রমজীবী আন্দোলনের উপর সংশোধনবাদের প্রভাব তীব্র থাকায় এর বিরুদ্ধে, এই কুৎসিত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে, এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ ও শোষিত জনজাতির মানুষের, আদিবাসী জনগণের বৃহৎ সংহতিমূলক সংগ্রাম গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এর লাভের গুড় চেটে চেটে খেয়েছে ভারতের শাসকশ্রেণী। বিশ্বের দরবারে কাশ্মীরের গণসংগ্রাম কে সন্ত্রাসবাদ বলে হেয় করেছে আর তাই প্যালেস্টাইনের মতন কাশ্মীরের মানুষের সমর্থনে বিশ্বের দিকে দিকে আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। বিপ্লবী কমিউনিস্টদের এই ব্যর্থতা যে বড় বেদনাদায়ক তা স্বীকার করতে কোন সঙ্কোচ করা আজ উচিত হবে না।



কাশ্মীর দখলের কারণ, পদ্ধতি ও লক্ষ্য



জম্মু ও কাশ্মীরের বর্তমানে ভারতের অধীনে আছে জম্মু, কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ এবং লাদাখ (যাকে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তিব্বতের অংশ বলে মনে করে), এবং ভারতের পার্লামেন্টের শাসন ধারা ৩৭০ দিয়ে কাশ্মীরে প্রয়োগ হতো। অন্যদিকে ধারা ৩৫এ অনুসারে শুধু জম্মু কাশ্মীরের বিধানসভার অধিকার ছিল সেই প্রদেশের চিরস্থায়ী নাগরিক কে হবেন তা ঠিক করার। এই দুই ধারা কে বিলোপ করে নিজের হাতে জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষমতা তুলে নিয়ে, প্রদেশটিকে দুইটি কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চলে পরিবর্তন করে (পূর্ণ রাজ্য থেকে এই প্রথম কোন রাজ্য কেন্দ্র শাসিত হল) ভারত সরকার আসলে Instrument of Accession কে খারিজ করলো। আর এই খারিজ করার সাথে সাথে কিন্তু আইন মোতাবেক ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জম্মু ও কাশ্মীরের শর্তের পরিসমাপ্তি ঘটে গেল এবং জম্মু ও কাশ্মীর অক্টোবর ১৯৪৭ এর পূর্ববর্তী পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেল। এখন জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতের সেনা থাকা মানে হল সরকারি ভাবে, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারি। এর ফলে ভারত কাশ্মীরের উপর থেকে চিরকালের জন্যে নিজের আইনী দাবি হারাল এবং কাশ্মীরের ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে চিহ্নিত হল।
যদিও ভারতের শাসকশ্রেণীর বিদেশী পুঁজির প্রতি যে আনুগত্য আছে, যে ভাবে ভারতের শাসক শ্রেণী, বিশেষ করে মোদী কে দিয়ে দেশের বাজার ও খনিজ সম্পদের দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, রুশ সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যান্য বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কে, তার ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের উপর কোন চাপ পড়বে না। কূটনৈতিক ভাবেও ভারত কে জব্দ হতে হবে না। আর এই সমর্থনের আড়ালে মোদী সরকার ও ভারতের শাসকশ্রেণী কে চাপ দিয়ে আরও বেশি লুঠ তরাজের সুযোগ তৈরি করবে বিদেশী কোম্পানিগুলি। ফলে কাশ্মীরের মানুষের সংগ্রামে আন্তর্জাতিক স্তরে কোন সরকারি সমর্থন উঠবে না শুধু নিজ ভৌগলিক-রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত পাকিস্তানী শাসকদের বাদে। 
এই সময়ে অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন ভারত দীর্ঘ ৭২ বছর ধরে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সাথে লড়ছে কেন, কেনই বা ভারতের কাশ্মীর এত দরকার? হঠাৎ কেন আজ ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হল? আরও প্রভৃতি প্রশ্ন উঠবে। 

কোন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বা ঐতিহাসিক কারণে ভারতের কাশ্মীর চাই না। ভারতের শাসকশ্রেণীর কাশ্মীর কে দরকার জলের সুরক্ষার জন্যে ও চীন বিরোধী যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্যে। ভারতের শাসক শ্রেণী চায় কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জলসম্পদের উপর একচেটিয়া অধিকার, যা বিক্রি করে তাঁরা অনেক মুনাফা আয় করতে পারবে। এতদিন কাশ্মীরের সরকারের সাহায্য নিয়ে সেখানকার সম্পদ লুঠ করতে হতো, এবার সরাসরি দখলের ফলে মোদী সরকারের মালিক গৌতম আদানি, মুকেশ আম্বানি ও তাঁদের বিদেশী একচেটিয়া-লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন বৃহৎ কর্পোরেট কর্তারা জম্মু কাশ্মীরের জমি ও সম্পদের উপর নিজেদের অধিকার কায়েম করতে পারবে। মোদী সরকারের ৩৭০ ধারা বিলোপের কিছুক্ষণের মধ্যেই গৌতম আদানি টুইটারে জানান দেয় তাঁর খুশির কথা, আহ্লাদে আপ্লুত হয় সে “উন্নয়নের” নামে বিনামূল্যে জনতার সম্পদের উপর মালিকানা পাওয়ার লোভে। আরও অনেক হায়না ও শকুন লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কাশ্মীরের দিকে, তাকে ছিন্নভিন্ন করে খাওয়ার অভিলাষ নিয়ে।  

চীনের নেতৃত্বে শোধনবাদী বেইমানরা অধীন হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা যুদ্ধ করে চীন দখল করা ছাড়া ওখানে নব্য উপনিবেশ স্থাপন করা সম্ভব নয়। এই কাজে চীনা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা ওদের পক্ষে থাকলেও চীনা জাতীয় বুর্জোয়াদের অংশটি ওদের বিরুদ্ধে চীনা পুঁজির প্রসার সারা বিশ্বে করতে চায়। তাই চীন ও রাশিয়ার বুর্জোয়ারা হাত মিলিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি কেন্দ্র তৈরি করেছে, যার লক্ষ্য বিশ্বের উপর নিজের প্রতিপত্তি কায়েম করা। ভারতের শাসকশ্রেণী মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া হলেও, সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ সাহায্যে তাঁরা কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণবাদী ভূমিকা পালন করে। চীনা বুর্জোয়াদের সাথে যুদ্ধে জেতার শক্তি এখনো ভারতের না হওয়ায় চীনের বন্ধু পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করে চীন কে মার্কিন সাহায্যে ঘিরে ফেলতে চাইছে নয়া দিল্লি। এই কাজে যত বেশি সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে ভারতের শাসক শ্রেণী পৌঁছাবে তত বেশি তাঁরা মার্কিন সাহায্য পাবে এবং কাটমানি আয় করতে পারবে। 

লাদাখ অঞ্চল থেকে চীনের উপর হামলা করার সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে আছে ভারত আর তাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভারতের সামরিক অবস্থান কে আজ সমর্থন করবে, বিশেষ করে যখন চীন ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে প্রচন্ড রকমের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব চলছে। ভারতের শাসকশ্রেণী যত বেশী করে চীন বিরোধী যুদ্ধের জিগির তুলে মানুষ কে ক্ষেপিয়ে লাদাখের উপর নিজের অন্যায় কতৃত্ব কে বজায় রাখতে পারবে তত বেশি করে মার্কিন সাহায্যের নামে কোটি কোটি ডলার মোদী ও শাহ আয় করতে পারবে, তত বেশি করে আরএসএস এর সিন্দুক উপচে পড়বে। তাই আজ ওদের জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ কে দরকার চীন ও পাকিস্তান-বিরোধী যুদ্ধের কামানের খোরাক বানাবার জন্যে ও লাদাখ দরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ছোড়া রুটির টুকরো খাওয়ার জন্যে।


এর সাথে সাথে ভারতের শাসক শ্রেণী নিজের দালালদের, বেনিয়া মুৎসুদ্দিদের ও প্রতিক্রিয়াশীল সাবর্ণ হিন্দু লোকেদের কাশ্মীরে স্থায়ী বসবাসের জন্য কলোনি বানিয়ে দিতে চায় যে ভাবে জায়নবাদী ইজরায়েল প্যালেস্টাইনের মাটিতে ইহুদী কলোনি গড়ে দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে পরিবর্তন করে। এই সেটেলমেন্ট কলোনিগুলো পরবর্তীতে কাশ্মীরের জনসংখ্যার অনুপাত বদল করতে, কাশ্মীরি জনগণের চেয়ে বহিরাগত বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে। এই জনসংখ্যার পরিবর্তনে কাশ্মীরের মানুষ তাঁদের দেশের উপর থেকে নিজেদের অধিকার হারাবেন, নিজ দেশে সংখ্যালঘু হয়ে যাবেন। এই ফাঁকে কোনদিন যদি গণভোট হয় তাহলেও ভারত জিতে যাবে সংখ্যার জোরে।

ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কাশ্মীর রণনীতি কী হওয়া উচিত?


ভারতের রাজনৈতিক ময়দানে কাশ্মীরের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার প্রথম স্বীকার করেন চারু মজুমদার ও তাঁর হাতে গড়া ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বা সিপিআই (এম-এল), যা নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের আগুনে তপ্ত হয়ে ভারতের বিপ্লবের অগ্রবাহিনী হয়ে ওঠে। কাশ্মীর প্রসঙ্গে ও জাতীয় মুক্তির প্রসঙ্গে একটি সঠিক লেনিনবাদী লাইন গ্রহণ করে সিপিআই (এম-এল) গঠিত হওয়ার আগে ও পরে কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন জানায় চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী কমিউনিস্টরা। যদিও কমিউনিস্টরা সর্বদাই বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষে তবে লেনিনের শিক্ষা অনুসারে তাঁরা বিশ্বাস করেন যে বৃহৎ রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে নানা জাতির, নানা বর্ণের, নানা ভাষার শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য আর সেই ঐক্য সুদৃঢ় ও ইস্পাত কঠিন ঠিক তখন হতে পারে যখন সেই ঐক্যের ভিত্তি হয় আলাদা হওয়ার, বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার বা প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার। যে ঐক্য আলাদা হওয়ার, বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার স্বীকার করে না সেই ঐক্য হয় শোষনের স্বার্থে ঐক্য, বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থে ঐক্য, জনগণের স্বার্থের ঐক্য নয়।

চারু মজুমদার দেখিয়েছিলেন যে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই স্লোগানের তাৎপর্য হলো যে এটা বুর্জোয়াদের একচেটিয়া শোষণের স্বার্থরক্ষা করে, কাশ্মীর কে বৃহৎ বুর্জোয়ার শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট করে। তাই তিনি স্লোগান দেন: “জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কে স্বীকার করো; ভারতবর্ষ কে ঐক্যবদ্ধ করো।” ভারতের বিপ্লবী রাজনীতিতে নকশালবাড়ি আজ থেকে ৫২ বছর আগে কাশ্মীরের মুক্তির দাবি তুলেছে এবং ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের অধীনে পরাধীন সকল জাতির মুক্তির দাবি তুলেছে। চারু মজুমদারের রাজনীতি আমাদের শিখিয়েছে যে ইন্ডিয়া নামক যে রাজনৈতিক সত্ত্বায় আমরা বাস করি তা নানা জাতির ও নানা ভাষার মানুষের সমন্বয়ে তৈরি আর এই বিবিধ মানুষের ঐক্য হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। ঔপনিবেশিক শাসনের পরবর্তীকালে ভারত যখন একটি আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়, তখন ভারতের শাসকশ্রেণীর কাছে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করার দুইটি প্রধান অস্ত্র হয় হিন্দি ভাষা ও হিন্দু ধর্ম। এই ঐক্য তাঁদের কাছে অতিপ্রয়োজনীয় যাতে তাঁদের একচেটিয়া শাসন সারা ভারতে বলবৎ থাকে এবং শোষণ ও লুন্ঠন করতে সুবিধা হয়। পাকিস্তানের নামে দেশ ভাগ হওয়ার ক্ষত কে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এই শাসক শ্রেণী দশকের পর দশক জাগিয়ে রেখেছে নিজের শোষণের স্বার্থে জনগণ কে ভাগ করে দেশের নামে ভূখণ্ড কে একত্রিত রাখতে।


কমিউনিস্টদের কাছে দেশ মানে পাহাড়, নদী, মাটি আর সম্পদ নয়, তাঁদের কাছে দেশ মানে হল সেই দেশের মানুষ, যে মানুষ নিজের শ্রমে দেশ গড়ে তোলে। তাই মাটির ঐক্যের স্বার্থে জনগণ কে ভাগ করার, এক ধর্মের বা জাতির মানুষ কে অন্য ধর্ম বা জাতির উপর, বিশেষ করে একটি সমাজের বা রাজ্যের সংখ্যালঘু, দুর্বল ও শোষিত জাতি, ধর্ম বা বর্ণের মানুষের উপর আক্রমণ করতে উস্কে দেওয়ার রাজনীতির বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা চিরকাল লড়াই করে মানুষ কে শ্রেণী স্বার্থের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে, তাঁদের শোষিত শ্রেণী’র মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণ করিয়ে। চারু মজুমদারের শিক্ষা হলো কমিউনিস্টরা জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম করবেন না, শুধু শ্রেণী সংগ্রাম গড়ে তুলবেন আর শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে জনগণের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম কে তাঁরা অবশ্যই সমর্থন করবেন বৃহৎ জাতির ঔদ্ধত্ব না দেখিয়ে।


তাই আজ যখন দেশের ভিতর ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করে মোদী দেখিয়ে দিল যে সংবিধান ব্যবহার করে সংবিধান কে ধ্বংস করে এই মেকি গণতন্ত্রের মুখোশ ছিঁড়তে তাঁর বেশি সময় লাগবে না, যখন দেশের কোন রাজনৈতিক দল খোলাখুলি কাশ্মীরের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে দাঁড়িয়ে আগ্রাসী ভারতের শাসকশ্রেণীর মুখোমুখি বিরোধিতা করতে ভয় পাচ্ছে তখন কমিউনিস্টদের চিৎকার করে বলা উচিত “বিদ্রোহ ন্যায় সঙ্গত” ও “ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ কাশ্মীর থেকে দূর হঠো।


আজ দুনিয়ার বুকে কোন বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নেই যা কাশ্মীরিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে অবস্থান নেবে, তাঁদের সাথে দাঁত ও মাড়ির সম্পর্ক গড়ে তুলবে। যদিও পাকিস্তান চেষ্টা করবে তবে তা নিজ স্বার্থে, কাশ্মীর দখল করতে, কাশ্মীর কে স্বাধীন করতে নয়। এমতাবস্থায় কাশ্মীরের মানুষদের নিজেদের মুক্তির সংগ্রাম নিজেদেরই লড়তে হবে, নিজেদের শক্তির উপর ভর করে এবং তাঁরা যদি ঐক্যবদ্ধ ভাবে রুখে দাঁড়িয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেন তবে তাঁরা অবশ্যই ভারতের শাসক শ্রেণী কে পরাজিত করতে পারবেন। তাঁদের পাশে তাঁরা সংহতিমূলক লড়াইয়ে পাবেন ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের, শ্রমিক ও কৃষকের বিপ্লবী সংগ্রাম কে। একদিন চারু মজুমদার বলেছিলেন যে “আজ যদি পশ্চিমবাংলার প্রতিটি কমরেড রক্ত দিতে প্রস্তুত থাকেন তাহলে ঠেকাতে পারবে কি ওরা কোরাপুট কে?” সেই প্রশ্ন আজ কাশ্মীরের জনগণের পক্ষ থেকে উঠে এসেছে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের কাছে। আমাদের সংগ্রাম ঠেকাতে পারবে কি আজ কাশ্মীরের গণহত্যা কে? আমাদের শ্রেণী সংগ্রাম রুখে দিতে পারবে কি ফ্যাসিবাদের রথের চাকা কে? বিপ্লবী যুদ্ধ কি প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ কে রুখে দিতে পারবে? এর উত্তর দিতে হবে আমাদের সংগ্রামের ময়দানে, হাতেনাতে লড়াই করে। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে