৩৭০ ধারা বিলোপ, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান নাকি আন্দোলনের নবজাগরণ?

বুধবার, আগস্ট ০৭, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


জঙ্গী হামলা হওয়ার আগাম খবর আছে, তাই নাকি ছাত্র, পর্যটক সহ সমস্ত বহিরাগতদের কাশ্মীর ছাড়ার নির্দেশ দিল নরেন্দ্র মোদী'র নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার। বন্ধ করে দেওয়া হলো হিন্দুদের পবিত্র অমরনাথ তীর্থ যাত্রা, যার উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কাশ্মীরী মানুষ। বন্দুকধারী বাহিনী আর কাঁটাতার দিয়ে আরো বেশী ছেয়ে দেওয়া হল কাশ্মীর। বন্ধ করে দেওয়া হল ফোন, মোবাইল সংযোগ, ইন্টারনেট এর মত সমস্ত যোগাযোগের মাধ্যম।  ঠগীর কাছে বোকা বনে গিয়ে নির্মল আনন্দ উপভোগ শুধুমাত্র নির্বোধ ভক্ত ছাড়া আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। সুতরাং কাশ্মীরিরা বিশ্বাস করল না কেন্দ্র সরকার’কে। তাঁরা আশংকা করল গোটা কাশ্মীর কে বন্দুকের নলের মুখে দাঁড় করিয়ে, কাঁটাতার দিয়ে বেঁধে বিলোপ ঘটানো হবে সংবিধানের ৩৭০ ধারা।

শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে কাশ্মীরীদের আশংকাই সঠিক প্রমাণিত হল। মিথ্যা প্রচারে সেনা আধিকারিকদের ব্যবহার করল বিজেপি সরকার, দেশের জনতাকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার গল্প শুনিয়ে সন্ত্রস্ত করে তাড়াতাড়ি  সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হলো । কাশ্মীরের জনগণ বা স্বাধীনতাকামী হুরিয়াত কনফারেন্স দূরে থাক, ভারতপন্থী নির্বাচিত কাশ্মীরী নেতাদের সাথেও কোনো রকম মতামত বিনিময় হল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছিলেন যে কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ ফারুক আবদুল্লাহ নিজের ইচ্ছায় পার্লামেন্ট আসেননি। তারপর ফাঁস হল যে তাঁকে গৃহবন্ধী করে পার্লামেন্টে আসতে দেয়নি সরকার।  


এই  সরকারি গণ প্রতারণা প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করল যে নাগরিকদের  দ্বারা নির্বাচিত বলে দাবি করা হয় এমন সরকার আদৌ তার নাগরিকদের সম্মান করে কিনা? মধ্য যুগের রাজা জমিদারদের আমলের মতন রাষ্ট্র জনগণের ঊর্ধ্বে নাকি রাষ্ট্র হল জনগণকে সেবা করার সংস্থা? জাতিসত্তাগুলো তাদের ভাগ্য ও জীবনযাপনের সাথে জড়িয়ে থাকা সিদ্ধান্ত সমুহ নিজেরা নেবে নাকি বাইরের কোনো শক্তি তাদের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে?  ভারতপন্থী বা ভারত বিরোধী সমস্ত কাশ্মীরি নেতাদের গ্রেফতারী আর সমগ্র কাশ্মীর জুড়ে কার্ফু জারি করে নাগরিকদের আটক করে রাখার মধ্যে দিয়ে কি এইটা প্রমাণ হল না যে কাশ্মীরের কোনো অংশের মধ্যেই সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে জন সমর্থন নেই? জনমত ছাড়া সিদ্ধান্ত চাপিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক আগ্রাসন ভিতরে এবং বাইরে সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠন করবে না কি?  


নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের মতো ৩৭০ ধারা বিলোপে উচ্ছ্বসিত হয়েছে হিন্দুত্ববাদী উগ্রজাতীয়তাবাদীরা।  তারা প্রশ্ন করছেন কাশ্মীর কেন বিশেষ সুবিধা পাবে? কিন্তু তারা এই প্রশ্ন করছেন না যে বাকি প্রদেশগুলোও কেন ঐ সুবিধাগুলো পাবে না! ৩৭০ ধারা নিয়ে নানা মুনির নানা মত (কাশ্মীরী মানুষদের বাদে) থেকে পৃথক করে বস্তুগত ভাবে বর্তমান সংকট কে বুঝতে সংক্ষেপে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক আধুনিক কাশ্মীরের ইতিহাস ও  ৩৭০ ধারার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর।         


১৮৪৬ সালে প্রথম ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধে  শিখরা ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়। ব্রিটিশদের দাবি মত যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ দেড় কোটি টাকার পুরোটা দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় শিখেরা জম্মুর হিন্দু ডোগরা শাসক  গুলাব সিংহ কে কাশ্মীর বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। ডোগরা হিন্দু শাসকরা যেহেতু জম্মুতে বসে কাশ্মীর শাসন করতেন, তাই জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের উদ্ভব। ডোগরা শাসকরা ব্রিটিশ শাসকদের সম্মানজনক নজরানা পাঠাবে এবং ব্রিটিশরা জম্মু ও কাশ্মীরের শাসক হিসেবে ডোগরা শাসকদের স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা দেবে, এই ছিল বোঝাপড়া। ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার আগে এরকম ৫৬২ টা দেশীয় রাজ্য ছিল, যেগুলো সরাসরি ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনের আওতায় ছিল না। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীর ছিল বৃহত্তম। 


১০০ বছরের ডোগরা শাসন কাশ্মীরী চাষীদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। সাধারণত রাজা বা সামন্তপ্রভুরা যেমন হয় আর কি। কাশ্মীরে করের বোঝা বরাবরই মাত্রাতিরিক্ত ছিল, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল স্বৈরতান্ত্রিক অত্যাচার। সামন্ত মহাজনরা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন উচ্চবর্ণ হিন্দু আর গরিব কৃষক কারিগরেরা মুসলমান। জি এন কাউল এর রচনায়, ১৯২০ সালের কাশ্মীরী সমাজের যে বিবরণ পাওয়া যায় সেখান থেকে জানা যায় যে অন্ততঃ ৯০ শতাংশ মুসলমানের বাড়ি হিন্দু মহাজনের কাছে বন্ধক পড়ে ছিল।  ১৯৪৭ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৭৭% ছিলেন মুসলমান। আর কাশ্মীর উপত্যকার ৯৩% মানুষ ছিলেন মুসলমান। ফলে শ্রেণী শোষণে যারা পিষ্ট হচ্ছিল সেই কাশ্মীরী শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা গরিষ্ঠই কিন্তু মুসলমান ছিলেন। 


জম্মু ও কাশ্মীরে ডোগরা রাজবংশ, জায়গিরদার, মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনের এক বড় ঐতিহ্য আছে। যেটা জোরদার হতে থাকে বিংশ শতাব্দী’র তিনের দশক থেকে। শেখ আবদুল্লাহ’র নেতৃত্বে কাশ্মীরে সামন্তবাদ-বিরোধী ব্যাপক ভূমি সংস্কার তারই প্রতিফলন। ব্রিটিশ শাসকেরা যে ভারত ছেড়ে চলে যাচ্ছে এই খবর ১৯৪৬ সাল নাগাদই হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছিল। যেহেতু ব্রিটিশরা নজরানার বিনিময়ে রাজাকে নিরাপত্তা প্রদান করত তাই ব্রিটিশ শাসন  শেষ হওয়ার আভাস পেয়ে কাশ্মীরে শুরু হয় রাজতন্ত্র বিরোধী "কাশ্মীর ছাড়ো" আন্দোলন। পুঞ্চ অঞ্চলের কৃষকরা রাজা গুলাব সিংহ’র আমল থেকেই বিদ্রোহ করে এসেছে। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, পুঞ্চ অঞ্চলের কৃষক অভ্যুত্থান সংগঠিত আকার ধারণ করে, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে রাজা হরি সিংহ’র অত্যাচার। এর আগে বার বার কাশ্মীরে হিন্দু মৌলবাদীদের সাথে জিন্নাহ পর্যন্ত রাজা হরি সিংহ কে চোখ বন্ধ করে সমর্থন করে এলেও ,পুঞ্চের এই বিদ্রোহের সময় পাকিস্তান তার নীতি বদল করে। 


১৯৪৭ সালের ২৪ অক্টোবর পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের  এক বিরাট সংখ্যক “উপজাতি” জঙ্গী বাহিনী কাশ্মীর আক্রমণ করে। আর এই হামলাকারিদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় পুঞ্চের জনতা। পাকিস্তান’ও অঘোষিত ভাবে সেনা বাহিনী পাঠিয়ে দেয় হামলাকারী ও বিদ্রোহীদের সাথে।  রাজা বিপাকে পড়েন এবং নব্যগঠিত ভারত রাষ্ট্রের কর্ণধার নেহরু ও প্যাটেলের কাছে সাহায্য চান। সাহায্যের বদলে ভারত কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি দাবি করে আর চাপে পড়ে হরি সিংহ তা মেনে নেন। ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭ এ জম্মু ও কাশ্মীর এবং ভারত সরকারের মধ্যে Instrument of Accession চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মুল কথা হল এই যে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, ও যোগাযোগ, এই তিনটে ক্ষেত্রে  জম্মু ও কাশ্মীর সরকার ভারতের কর্তৃত্ব মেনে নেবে। কিন্তু এই চুক্তি চূড়ান্ত হবে জম্মু ও কাশ্মীরে গণভোটের পর। 


সেই দিনই কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা পৌছলে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে শেখ আবদুল্লাহ’র ন্যাশনাল কনফারেন্স এর স্বেচ্ছাসেবকরা। ১৯৪৭ সালের ২ নভেম্বর, নেহরু তার বেতার ভাষণে কাশ্মীরের ভারত ভুক্তির বিষয়টি কাশ্মীরের মানুষের গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে বলে ঘোষণা করেন। ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি নেহরু রাষ্ট্র সংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীরে গণভোটের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। নেহরুর গণভোট সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ৬ জানুয়ারি নিরাপত্তা পরিষদে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে, ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্র সংঘ কাশ্মীরে গণভোট সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে তাতে ভারত এবং পাকিস্তান উভয় গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারনের বিষয়টি মেনে নিয়েছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত রাষ্ট্র সংঘ কাশ্মীরের গণভোট নিয়ে অন্তত আটটি প্রস্তাব নিয়েছে। এমনকি ১৯৪৮ সালের ১১ ডিসেম্বর গণভোট সংক্রান্ত রূপরেখা তৈরি হওয়ার পর, ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে। যদিও সেই গণভোট আজও করা হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্র সংঘে ভারতীয় প্রতিনিধি ঘোষণাই করে দিলেন যে কোন অবস্থাতেই তার সরকার গণভোট করাতে রাজি নয়।


১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের সংবিধান সভা ভারতীয় সংবিধানের  ৩০৬-এ ধারা যুক্ত করে জম্মু ও কাশ্মীরের আভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়। একই সাথে বলা হয় যে যতদিন না পর্যন্ত গণভোটের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ  তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ না করেন ততদিন পর্যন্ত বিষয়টি Interim System হিসেবে থাকবে। পরবর্তী কালে ভারতের নবগঠিত সংবিধানে এই ৩০৬এ ধারাটি নতুনভাবে ৩৭০ ধারা হিসেবে যুক্ত হয়। কিন্তু এই ৩৭০ ধারায়  গণভোটের বিষয়টি কে হাপিস করে দেওয়া হয়, ধীরে ধীরে ৩৭০ ধারাটি কে সংশোধনের মাধ্যমে প্রায় বিলুপ্তির পথে নিয়ে গিয়েছে ভারত সরকার।  


৩৭০ ধারার খসড়া দেখার পর শেখ আবদুল্লাহ অসম্ভব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কারণ এ ছিল স্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা। এই সময় থেকে আবার শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরের গণভোট ও কাশ্মীরের স্বাধীনতার কথা তুলতে থাকেন এবং ব্যাপক জনসমর্থন পেতে থাকেন। ১৯৫৩ সালে ভারত সরকার রাজা হরি সিংহ’র পুত্র কাশ্মীরের সদর-ই-রিয়াসত করণ সিংহ’কে দিয়ে কাশ্মীরের জননেতা শেখ আবদুল্লাহ কে গ্রেপ্তার করান। শেখ আব্দুল্লাহ’র মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে কাশ্মীর, নির্মম অত্যাচারে এই আন্দোলন দমন করা হয়। পুলিশের গুলিতে অন্তত ৬০ জন কাশ্মীরী প্রাণ হারান। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৮ সালের বেশিরভাগ সময়টাতেই শেখ আবদুল্লাহ জেলে কাটান।  শেখ আব্দুল্লাহ’র সাথে তার সহকর্মী মির্জা আফজল বেগও জেলে ছিলেন। রাষ্ট্র সংঘের মানবধিকার সনদকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এই দুজনকে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়, কোন অপরাধেই এদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। এর পর দমনের মুখে পুরানো নেতাদের পালটি খাওয়া তাদের জনবিচ্ছিন্ন হওয়া, নতুন প্রজন্মের নেতাদের আবির্ভাব, বামপন্থী সশস্ত্র সংগ্রামী মকবুল ভাটের উত্থান, সেকুলার সশন্ত্র স্বাধীনতাকামী দল হিসেবে জম্মু ও কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের উত্থান তারপর প্রচন্ড দমনের মুখে পড়ে গান্ধীবাদী স্বাধীনতাকামীতে পরিণত হওয়া, স্বাধীনতা সংগ্রামকে হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত করার ভারতীয় প্রচেষ্টা বা ভারতের প্রতি ঘৃণাকে পাকিস্তানের কাজে লাগানো, পন্ডিতদের ইস্যু এই সব নিয়ে বিস্তারিত লেখার অবসর আপাতত নেই।


বলরাজ পুরি, আয়লাস্টে ল্যাম্ব প্রভৃতি সমাজবিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিকদের মতে, প্রথমেই গণভোট হয়ে গেলে কাশ্মীর ভারতের দিকেই আসত। তার একটা বড় কারণ জননেতা শেখ আবদুল্লাহ । যিনি “বন্ধু” নেহরু’র প্রভাবে নিজের দলের নাম মুসলিম কনফারেন্স পাল্টে ন্যাশনাল কনফারেন্স করেছিলেন, ইসলামিক রাষ্ট্রের বদলে “সেকুলারিজম” এ তাঁর ঝোঁক ছিল বেশী। তা ছাড়া পাকিস্তানের সাথে বা পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জনতার সাথে পাঞ্জাবী মুসলমানদের সংস্কৃতিগত মিল থাকলেও এই পাড়ের কাশ্মীর, যেখানে শেখ আব্দুল্লাহ’র প্রভাব ছিল, সেখানে বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, সুফি মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত ইসলাম বিরাজ করতো। তাছাড়া নিরাপত্তার জন্য ভারতের ছত্রছায়া তাদের মেনে নিতে কোন সমস্যা ছিল না।   কিন্তু আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজি ও ভারত সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলোনা রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন যুক্তরাষ্টীয় কাঠামো। শেখ আব্দুল্লাহ’র কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী (মুখ্যমন্ত্রী নয় কিন্তু) হওয়ার পর বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারের হাত থেকে জমি বাজেয়াপ্তকরণ ও ব্যাপক ভূমি সংস্কার আতংকিত করে শাসক শ্রেণীকে। প্রতিরক্ষা পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ছাড়া সমস্ত ক্ষমতা যদি রাজ্যের হাতে থাকে তবে ঐ রাজ্যে উঠতি ব্যবসায়ীদের হাতে ক্ষমতা আসার সম্ভবনা তৈরি হয়, তারা নিজেদের হাতে প্রদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে সুবিধা অনুযায়ী আইন পাস করে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল বৃহৎ পুঁজিপতিদের শোষন প্রক্রিয়ায় বাধা দান করতে পারে। অন্যান্য রাজ্যগুলোও তখন পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চাইবে। প্রদেশের সম্পদের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে ঐ অঞ্চলে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রন। আঞ্চলিক পুঁজিবাদের বিকাশ হবে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে  অবাধ শোষনের জন্য তৈরি নয়া উপনিবেশিক কাঠামো তথা অতি বৃহৎ পুঁজি।        


 ভারতীয় বলে কোনো জাতি হতে পারে না। ভারত বহু জাতিসত্তার দেশ। ফলে ক্ষমতাশালী কেন্দ্র সরকারের বদলে অধিক ক্ষমতাশালী রাজ্য সরকারগুলোই জাতিসত্তাগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক বিকাশ ঘটাতে পারে। উল্টো দিকে, ভারতে প্রভাবশালী পশ্চিম ভারতের গুজরাটী, মারোয়াড়ি, পারসি পুঁজিপতিদের প্রয়োজন হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত  এক-কেন্দ্রিক শক্তিশালী কেন্দ্র সরকার। অতীতে পশ্চিম ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের এই আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করতেন মোহনদাস গান্ধী’র নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস নেতৃত্ব। অন্যদিকে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বাংলায় চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষ চন্দ্র বসু সহ বিভিন্ন প্রদেশের কংগ্রেস নেতৃত্ব। পরবর্তীকালে গুজরাটী-মাড়োয়ারী মুৎসুদ্দিরা গড়ে তোলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, হিন্দু মহাসভার মত দলকে যারা আভ্যন্তরীণ গোলযোগ ছাড়াই উগ্রভাবে তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করবে।   


৩৭০ ধারা বিলোপ কাশ্মীরী জনতাকে আরো বেশী ভারত সরকার  বিরোধী অবস্থানে ঠেলবে সন্দেহ নেই। দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতাকামী নেতারা শুধু নয়, ভারতপন্থী মূলধারার কাশ্মীরী নেতারাও এবার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। এই আগ্রাসন ভারতপন্থী বা নরমপন্থী কাশ্মীরী নেতাদের রাজনৈতিক ভাবে বিপন্ন করলো। কেন্দ্রীয় সরকারের এককেন্দ্রিক আগ্রাসন শুধু কাশ্মীর নয় দক্ষিণ ভারতের জাতিসত্তাগুলোর মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি করছে।  বন্দুকের নলের ডগায় ঐক্য সম্ভব নয়, ঐক্য সম্ভব বিচ্ছিন্নতার অধিকার সহ সমস্ত জাতিসত্তা'র সহমত ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে।               

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে