উগ্র জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ পরিসরে দুর্বল হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রাম

মঙ্গলবার, অক্টোবর ২৯, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


একটা সময় ছিল, ষাট-সত্তরের দশক অবধি, যখন আন্তর্জাতিকতাবাদ একটি জোরালো রাজনৈতিক প্রবণতা ছিল। ভিয়েতনামের যুদ্ধের অপরাধীদের আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে সাজা পাওয়ার কথা এমনি এমনি ওঠেনি। রাস্তার আন্দোলনের মধ্যে থেকে একটা সম্মিলিত চীৎকার হয়ে উঠেছিল। শুধু যুদ্ধবাজ আমেরিকার রাস্তায় জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই সে আওয়াজ ওঠেনি, আমাদের মত গরিব দেশের রাস্তা থেকেও সে আওয়াজ প্রত্যয়ের সাথে উঠেছিল। আমার নাম, তোমার নাম, ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম। এ আমরা, আশির দশকের সন্তানরা, ছোটবেলায় নানা লোকের মুখে শুনে ফেলেছি। সত্যজিৎ রায়ের "প্রতিদ্বন্দ্বী"-র ইন্টারভিউ সিনে বেকার যুবকের ভিয়েতনাম যুদ্ধের গুরুত্বকে মানুষের চাঁদে যাওয়ার ঘটনার গুরুত্বের থেকে বড় করে দেখতে শিখেয়েছিল সে এক রাজনীতি। ওই দৃশ্যটা দেখার অনেক আগে, বা প্রলেতারিয়েতের আন্তর্জাতিকতাবাদের রাজনৈতিক তত্ত্ব/প্রয়োগ সম্পর্কে জেনেবুঝে ওঠার অনেক আগেই আমরা, আশির দশকের বাচ্চারা, শিখে গেছি যে আমরা এ দেশের মানুষ হওয়ার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই ভিয়েতনামের যুদ্ধ-আক্রান্ত মানুষের পক্ষে ছিলাম, আমরা চিরকাল প্যালেস্তাইনের যুদ্ধ-আক্রান্ত মানুষের পক্ষে ছিলাম। আমরা আমেরিকার ব্লকেড আক্রান্ত কিউবার পক্ষে ছিলাম। রুশ বিপ্লব কী তা জানার আগেই আমরা, তখনকার ছোটরা, সোভিয়েতকে ভালবাসতাম। বাংলা অনুবাদে সোভিয়েত লেখক আর কবিদের পড়তে পেতাম। অত দূর সোভিয়েত দেশ থেকে অমন যত্নে তৈরি করা এত ছোটদের বই কীভাবে জানি বাড়িতে পৌঁছে যেত, বইমেলায় পাওয়া যেত। আন্তর্জাতিকতাবাদের ধারণা মগজে ঢোকার অনেক আগেই আমরা হাতেনাতে এর সহজ, স্বাভাবিক উপস্থিতি টের পেয়ে যেতাম।


নিছক আশির দশকের নস্টালজিয়া ঢেঁকুর তোলার জন্য এটা বলা নয়। সরলীকরণ করে বলার জন্যও এটা নয়। সরলীকরণ করা ভুল হবে, কারণ এ সবের মধ্যেও স্থানীয় জাতীয়তাবাদের একটা শিকড় আগাগোড়া ছিল। তাই, ভিয়েতনাম, কিউবা, রাশিয়া, প্যালেস্তাইন সম্পর্কে এই অবস্থানগুলো থাকা সত্ত্বেও আমরা চীন ভারত যুদ্ধের সময় জেনে বুঝে অবস্থান নিতে শিখিনি। আমরা কোনদিনই কাশ্মীরের মানুষের পক্ষ নিতে শিখিনি। আমাদের কাশ্মীর সম্পর্কে স্বাভাবিক ভাবে জানা বোঝার কোনও উপায় ছিল না। মাধ্যমিক বোর্ডের দেওয়া ভারতের মানচিত্রে ম্যাপ-পয়েন্টিং করার সময় আমরা সেই মানচিত্রকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে জানতাম না। এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা মাথায় রেখেও বলা যায়, যে এক জোরালো আন্তর্জাতিকতাবাদ তখনও ছিল। প্যালেস্তাইন নিয়ে কথা বললে, "বিশ্বমানব" বলে কটাক্ষ করাটা তখন একেবারেই আনকুল ছিল।


শ্রম এবং পুঁজির দ্বন্দ্বকে রাজনীতির পরিসর থেকে যত বেশি বেশি করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তত আমার সমস্যার সমাধান যে বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানের সাথে জড়িত থাকতে পারে, এবং আমার সমস্যা যে অনেক অংশে আসলে বৈশ্বিক ফাটকা পুঁজির মহাঘোঁট থেকে উদ্ভুত, এই বোধও চলে গেছে। এখনকার ‘স্বাভাবিক’ বোধটাও তাই খানিকটা এরকম। সব সমস্যাই হয় কেবল আমার, নয় কেবল আমার গোষ্ঠীর, কেবল আমার খন্ডিত আইডেনটিটির, কেবল আমার স্থানিক চারপাশের। শুধু এই বোধে বলীয়ান হয়েই দীর্ঘ ইতিহাসের চাকা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে ফেলে ভূমিপুত্র রাজনীতি বা আইডেন্টিটির রাজনীতি আগের রাজনীতির ফাঁকফোঁকরগুলো বুজিয়ে নিটোল সমাধান এনে দেবে বলে আজকে মনে করা হচ্ছে।


এই ভাবে ভেবেই আসাম বা শিলং থেকে বংগালি খেদাও থেকে শুরু করে মুম্বাইয়ের বিহারি খেদাও। নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, শিকড় হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সবসময় অমূলক নয়। কিন্তু তার সমাধান কাঠামোগত ভাবে না খুঁজে সবচেয়ে দুর্বল অভিবাসী মানুষকে বিতারণ করে বা ভয় দেখিয়ে ‘সাইজ’ করে কোনওদিন আসেনি। আসার কথাও নয়। মজার ব্যাপার হল এর ফলে আসাম থেকে অধিকাংশ বাঙালি বা মুম্বাই থেকে অধিকাংশ বিহারিকে তাড়ানো যায়নি। কিন্তু, যেটা করা গেছে তাহল রাজনীতির পরিসর থেকে অন্যান্য কাজের কথাগুলোকে সরিয়ে ফেলা গেছে। যাতে বিহারি শ্রমিকের যেমন ক্ষতি হয়েছে, মারাঠি শ্রমিকেরও লাভ হয় নি। বাঙালি কৃষকের যেমন ক্ষতি হয়েছে, অসমিয়া কৃষকেরও লাভ হয় নি। এটা ভাষা অক্ষের রাজনীতির ক্ষেত্রে, অন্যান্য অক্ষের ক্ষেত্রেও ঠিক। তাই ইতিহাসে যাই ঘটে থাকুক না কেন, মধ্যবিত্ত কাশ্মীরি পন্ডিতদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে, পন্ডিতদের যেমন ক্ষতি হয়েছে, ততোধিক ক্ষতি হয়েছে কাশ্মীরি মুসলমানদের। এই ক্ষতগুলো দগদগে ঘা হয়ে নতুন রাজনীতি খোঁজার সম্ভাবনাকে মলিন করেছে। কোথাও সমৃদ্ধ করেনি।

এখন বাংলায় যে নব্য বাঙালি জাতীয়তাবাদি রাজনীতির আমদানি হয়েছে, সেটা আমাদের দেশের সহ গোটা বিশ্বের এই সময়ের ফসল। এখন ব্রেক্সিটের ব্রিটেন থেকে আমেরিকা, ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ড – সঙ্কীর্ণতম জাতীয়তাবাদ, অভিবাসী শ্রমিক বিরোধিতা ও ভূমিপুত্র রাজনীতির যুগ। ঠিক যেভাবে নব্বইয়ের দশকে আমরা বড় বাঁধ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ ও তাঁদের ঠিক করে দেওয়া ‘উন্নয়নের’ রাজনীতি-র বিরোধিতা করার বদলে, পরিবেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবার বদলে রাজ্যে রাজ্যে, দেশে দেশে জল-ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি করে সবাই মরেছি। খানিকটা তেমনই আজকে যখন চাকরি ছাঁটাই মহামারী হয়ে উঠেছে। আজকে যখন মানুষের হাতের পয়সা বড় পুঁজিপতিদের হাতে চলে গেছে। তখন আমরা ভাবছি এই সংকটের উত্তর হল, আমার বেঁধে দেওয়া গন্ডিটুকুর মধ্যে তার বাইরে থেকে আসা শ্রমিককে কাজ করতে দেব না। আমার ভাষাকে বাঁচাতে হলে আমাকে অন্য ভাষার শ্রমিককে তাড়াতে হবে। আমার সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হলে আমার ক্রোধের অভিমুখ হবে অন্য সংস্কৃতির ছাপোষা লোক। এই ধরনের সহজ টার্গেটের ওপর সংখ্যাগুরুর “জনরোষ”-এর একটা মাদকতা আছে বোধহয়। তাই কেউ কেউ প্রকাশ্যে বলছে, করছে। কিন্তু অনেকেই চুপ করে সাপোর্ট দিচ্ছে। একই সাথে আসামে এনআরসি-র বিরোধিতা করব, আবার এখানে সেই একই যুক্তিক্রমের রাজনীতি করব, দু’টোই কিন্তু চলছে। কারণ ভূগোলের সাথে বিষয়ী পাল্টে যাচ্ছে। “এখানে তুমি সংখ্যালঘু, ওখানে তুমি জমজমাট”। কিন্তু এসবের মধ্যে যেটা সুন্দর করে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা হল শ্রম আর পুঁজির দ্বন্দ্ব। রাষ্ট্র আর মানুষের দ্বন্দ্ব। এই বিষাক্ত রাজনীতি রোখার দায় ধর্মীয়, ভাষিক সংখ্যাগুরুর ওপর বেশি করে বর্তায়। সমস্যাগুলোর সমাধান সবাইকেই খুঁজতে হবে, তবে এই পথে নয়।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে