গেটস ও মোদী'র স্বচ্ছ ভারতের অস্বচ্ছতা

শনিবার, অক্টোবর ০৫, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


বিল গেটস খুবই মহান একজন মানুষ। কর্পোরেট হয়েও কটন টি শার্ট পরেন, দেখেছ কত দান ধ্যান করেন। বিল গেটস এর দানধ্যানের পরিমাণ অনেক দেশের সরকারের বার্ষিক বাজেটের থেকেও অনেক গুণ বেশি। তা তিনি নরেন্দ্র মোদী'র মত একজনকে কি না গ্লোবাল গোলকিপার প্রাইজ দিয়েছেন! ভালো লোকেরা এতে করে খুবই আশাহত হয়েছেন। বিল গেটস কে তাঁরা চিঠি লিখেছেন যাতে বিল গেটস দুষ্টু লোক মোদীকে এই প্রাইজ দিয়ে গাছে না তোলেন। ভালো লোকেরা কথাটা একেবারেই ঠিক বলেছেন। কারণ, "স্বচ্ছ ভারত অভিযান" এর নাম করে অক্ষয় কুমারের প্রোমোশন ছাড়া আর যেটা হয়েছে সেটা প্রত্যক্ষ করলে অতি বড় ভক্তেরও ধোকলার দলা গলা দিয়ে নামতে একটু বেশি জল লাগবে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এই স্বচ্ছ ভারতের নাম করে গরিব, দলিত, আদিবাসী ও মুসলমানদের ওপর মতাদর্শগত অনাচার আর ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনির খুনখারাবি অনেকাংশেই সরকারি মদতে বেড়ে চলেছে।

কী বললেন? প্রমাণ চান। আসুন কিছু নমুনা চেখে দেখুন।


নমুনা এক। রাজস্থানে গণপিটুনিতে খুন জাফর খান। বয়েস ৫৫, পেশা শ্রমিক, বাসস্থান বস্তি। অপরাধ - স্বচ্ছ ভারত কর্মচারীদের বাধা দিয়েছিলেন যাতে তারা খোলা মাঠে পায়খানা করার সময়ে মহিলাদের ছবি তুলে তাদের শেমিং না করে। এই অপরাধে জাফর খানকে পিটিয়ে মেরে ফেলে স্বচ্ছ ভারতের কর্মচারীরা। না, কেউ শাস্তি পান নি। জাফর খানের স্ত্রী (তিনিও শ্রমিক) সরকারি ক্ষতিপূরণ সরকারের মুখে ছুঁড়ে মেরেছেন।


নমুনা দুই। ম্যানহোল কর্মীরা (যারা ১০০% দলিত, না না এই পেশায় সংরক্ষণ বিরোধী বামুন-কায়েতরা চাকরির দাবিতে হইচই করেন না) বার বার পথে নেমে জানিয়েছেন যে স্বচ্ছ ভারতে প্রতি তিন দিনে একজন করে সাফাই কর্মীর ম্যানহোলে নেমে মৃত্যু হয়। এগুলি মৃত্যু নয়, হত্যা। ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। দলিত শ্রমিকদের হত্যা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কী করা যাবে বলুন, সরকারের চাঁদে যাওয়ার টাকা আছে কিন্তু ম্যানহোল সাফাইয়ের রোবট নেই। অগত্যা গ্লোবাল গোলকিপার মোদীজি ক্যামেরার সামনে পাঁচজন সাফাইকর্মীকে জড়সড় বসিয়ে তাদের পরিষ্কার পায়ে জল ঢালার অপমান করেন। কিন্তু ম্যানহোল শ্রমিকদের হত্যা হতেই থাকে। এই হত্যায় কারুর শাস্তি নেই, সেটা হয়তো সবাই জানে, এবং মানে।


নমুনা তিন। সম্প্রতি গোবলয়ের মধ্যপ্রদেশে এক নতুন ধরনের গণপিটুনির আমদানি হয়েছে। স্বচ্ছ ভারতের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনিরা এবার দলিত আর আদিবাসী শিশুদের মাঠে পায়খানা করার অপরাধে পিটিয়ে পিটিয়ে মারছে। গ্লোবাল উইকেটকিপার ঘোষণা করে দিয়েছে দেশ এখন এতই স্বচ্ছ, যে বাপুজির নাম রৌশন করতে সকলেই স্বচ্ছতার চৌকিদার। অতএব গতকাল ১৮ মাসের আদিবাসী শিশু ভগওয়ান সিং এই অপরাধে খুন হয়েছে। গত সপ্তাহে একই অপরাধে যাদবদের পিটুনিতে খুন হয়েছে ১০ বছরের অবিনাশ আর ১২ বছরের রোশনী।


"জীবনের ইতর শ্রেণীর মানুষ তো এরা সব
ছেঁড়া জুতো পায়ে
বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে।"   


অতএব গ্লোবাল গোলকিপার মোদীজির গরিবের রক্তে রাঙা হাতে গ্লোবাল মসীহা বিল গেটস কিনা প্রাইজ তুলে দিলেন।

ভালো মানুষরা হয়ত মনে রেখেছে যে বিল গেটস কয়েক দশক ধরেই ভারতের গরিব, দলিত, আদিবাসি এই তিন বর্গের মহিলাদের স্বাস্থ্যোদ্ধারের নাম করে কি লীলাখেলাই না করেছেন। ভগওয়ান সিং, রোশনী আর অবিনাশদের অতিরিক্ত ও অবাঞ্ছিত জন্মের ফলেই নাকি ওদের গরিবি - গলে পচে গন্ধ বেড়িয়ে যাওয়া এই ম্যালথুসিয় তত্ত্বের কর্পোরেট ফেরিওয়ালা বিল গেটস তার প্রবল পরাক্রমশালী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ভগওয়ান সিং, রোশনী আর অবিনাশদের মায়েদের কখনও বিপজ্জনক, প্রথম বিশ্বে বাতিল হয়ে যাওয়া কন্ট্রাসেপটিভ ট্রায়ালের গিনিপিগ বানিয়েছেন, কখনও সরকারি স্বাস্থ্যনীতিকে প্রভাবিত করে তাঁদের শরীরকে বিনামূল্যের পরীক্ষাগার বানিয়েছেন আজীবন-কাজ-করে-চলা ক্ষতিকারক হর্মোনাল কন্ট্রাসেপটিভ বেচা কোম্পানিদের জন্য। এই বহুজাতিক ফার্মা কোম্পানিগুলিকে মহানুভব বিল গেটস গ্যারান্টি দিয়েছেন ২০৩০ সালের মধ্যে কত কোটি মহিলা ক্লায়েন্ট এর কাছে তাঁরা এই কন্ট্রাসেপটিভ বেচতে পারবেন, তার। কীসের জোরে তিনি আমাদের দেশের মেয়েদের নিয়ে এই গ্যারান্টি দেওয়ার ধক রাখেন? উত্তরটা এই লেখার শুরুতেই আছে।   


মহানুভব বিল গেটসরা যে স্বাস্থ্যনীতি সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের গরিব, দলিত, আদিবাসি, সংখ্যালঘু মহিলাদের ওপর চাপিয়ে দেন, তার ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি খুন হয়েছেন অসংখ্যা মহিলা। আমাদের দৃষ্টির অগোচরে আশির দশক থেকেই এই খুনগুলি হয়ে চলেছে। শুধুমাত্র বড় বড় ঘটনা ঘটলে দু'চার দিনের জন্য তা হয়তো খবরে এসেছে, আবার হারিয়ে গিয়েছে। যেমন ২০১৪ সালে ছত্তিসগড়ে 'পরিবার পরিকল্পনা'-র নাম করে স্টেরিলাইজেশন ক্যাম্পে মহিলাদের গণহত্যা সংগঠিত হয়। গেটস সাহেবের গ্লোবাল গোলকিপিং এর টার্গেট ফুলফিলমেন্ট এর চাপ থাকে, বুঝতেই পারছেন। তাই গরিব, আদিবাসি মেয়েদের হাজার টাকা করে দিয়ে ক্যাম্পে আনা হয়েছিল। ক্যাম্পে আসার পর চড় থাপ্পড় মেরে, জোর করে ঠেলে শুইয়ে বন্ধ্যাত্ব করানো হয়। বিষাক্ত ওষুধে ১৫ ওখানেই খুন, আরো ১০০ জনের অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়ে। পরে অবশ্যই সেই খবর চাপা পড়ে যায়।


গ্লোবাল গোলকিপারদের মহাগুরু বিল গেটসরা ভারতে আরও অনেক গুরুতর খেলাতেই নিমজ্জিত। তা সে ডিজিটাল ভারতের নাম করে কৃষক ব্যাংক বা কৃষিঋণ নিয়ন্ত্রণ করাই হোক, বা সার-বীজ-চাষ নিয়ে খবরদারি করাই হোক। যেগুলিকে আপনি ভাবছেন মোদীজির স্কিম, সেগুলি বেশিরভাগই গেটসজি-দের স্কিম আসলে। টয়লেট বানানোর কেসটাও তাই।   


ভালো লোকদেরও অনলাইন পিটিশন ছাড়া কিছু করার নেই আসলে। ভারতের জনস্বাস্থ্য, ফার্মা কোম্পানি, কৃষিবিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান, স্বচ্ছ টয়লেটের ডিজাইন, ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং, আধার টাধার মিলিয়ে গরিবের রক্ত খাওয়ার গবেষণা খাতে, গেটসজি-র অনেক টাকাই ঢালা আছে। এই বিষয়ক মিডিয়ার বৃহৎ অংশেও তার টাকা কাজ করছে। অনেক সময়েই শিক্ষিত ভালো লোকদেরও এই সব ফেলোশিপের টাকায় গবেষণা, পলিসিমেকিং, সাংবাদিকতা ইত্যাদি করতে হয় বইকি।


আমাগো গুজরাতের গ্লোবাল উইকেটকিপার গেটসজি-র কাছে নস্যি।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে