শিক্ষা কে পণ্যতে পরিণত করার বিরুদ্ধে জোট বাঁধা আজ ভীষণ জরুরী

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর পড়ার সময়ে আমাদের ফি দিতে হয়েছিল সেমেস্টারে ১৮০/- টাকা। সেই টাকার মধ্যে আমাদের ল্যাবরেটরি ফি-ও হয়ে যেত। আমাদের সাবসিডিয়ারি সাবজেক্ট-এর মধ্যে ছিল কেমিস্ট্রি, যে ল্যাবে আমরা যথেচ্ছ দামি কেমিক্যাল খরচা করেছি। আমাদের অনার্স সাবজেক্ট ছিল ফিজিক্স, যাতেও থিয়োরি ক্লাস ছাড়া ল্যাবও করতে হত। এত কিছু খরচা সত্ত্বেও ওই ফি-এর টাকায় আমাদের শিক্ষার ব্যবস্থা হয়ে যেত। কী ভাবে? সরকার এই খরচা বহন করত। সরকার কোথা থেকে পেত? পাবলিকের দেওয়া করের টাকা থেকে। সেই পাবলিকের মধ্যে আমরাও তো ছিলাম। সেই পাবলিকের মধ্যে ছিলেন অসংখ্য মানুষ যাদের শ্রমে চলছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোটা দুনিয়ার চাকা। একটা বিড়ি খেলেও যারা সরকারকে কর দেন। তাদের সবার দেওয়া টাকায় চলত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। তদুপরি যাদবপুরে পড়ার সময়ে প্রাইভেট টিউশন নেওয়ার চল ছিল না। ফলে আমরা তিন বছরের গ্র্যাজুয়েশন করতে পেরেছিলাম ১৮০/- টাকা সেমেস্টার ফি জমা দিয়েই।

এর ফলে আমাদের লোন নিতে হয়নি। এর ফলে আমাদের বাড়ির কাছে হাত পাততে হয়নি। প্রথমটার বিপদের কথা অনেকে বলেন। দ্বিতীয়টার বিপদও খুবই মারাত্মক। বাড়ির কাছে হাত পেতে শিক্ষার খরচা নিতে হলে সেই 'শিক্ষার' নির্দিষ্ট প্রত্যাশার দাম চোকাতে চোকাতেও অনেক ছেলেমেয়ের ইচ্ছে-অনিচ্ছে চিরকালের মত শেষ হয়ে যায়।

সমাজ তাহলে ছাত্রদের পেছনে খরচা করল কেন? একটা প্রত্যাশা তারও কি ছিল না? ছিল তো বটেই। সমাজ খরচাটা করেছে মানুষ তৈরির কাজে। শিক্ষিত মানুষ, শিক্ষিত নাগরিক তৈরির কাজে খরচা করেছে সমাজ। সেই মানুষ, সেই নাগরিক সমাজকে ভবিষ্যতের কাজের মধ্যে দিয়ে তার দান ফিরিয়ে দেবে, বাঁচিয়ে রাখবে, অসুখ করলে সারিয়ে তুলবে, দেখভাল করবে, সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, তর্ক তুলতে পারবে, সমালোচনা ও আত্মসমালোচনা করতে পারবে, অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসা জারি রাখবে -- এই প্রত্যাশা সমাজের রয়েছে।

তাহলে ঘুরেফিরে সেই প্রত্যাশা। কিন্তু লোন কোম্পানি বা বাপমায়ের প্রাইভেট প্রত্যাশা আর পাবলিক প্রত্যাশার মধ্যে এইখানে মূলগত ফারাক রয়েছে। প্রাইভেট প্রত্যাশা নিক্তিতে মেপে প্রাইভেট মুনাফা আদায় করে নেয়। ঠিক যে হিসেবে প্রাইভেট মেডিক্যাল ইন্সিওরেন্স কোম্পানি আপনার বয়েস, পারিবারিক রোগের প্রবণতা ইত্যাদি ঝুঁকি মেপে নিয়ে সেই অনুযায়ী আপনার স্বাস্থ্য বিমায় পুঁজি বিনিয়োগ করে। ঠিক যেভাবে বেসরকারি কৃষিঋণ দেওয়ার সময়ে পুরনো বা হাল আমলের মহাজনরা হিসেব করে বুঝে নেয় কোন ফসল, কোন বীজ, কত ফলন,কৃষকের ভিটের বাজার মূল্য সবই। বিনিয়োগ করার সময় অঙ্ক কষে প্রাইভেট মুনাফার রিটার্ন বুঝে নেয়। ঠিক সেভাবেই শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রাইভেট পুঁজি বিনিয়োগ কাজ করে। সে বাপমায়ের পুঁজিই হোক বা লোন কোম্পানিরই হোক। সে ছাত্রকে একটা বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে দেখে, অতএব স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। স্বাধীন থাকতে দেয় না। স্বনির্ধারণ করতে দেয় না। তার চোখে সামাজিক ন্যায়ের কোনই মূল্য নেই, অতএব শিক্ষাব্যবস্থাকে কী করে সমতাপূর্ণ করতে হবে তা নিয়ে সে ভাবে না। সে শিক্ষার বিষয়কে বাজারের মূল্য দিয়ে মাপে, অতএব তার কাছে আজ পাবলিক সেক্টর ইকোনমিতে ইঞ্জিনিয়ারিং এর দাম আছে, কাল ফ্রি মার্কেট গিগ ইকোনমিতে 'লিবারাল আর্টস' এর। পাবলিক প্রত্যাশা এই হিসেবগুলো এভাবে কষেনা। শিক্ষায় বিনিয়োগকে মুনাফা দিয়ে মাপে না।

কেউ বলছেন, কুড়ি বছরে রোলের দাম বেড়ে গেল, জামা প্যান্টের দাম বেড়ে গেল, শিক্ষার দাম বাড়লেই এত আহাউঁহু কেন বাপু। আবার সেই একই কথা বলতে হয়। রোল, জামাপ্যান্ট আর শিক্ষা এক নয়। বরং প্রশ্নর তীরটা ঘুরিয়ে দিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। প্রশ্ন করুন এই ব্যবস্থায় কার লাভ, কার ক্ষতি? প্রশ্ন করুন, কেন লোকসভার বেশির ভাগ সাংসদ রোলের দোকান না খুলে আজকের যুগে শিক্ষাব্যবসায় প্রাইভেট পুঁজিনিবেশ করে বসে আছে? প্রশ্ন করুন কেন আজকের সমস্ত শিল্পপতি কর ফাঁকি দেওয়া সিএসআর এর টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় খুলে ডবল মুনাফা কামাচ্ছে? প্রশ্ন করুন কেন আজকে গ্লোবাল ধর্মগুরুরা শিক্ষা মার্কেটে বিনিয়োগ করছে? তারাই ঠিক করে দিচ্ছে ভবিষ্যতের নাগরিকের চরিত্র - গিগ ইকোনমিতে শাটল কক হয়ে থাকা, লোনের ভারে কুঁজো, চিন্তাভাবনায় অপারগ, এক অস্থির, অবসন্ন, বশংবদ কর্মী-বাহিনি - যে শুধু হুকুম তামিল করবে, বিরুদ্ধতা করবে না।

আমেরিকায়, ইংল্যান্ডে তো এভাবেই শিক্ষে দীক্ষে হয়...এই বলে কোঁত পারছেন যারা তারা একটু খোঁজখবর নিন কীভাবে সে ব্যবস্থা আজ ধ্বসের মুখে। এরকম সারি সারি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের দেখেছি যাদের প্রমের জন্য দামী জামা কেনার, একটা লাইফস্টাইল বজায় রাখার পিয়ারপ্রেশার আছে, কিন্তু ভোর পাঁচটায় উঠে গ্যাস স্টেশনে কাজ করে, সন্ধ্যেয় রেস্তোঁরায় বাসন মেজে এবং শিক্ষান্তে কয়েক বছর বেগার খেটে সাধারণ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কোর্সের লোন শোধ করতে হয়। তার বেশি লোন নিয়ে ফেললে প্রায় কুড়ি বছরের অবধারিত গোলামি। দূর থেকে দেখে বুঝতেই যদি হয় তো কেন লোচ-এর ছবি দেখুন। নিজের সন্তানের জন্য ওরকম ভবিষ্যত দেখা ছাড়ুন। যেখানে আন্দোলন হচ্ছে সেখানে ছাত্র আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান। যেখানে আন্দোলন হচ্ছে না সেখানে ফি-মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার আন্দোলন গড়ে তুলুন। আর সবচেয়ে বড় কথা, আপনার সন্তানকে নিজের পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে ভাবাটা বন্ধ করুন।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে