শাহীন বাগের মুসলিম মহিলাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ধাক্কায় বিজেপি আর আরএসএস রাজনৈতিক ভাবে আতঙ্কিত

বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ০৬, ২০২০ 0 Comments A+ a-

শাহীন বাগের বীরাঙ্গনারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ও গোটা ভারত কে উৎসাহিত করছেন 

গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে যে ভাবে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি), জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি (এনপিআর) ও নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯ (সিএএ), বিরোধী আন্দোলন এক দাবানলের আকার গ্রহণ করেছে, তার ফলে দৃশ্যত প্রচন্ড অস্বস্তি পোহাতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কে। এই দেশজোড়া আন্দোলন কে দুই ভাগে ভাগ করে দেখা উচিত। একদিকে আছে শুরুর কয়েক দিনের আন্দোলন, যেখানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের, বিশেষ করে মুসলিম যুবদের, চরম ভাবে নিপীড়ন করে বিজেপি'র তল্পিবাহক পুলিশ বাহিনী। এই আন্দোলন কে গায়ের জোরে দমন করে শাসকদল ভাবে, বিশেষ করে যোগী আদিত্যনাথ ওরফে অজয় বিষ্তের শাসনাধীন উত্তরপ্রদেশে, যে বিপদ টলেছে। এই দমনের সাথেই কিন্তু শুরু হয়ে যায় মুসলিম মহিলাদের লড়াই, যা মূলত দক্ষিণ পূর্ব দিল্লীর শাহীন বাগের রাস্তায় অবস্থানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়। এই শাহীন বাগের মুসলিম মহিলাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের আগুনে ঝলসে শাসক বিজেপি ও তার পৈতৃক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) যে আজ রাজনৈতিক ভাবে আতঙ্কিত তাই নয়, এর ফলে মুসলিম মহিলারা এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।

শাহীন বাগের মুসলিম মহিলাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের আদলে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয় পার্ক সার্কাস ময়দানে মুসলিম মহিলাদের অবস্থান বিক্ষোভ। পুলিশ দিয়ে সেই আন্দোলন কে বানচাল করার চেষ্টা করেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস কে পিছনে হঠতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে মাথার উপরে তাঁবু খাটাবার অনুমতি না দিয়ে, পুলিশ দিয়ে চাপ দিয়েও বন্দোপাধ্যায় কে পিছু হটতে হয়। ঠিক এই ভাবেই মুম্বাইয়ে, পুনায়, পাটনায়, বেঙ্গালুরুতে, লখনৌ এ, ইত্যাদী, নানা জায়গায় মুসলিম মহিলাদের অবস্থান বিক্ষোভ সিএএ-এনপিআর-এনআরসি বিরোধী সংগ্রাম কে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। শাহীন বাগের মুসলিম মহিলাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মঞ্চ হয়ে ওঠে ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামের এক তীর্থস্থান। নানা মতের, নানা দলের, নানা লড়াইয়ের শরিকেরা শাহীন বাগে বারবার যেতে থাকেন ও মানুষের পাশে দাঁড়াবার অঙ্গীকার করেন। নানা ধর্মের, নানা পরিধানের, নানা ভাষার ঐক্যের এক মঞ্চ হয়ে ওঠে শাহীন বাগ। দলে দলে শিখেরা এসে জমা হন শাহীন বাগের মহিলাদের পাশে, দলে দলে হিন্দুরা এসে জমা হন শাহীন বাগের মহিলাদের পাশে এটা জানান দিতে যে সব হিন্দু বিজেপি আর আরএসএসের সাথে দাঁড়িয়ে নেই। 

তাই তো শাহীন বাগের মুসলিম মহিলাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ফলে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠা মোদী ও তাঁর সাগরেদ অমিত শাহ কে গুলি চালিয়ে শাহীন বাগের আন্দোলন কে ভঙ্গ করতে ভাড়াটে গুন্ডা পাঠাতে হয়। শাহীন বাগের আন্দোলন কে নিয়ে মিথ্যার আর কুৎসার বন্যা বইয়ে দিতে হয়। যে বিজেপি কে সিএএ সমর্থন করানোর জন্যে সুন্দরী মহিলার সাথে আলাপ করানোর টোপ দিয়ে, লটারির টোপ দিয়ে, ফ্রি নেটফ্লিক্স এর টোপ দিয়ে মিসকল করাতে হয় একটি নাম্বারে, যে বিজেপি কে নিজের সভায় লোক আনতে আর ঝান্ডা বহন করতে ৫০০ টাকা থেকে ২,৫০০ টাকা মাথাপিছু খরচ করতে হয়, সেই বিজেপিই আবার শাহীন বাগের মহিলাদের ৫০০ টাকা দিয়ে ঘর থেকে আনা হচ্ছে, বিরিয়ানি খাওয়ানোর টোপ দিয়ে লোক আনা হচ্ছে বলে শোরগোল করার সাহস দেখায়। কুৎসা করে, মহিলাদের সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য করে, তীব্র ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়িয়ে বিজেপি ও আরএসএস দেশের হিন্দি-ভাষী হিন্দুত্ববাদীদের সাথে সাথে রাজনৈতিক ভাবে অপরিপক্ক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের তাঁতানোর কাজ করে চলেছে।  

যে দিলীপ ঘোষ রাজ্য জুড়ে হিংসা ছড়িয়ে, মানুষ খুন করে ভোটে জেতার চক্রান্ত করে, ডেবরায় যাঁর জোতদার পরিবার গ্রামের কৃষকদের বেঁচে থাকার শেষ রসদ শুষে নিয়ে তাঁদের ছিবড়ে করে ছেড়ে দেয়, সেই লোক আবার প্রশ্ন করার সাহস দেখায় যে শাহীন বাগের নারীরা মরছে না কেন? ঘোষ বুঝছেন না যে শীতের রাতে খোলা আকাশের নীচে বসেও পার্ক সার্কাস বা শাহীন বাগের মহিলারা কেমন করে বেঁচে থাকছেন। আসলে সঙ্ঘ পরিবারে মনের জোর কী জিনিস তার চর্চা কোনদিন হয় না কারণ যা নেই তা নিয়ে কারুর মাথাব্যথা নেই। বিজেপি ও আরএসএস এর মিছিলে লোক আনতে যখন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করতে হয়, যখন তাঁদের সমর্থকদের মদের বোতল, টাকা আর মহিলার লোভ দেখিয়ে ভোট দেওয়াতে বা দাঙ্গা করতে নিয়ে যেতে হয়, তখন তাঁদের সত্যিই বুঝতে অসুবিধা হয় যে বিনা পয়সায়, মাগনায় এত এত মানুষ সারা দেশ জুড়ে কিসের আশায় বিজেপি’র সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, গেরুয়াকরণ করা পুলিশ, আদালত, মিলিটারির বন্দুকের বিরুদ্ধে বুক পেতে দাঁড়াতে সাহস করে? 

মানুষের সংগ্রামী চেতনা যে কী বস্তু, মানুষের মাটির টান যে কী জিনিস, মানুষের জীবন সংগ্রাম ও বেঁচে থাকার লড়াই যে কী জিনিস তা শ্রম না দিয়ে লোকের ঘাড় ভেঙে খাওয়া আরএসএস-বিজেপি’র ফ্যাসিবাদী নেতা-কর্মীরা বুঝবে না। তাই তাঁরা একই মিথ্যা বার বার বলে যাবে যে শাহীন বাগের মুসলিম মহিলাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মূল ভিত্তি নাকি দৈনিক ৫০০ টাকা ও বিনা মূল্যে বিরিয়ানি খাওয়া, কারণ এই বস্তুগত, এই তাৎক্ষণিক লাভের চেয়ে বেশি এদের নিজেদের রাজনীতি এদের আর কিছু দেখতে দেবে না। তাই যাঁরা দেশের ছাত্রদের ঘৃণা করে, দেশের প্রতিবাদী গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো কে ঘৃণা করে, তাঁদের কাছ থেকে ফ্যাসিবাদ ছাড়া আর কিছু আশা করা কি একদমই অনুচিত নয়? বিজেপি শুধু শাহীন বাগ  কে নির্বাচনী টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে মেরুকরণের স্বার্থে তা আজ শোষিত মানুষের পরিবারের ছোট বাচ্চারাও বলে দিতে পারবে। 

শাহীন বাগের মুসলিম মহিলাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ঠিক-ভুল বিচার করার কোন অধিকার না থাকলেও মোদী ও তাঁর চামচারা ক্রমাগত ভাবে দিল্লীর বিধানসভা নির্বাচনে এই আন্দোলন সম্পর্কে কুৎসা করে যাচ্ছে। মুসলিম-বিদ্বেষী প্রচার প্রতি মুহূর্তে করে চলেছে। দিল্লী শহরে চিরকাল যেহেতু নির্বাচনে সাবর্ণ ধনী ও উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজের রমরমা চলে এসেছে, তাই এই শহরে ৫৫.১৬% ভোট পেয়ে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি হাসতে হাসতে জিতে যাওয়া কাউকে অবাক করেনি। বিধানসভা ভোটের আগে শাহীন বাগ কে পাকিস্তানের সাথে এক করে দেখিয়ে মানুষের মনে ইসলামবিদ্বেষ কে যে বাড়ানো হয়েছে আর এর ফলে ভোটের বাক্সে মেরুকরণের প্রভাবে যে আম আদমি পার্টির (আপ) এর ভোট কেটে যাবে সে কথা স্বয়ং অরবিন্দ কেজরিওয়াল’ও বুঝছেন। তাই এই দিল্লী শহরে জলের কথা না বলেও, স্বাস্থ্যের কথা না বলেও, মানুষের রোজগারের কথা না বলেও, শিক্ষার কথা না বলেও, বিজেপি শুধু ধর্মের নামে সুড়সুড়ি দিয়ে ঘৃণা ছড়িয়ে নির্বাচন জেতা যে সম্ভব সে কথা বুক বাজিয়ে প্রমাণ করে। আর এই চাপে পড়ে আপ ও কংগ্রেসও যেভাবে নিজেদের মুসলিমদের থেকে দূর করতে সচেষ্ট হয় তা দেখেই বোঝা যায় যে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের ষোলো আনার উপর আঠারো আনা উসুল হয়েছে।

যেহেতু ইসলাম বিদ্বেষ মানে ভোট, আর ভোটে জেতা মানে শুধু ক্ষমতা পাওয়াই নয় বরং জনসমর্থন আর পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা দেখিয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর থেকে মোটা অর্থ অর্জন করাও, তাই বিজেপি শাহীন বাগের মুসলিম মহিলাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ঘটনা কে কালিমালিপ্ত করতে কোন প্রচেষ্টা বাকি রাখেনি। “গোলি মারো সালো কো” বলে স্লোগান দেওয়া থেকে শুরু করে যে আদিত্যনাথ নিজের রাজ্যে হয় শিশুদের মিড ডে মিলে রুটি আর নুন খাওয়ায় অথবা না খাইয়েই মেরে ফেলে, সেই আদিত্যনাথ এসে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী’র বিরুদ্ধে শাহীন বাগের মুসলিম মহিলাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মঞ্চে বিনামূল্যে বিরিয়ানি সাপ্লাই করার অভিযোগ তোলেন। যদিও কেজরিওয়াল সেই অভিযোগ নিজের হিন্দু ভোট বাঁচাতে অস্বীকার করেছেন, তবুও ক্ষুধার্ত মানুষদের বিরিয়ানি খাওয়ানো যে শিশুদের অনাহারে মেরে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মূর্তি তৈরি করার চেয়ে অনেক ভাল কাজ তা এই তথাকথিত ভন্ড সন্যাসী কে কী ভাবে বোঝাতে পারে সেটাই দেখার।

আজ যে ভাবে শাহীন বাগের মুসলিম মহিলাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের অনুকরণে সারা দেশের পাসমন্দা মুসলিম মহিলারা সব ধ্যান ধারণার জাল ভেদ করে, সকল পথ রোধকারী বেড়া টপকে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজের অস্তীত্ব কে প্রতিষ্ঠা করছেন তাঁদের অভূতপূর্ব আন্দোলনের মাধ্যমে, তা শুধু মুসলিমদের নয়, শুধু মহিলাদের না, বরং সকল প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির নতজানু হয়ে শেখা উচিত। আজ যে ভাবে কুৎসিত আক্রমণ, ইসলামবিদ্বেষ ও ক্রমাগত ভাবে ভীতি প্রদর্শনের শিকার হতে হচ্ছে শাহীন বাগ কে তার থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গড়ে ওঠা আন্দোলন, যার মূল ভিত্তিটা আসলে রাজনৈতিক  ভাবে রক্ষণশীল, যার লক্ষ্য হলো শোষণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ভারত রাষ্ট্র কে শাসকশ্রেণীর বানানো সংবিধানের ঘেরাটোপের মধ্যে আটকে রেখে জনগণের সাংবিধানিক অধিকারগুলোর শুধু রক্ষা করা আর নতুন কোন গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বানানো নয়, সেই আন্দোলন কিন্তু কমিউনিস্টদের বাদ দিয়ে গড়ে উঠলেও মানুষের অধিকারের ব্যাপারে নানা জরুরী কথা বলছে। আর তাই এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনগুলো কে ধ্বংস করতে শাসকশ্রেণী ও বিজেপি কিন্তু লোকবল, অর্থবল, সশস্ত্র বাহিনী, প্রভৃতি নিয়ে আক্রমণ করলেও কিন্তু মানুষের স্পর্ধা কে ধ্বংস করতে পারবে না। শাহীন বাগের মহিলাদের মাথা ঝোঁকাতে পারবে না। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে