এনআরসি ও সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা কী?
ডিসেম্বর ২০১৯ সালে নিজের দম্ভের জোরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী’র সরকার সংসদের দুই কক্ষে পাশ করে সিটিজেনশিপ (এমেন্ডমেন্ট) বিল, ২০১৯, বা নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০১৯, যা ক্যাব নামে পরিচিত ছিল। সংসদে পাশ হওয়ার পরেই এটি আইন হয়ে যায় এবং নাম হয় সিটিজেনশিপ (এমেন্ডমেন্ট) এক্ট, ২০১৯, বা সিএএ ২০১৯। সারা দেশ জুড়েই এই বিল নিয়ে একটা বিতর্ক ছিল, বিশেষ করে আসাম ও উত্তর পূর্ব ভারতে এই বিলের বিরুদ্ধে মানুষের তীব্র গণআন্দোলন গড়ে ওঠে ২০১৬ থেকেই, যা ২০১৮ সালে একটা ব্যাপক আকার ধারণ করে। মানুষের বিরোধিতা কে অগ্রাহ্য করে, শুধু শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি’র (বিজেপি) সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মোদী ও তাঁর দোসর, গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ, এই বিল কে আইনে পরিণত করেন ২০১৬ সালে গঠিত জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির রিপোর্ট কে কাঁচকলা দেখিয়ে। আর ঠিক তার পরেই সারা ভারতবর্ষ জুড়ে জ্বলে ওঠে গণআন্দোলনের এক দাবানল যা বীভৎস রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সাহায্যেও দমন করতে অক্ষম হয় ভারতের শাসক শ্রেণী।
আসাম থেকে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা থেকে উত্তরপ্রদেশ বা সুদূর কর্নাটকে ছড়িয়ে পরে আন্দোলন। দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ঝাঁপিয়ে পড়েন আন্দোলনে। ব্যাপক পুলিশী সন্ত্রাস দিয়ে এই আন্দোলন কে দমন করার চেষ্টা করে রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি সরকার। আসামের সর্বানন্দ সোনোয়াল থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের সরকার, নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চালাতে কেউই কার্পণ্য দেখায়নি। বহু মানুষের মৃত্যু হলেও আন্দোলন কিন্তু শেষ হয়নি, বরং সকল চোখ রাঙানি কে উপেক্ষা করে দিল্লী শহরের শাহীন বাগ থেকে শুরু করে কলকাতার পার্ক সার্কাস অবধি সংগ্রাম চলছে। নিরন্তর চলছে।
সিএএ ২০১৯-র আওতায় ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে পালিয়ে আসা হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও পার্সি শরণার্থীরা, অর্থাৎ যাঁরা ফরেনার্স এক্ট, ১৯৪৬ এর ১৯৪৮ এর রুলস-এ, এবং পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশ) আইন, ১৯২০-র ১৯৫০-র রুলস-এ ছাড় পেয়ে গেছেন, আর নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০০৩ বা সিএএ ২০০৩-র আওতায় "বেআইনী অভিবাসী" হিসাবে চিহ্নিত হবেন না ও ভারতের নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করার যোগ্য হলেন, এবং পূর্বের ১২ বছরের জায়গায় মাত্র পাঁচ বছর ভারতে থাকার প্রমাণ দেখালেই নাগরিকত্ব দেওয়ার গ্যারান্টি দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট করে মুসলিম সম্প্রদায় কে এই আইনের বাইরে রাখা হয় যার ফলে সারা দেশের মুসলিমদের কাছে একটা বার্তা যায় যে ভারত সরকার আসামের ন্যায় সারা ভারতে জাতীয় নাগরিকত্ব পঞ্জী (এনআরসি) করবে এবং তাতে বাদ পড়ে যাওয়া সকল অমুসলিমদের কে পুনরায় নাগরিকত্ব দেওয়া হলেও মুসলিমদের জোর করে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হবে। এর ফলে উদ্বেলিত মুসলিম সমাজ সারা দেশে রাস্তায় নেমে আসে। মুসলিমদের সাথে সাথে আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারত জুড়ে অবাঙালি ও আদিবাসী সমাজের মানুষেরা রাস্তায় নেমে আসেন সিএএ ২০১৯-র মাধ্যমে আসামের বিজেপি সরকারের দ্বারা বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার অভিযোগ তুলে।
এই সিএএ ২০১৯-বিরোধী আন্দোলন আজ দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে শাহীন বাগ হয়ে কলকাতার পার্ক সার্কাস দিয়ে সোজা গিয়ে মিলেছে বোম্বাই শহরের মুমব্রা অঞ্চলে। পাটনার থেকে শুরু করে সুদূর বেঙ্গালুরু আর পুনে শহরে পৌঁছেছে। নানা জায়গায় পথে মানুষ নেমেছেন, পথেই পথ চলা শিখছেন আর নতুন নতুন কায়দায় অভূতপূর্ব আন্দোলন গড়ে তুলছেন। প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী কে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে করে রাজ ভবন যেতে হয় আর গোটা কলকাতা আকাশ পথে ভ্রমণ করতে হয় কারণ রাজপথে তখন লক্ষ মানুষের মিছিল। ছাত্র-যুব থেকে শুরু করে গৃহবধূ আর শ্রমিকেরা, পাঞ্জাবের কৃষকদের থেকে শুরু করে দিল্লীর রিকশাচালকেরা, সবাই আজ হাতে হাত মিলিয়েছেন মোদী সরকারের দম্ভের দাঁত ভাঙতে। এই প্রতিরোধ আর প্রতিবাদের উত্তাল সময় দেখে প্রশ্ন ওঠে, মোদী এই আইন আনার সাহস পেল কী করে? আর এই অভূতপূর্ব গণজাগরণের মুহূর্তে কমিউনিস্টদের করণীয় কী?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে সাম্প্রতিক কালের রাজনৈতিক ইতিহাসে। জ্যান্ত ব্যাঙ কে সসপেনে সেদ্ধ করার মতন ভারতের জনগণের তাপ সহ্যের ক্ষমতা মেপে দেখতে মোদী সরকার একের পর এক জন-বিরোধী সিদ্ধান্তের বোঝা মানুষের কাঁধে চাপায় কায়দা করে। কখনো জম্মু ও কাশ্মীর সম্পর্কিত ধারা ৩০৭ অবলুপ্ত করে, কখনো রাম মন্দির গড়ার জন্যে বাবরি মসজিদের জমি দখলের নীতি কে সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে বৈধতা পাইয়ে দিয়ে, কখনো বা গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে বা মজুরি কমিয়ে, মোদী সরকার চেষ্টা করে ভারতের মানুষের বিস্ফোরিত হওয়ার ক্ষমতা মাপতে। বারবার জনগণ চুপ করে থাকায়, অথবা বিজেপি ও তার চালিকাশক্তি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) দ্বারা চালিত সাম্প্রদায়িক প্রচারে মেতে ওঠায়, মোদী ও শাহ মনে করে যে কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপেরই আর বিরোধিতা এই দেশে হবে না। অথচ ভারতের মানুষ, বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ, বিজেপি’র সমস্ত ছক বানচাল করে দিল। সারা দেশ জুড়ে মানুষের যে গণআন্দোলনগুলো স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গড়ে উঠেছে তা প্রথমে বিজেপি’র অবজ্ঞা ও বিদ্রুপের পাত্র হলেও আজ প্রকাশ্যে মোদী সরকার ও বিজেপি-আরএসএস এটা প্রমাণ করছে যে এই আন্দোলনগুলির ফলে তারা কিন্তু চরম ভাবে আতঙ্কিত। দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনে চরম ভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা করেও যে ভাবে ধাক্কা খেতে হয়েছে মোদী ও বিজেপি কে তা প্রমাণ করেছে যে এখনো হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
অন্যদিকে যদি আমরা কমিউনিস্টদের দেখি, অর্থাৎ সিপিএম ও তথাকথিত বামফ্রন্ট মার্কা ভোট পার্টিগুলোর বাইরে চেয়ে দেখি, তাহলে দেখবো যে গতিতে আজ ছোটা উচিত, যে তীব্রতার সাথে আজ মানুষের মধ্যে গিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনের কথা বলা উচিত, যে ভাবে খেটে খাওয়া মানুষ কে সংঘবদ্ধ করে এক বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত, তা না করে, অনেকটা বিভ্রান্তের মতন অনেক কমিউনিস্টরা আজ আচরণ করছেন। নানা ফাঁদে পড়ে গিয়ে তাঁরা লক্ষ্য ও আশু লক্ষ্যের সুক্ষ পার্থক্য বুঝতে অপারগ হচ্ছেন এবং এর ফলে অনেক জায়গায় তাঁরা ধাক্কা খাচ্ছেন এবং উদারনৈতিক গণতন্ত্রীরা, পরিচয় রাজনীতির কান্ডারীরা এসে নেপোয় মারে দই করে যাচ্ছে।
অথচ কমিউনিস্টদের পক্ষে, বিপ্লবী শ্রেণী সংগ্রামের পক্ষে এই পরিস্থিতি আসলে এক ভীষণ অনুকূল পরিস্থিতি কারণ জনগণ আজ রাজনীতি শুনতে চাইছেন। যাঁরা আন্দোলনে আছেন তাঁরাও, আর যাঁরা নেই তাঁরাও। তবে এই দশচক্রে ভগবান ভূত হওয়ার মতন আজ কিন্তু ব্যাপক জনজাগরণের মধ্যেও কমিউনিস্টরা খেই হারিয়ে ফেলছেন, হাল ধরতে অপারগ হচ্ছেন কারণ শ্রেণী সংগ্রামের রাজনীতির কম্পাস তাঁরা ঠিক ভাবে ব্যবহার করতে চাইছেন না, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নিরিখে ঘটনা ও রাজনীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ না করে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়ছেন স্বতঃস্ফূর্ততার লেজুড় হতে, আর এর ফলে তাঁরা ঠিক সেই ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন যে ভাবে তাঁদের শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন দালালেরা ব্যবহার করতে চাইছে।
গোটা দেশজুড়ে এনআরসি ও সিএএ ২০১৯ নিয়ে অনেক ধরণের প্রচার চলছে এবং তাদের মূল বক্তব্য, যা কংগ্রেস থেকে সিপিএম, তৃণমূল থেকে স্বরাজ দল সবাই এক ভাষায় বলছে তা হল যে এই দুইটি মুসলিম-বিরোধী এবং এনআরসি বা সিএএ ২০১৯-তে ব্যাপক ভাবে ক্ষতি হবে মুসলিমদের। এর মধ্যে অর্ধ সত্য থাকলেও, পূর্ণ সত্য নেই। তবে এই অর্ধ সত্যের কোপে পড়ে শিকার হচ্ছেন অনেক কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা এবং তাঁরাও ক্রমাগত পরিচয় রাজনীতির বেনোজলে ভেসে যাচ্ছেন। আসলে শ্রেণী সংগ্রামের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে, মার্কসবাদী বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এনআরসি আসলে শাসক শ্রেণীর হাতিয়ার গোটা দেশজুড়ে রাষ্ট্রহীন কোটি কোটি দাসশ্রমিক তৈরি করার, যাঁদের শ্রমের মূল্য নিয়ে দর কষাকষি করার ক্ষমতা থাকবে না, এবং সস্তায় শ্রম বেচে যাঁরা দুই মুঠো খেয়ে বেঁচে বর্তে থাকতে চাইবে। তাঁদের শ্রমের উপর ভিত্তি করে শুধু যে সঙ্কটগ্রস্ত বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি ও তার দালাল ভারতীয় গুজরাটি-মাড়োয়ারি বেনিয়া মুৎসুদ্দিরা যে নিজেদের মুনাফার পাহাড় উঁচু করবে তাই নয়, যাঁদের নাম এনআরসি-তে কাটা যাবে না, যাঁদের নাগরিকত্ব বেঁচে যাবে, তাঁদেরও চরম সঙ্কটে পড়তে হবে কারণ কোটি কোটি সস্তা, দর কষাকষি করার ক্ষমতাহীন শ্রমিক-কর্মচারী থাকার ফলে তাঁদেরও দর কষাকষির ক্ষমতা হয় হ্রাস পাবে না হয় লুপ্ত হবে।
আর কাদের নাম এই এনআরসি তালিকা থেকে বাদ যাবে? প্রায় ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ আসামে এনআরসি তালিকায় নাম তুলতে আবেদন করেন যাঁদের মধ্যে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম ওই তালিকা থেকে বাদ যায়। খবরে প্রকাশ তাঁদের প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ বাঙালি হিন্দু, যাঁদের বিজেপি সিএএ ২০১৯-র প্রলোভন দিচ্ছে। প্রায় সাড়ে ছয় লক্ষ মানুষ হলেন বাঙালি ও আসামি মুসলিম, ও প্রায় ৫০ হাজার মানুষ হলেন গোর্খা, বিহারি, ইত্যাদী জাতির মানুষ। প্রায় বেশির ভাগ মানুষই কিন্তু প্রান্তিক, গরিব মানুষ। শ্রমিক, দিন মজুর, ভূমিহীন কৃষক, চা বাগানের শ্রমিক, যাযাবর, ও অন্যান্য গরিব মানুষ এই তালিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। এর কারণ হিন্দু বা মুসলিম যে কোন ধর্মের ধনীদের ক্ষমতা আছে ঘুষ খাইয়ে বা টাকা খরচ করে সমস্ত জরুরী কাগজ জোগাড় করার, যা গরিব, নিঃস্ব, দৈনতার সাথে যুদ্ধ করে কোন ভাবে টিকে থাকা মানুষদের নেই। তাই তাঁদের বেশির ভাগের স্থান হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে।
ভারত সরকার সারা দেশে এনআরসি করবে সিএএ ২০০৩-র সাহায্যে, যা পাশ করতে এক কালে অটল বিহারি বাজপেয়ী ও লাল কৃষ্ণ আদবানি কে সাহায্যে করেছিল মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, সহ নানা দল, যাঁদের অনেকেই এখন মুখে এই এনআরসি-র বিরোধিতা করছেন। রাজীব গান্ধীর মতন কংগ্রেস নেতাই কিন্তু একদিন আসামে এনআরসি করার চুক্তি আসাম আন্দোলনের জঙ্গী নেতৃত্ব কে সন্তুষ্ট করতে সই করেন। এনআরসি আসামে হয়েছে আসাম চুক্তি, ১৯৮৫, এর অনুসারে এবং তাতে ভারতে প্রবেশের শেষ তারিখ ছিল ২৪শে মার্চ ১৯৭১। সারা ভারত এনআরসি প্রকল্পে কোন নির্দিষ্ট তারিখ কিন্তু ঘোষিত হয়নি। এইটা আমাদের একটি বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কারণ এর ফলে শুধু উদ্বাস্তু নয় বরং অসংখ্য মূলনিবাসী, আদিবাসী মানুষও প্রচন্ড সঙ্কটে পড়বেন।
একজন যদি ২৬শে জানুয়ারী ১৯৫০ থেকে ৩০শে জুন ১৯৮৭ অবধি ভারতে জন্ম গ্রহণ করে থাকেন তাহলে হয় তাঁদের জন্ম প্রমাণপত্র দেখাতে হবে, যা অসংখ্য মানুষের পক্ষে সম্ভব না কারণ ১৯৬৯ সালে জন্ম ও মৃত্যু পঞ্জীকরণের কাজ শুরু হয়। এবার যে সব মানুষের বার্থ সার্টিফিকেট নেই তাঁদের প্রমাণ করতে হবে যে তাঁদের পূর্বপুরুষ ভারতে সংবিধান গ্রহণের সময়ে, অর্থাৎ ১৯শে জুলাই ১৯৪৮ এর আগে, ভারতে প্রবেশ করেছেন সংবিধানের ৬ (বি) ধারা অনুসারে অথবা ১৯৫১-৫২ এর নির্বাচনের ভোটার তালিকায় তাঁদের পূর্বপুরুষের নাম ছিল। এই সংক্রান্ত তাঁদের অবশ্যই আসামের লোকেদের মতন ফ্যামিলি লিগ্যাসি প্রমাণ করতে হবে, যা গরীব মানুষের পক্ষে সম্ভবই না।
যাঁদের জন্ম ১লা জুলাই ১৯৮৭ থেকে ডিসেম্বর ২০০৪ অবধি তাঁদের নিজেদের বার্থ সার্টিফিকেটের সাথে দেখাতে হবে পিতা বা মাতার মধ্যে কারুর তাঁর জন্মের সময়ে ভারতীয় হওয়ার প্রমাণ। আর ২০০৪ এর ডিসেম্বর থেকে যাঁদের জন্ম তাঁদের দেখাতে হবে পিতা বা মাতার একজনের ভারতীয় নাগরিকত্ব ও অন্য জন যে "বেআইনি অভিবাসী" নন সেটাও প্রমাণ করতে হবে। এর ফলে উদ্বাস্তুরা তো বটেই, চরম সমস্যায় পড়বেন মূলনিবাসী ও আদিবাসীরাও। যেহেতু উদ্বাস্তুরা, বিশেষ করে মতুয়ারা নাগরিকত্ব পাননি তাই তাঁদের সাথে সাথে তাঁদের সন্তানেরাও "বেআইনি অভিবাসী" হিসাবে চিহ্নিত হবেন।
বিজেপি দলের কর্মসূচীতে এনআরসি থাকলেও, আন্দোলনের চাপে পড়ে মোদী সরকার কে ঘোষণা করতে হয় যে এনআরসি নিয়ে কেন্দ্রের কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই এটা স্পষ্ট যে সিএএ ২০১৯ আসা বা না আসার সাথে এনআরসি কর্মসূচীর কোন সম্পর্ক নেই। সিএএ ২০১৯ ছাড়াও এনআরসি হবে আর তা সিএএ ২০০৩-র কারণেই হবে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কিন্তু সব জাতির গরিব মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ যাঁরা কাগজ আর দলিলের এক চক্রব্যূহে ফেঁসে সারা জীবন হয় সরকারি দফতরে কপাল ঠুকবেন আর না হয় ডিটেনশন সেন্টারের খুপরিতে। তাহলে সিএএ ২০১৯-তে লাভ পাবেন কারা?
ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো বা আইবি ও রিসার্চ এন্ড এনালিটিক্যাল উইং বা র’ কিন্তু জানিয়েছে মাত্র ৩১,৩১৩ জন মানুষ এই আইনের আওতায় আসবেন এবং নাগরিকত্ব পাবেন। বাকিটা একটা ধোঁয়াশা। সিএএ ২০১৯ আনা হয়েছে কারণ মুসলিমদের এটা বোঝাতে যে এনআরসি হলে তাঁরা বাদ যাবেন, যার ফলে তাঁরা বেশি করে আন্দোলন করবেন, অন্যদিকে একই সময়ে হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিম মানুষদের বোঝানো হবে যে এনআরসি আসলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আর তাঁদের ভয়ের কিছু নেই কারণ নাম কাটা পড়লে সিএএ ২০১৯ দিয়ে ফেরত আসা যাবে। তবে যেহেতু সিএএ ২০১৯ ভারতীয়দের জন্যে নয়, বরং আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের জন্যে, তাই যে ভারতীয় গরিব মানুষ সিএএ ২০১৯ দিয়ে নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার দিবাস্বপ্ন দেখছেন, তাঁরা ভীষণ ভাবে আঘাতগ্রস্ত হবেন। আর এই ভাবে অমুসলিমদের, যাঁদের বেশির ভাগই হলেন গরিব দলিত-নমঃশুদ্র, আদিবাসী বা ব্যাপক খেটে খাওয়া শোষিত জাতির হিন্দু, বোকা বানিয়ে বিজেপি এনআরসি-বিরোধী লড়াই থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। মুসলিম আন্দোলন বলে সকল সিএএ ও এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন থেকে কায়দা করে নমঃশূদ্র, আদিবাসী ও শোষিত সমাজের মানুষদের দূরে রাখা হচ্ছে। মুসলিমদের সিএএ-বিরোধী আন্দোলন কে প্রতিবেশী ইসলামিক দেশগুলো থেকে আগত অমুসলিম শরণার্থীদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে গরিব, দলিত ও শোষিত জাতির মানুষের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ কে তীব্র করাও হচ্ছে বিজেপি ও আরএসএস এর পরিকল্পনা অনুযায়ী।
কমিউনিস্টদের কর্তব্য হল এই মুহূর্তে সব গরিব মানুষের কাছে পৌঁছানো। সে হিন্দু হোক, শিখ হোক, দলিত-নমঃশূদ্র হোক, আদিবাসী হোক বা মুসলিম, যে বা যারা গরিব, শ্রমজীবী, দুই বেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে যাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় আর বুকের রক্ত মুখ দিয়ে বের করতে হয়, সেই মানুষদের কাছে। কারণ এনআরসি হল এই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে টাটা, আম্বানি, আদানীদের যুদ্ধ ঘোষণা। বারবার এনআরসি-বিরোধী, সিএএ-বিরোধী লড়াইয়ে ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স খোঁজার চেষ্টা না করে, জাতি ও ধর্মীয় পরিচিতির রাজনীতির গন্ডিতে ফেঁসে না গিয়ে, তাঁদের উচিত শ্রেণীর সাথে লেগে পড়ে থাকা। রাজনীতি দিয়ে মানুষ কে শিক্ষিত করে তোলা ও তাঁদের শ্রেণী সংগ্রামের ময়দানে সামিল করাবার প্রচেষ্টা চালানো। এই কাজ করতে গেলেই, এমনকি যাঁরা হয়তো এনআরসি ও সিএএ ২০১৯-বিরোধী আন্দোলনে এক সাথে আছেন, তাঁরাও, বিরোধিতা করবেন। এনআরসি যে আদতে দেশের গরিবদের উপর আক্রমণ আর এর যে কোন ধর্মীয় পরিচয় নেই তা মেনে নিতে চাইবেন না অনেকেই। তাহলে কী কমিউনিস্টদের সঠিক কথাটা বলা উচিত হবে না?
এই দ্বিধায় পড়েই অনেক কমিউনিস্ট দীপ্ত ভাবে লড়ছেন না সমস্ত ভুল চিন্তার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। তার ফলে বারবার করে এনআরসি ও সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে কমিউনিস্টরা যোগদান করেও কোন বিরাট মৌলিক পরিবর্তন, এমন কী কিছু জায়গায় হলেও, ঘটাতে পারছেন না ও অনেকে হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত পরিচয় রাজনীতির পাঁকে ঝাঁপ দেওয়া সঠিক বলে মেনে নিচ্ছেন। এই সমস্যা রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা ও সংশোধনবাদী রাজনীতির প্রভাবের ফল। এর ফলেই শ্রেণী সংগ্রাম গড়ার কঠিন রাস্তা ছেড়ে শুধু মুসলিম পরিচয়ের রাজনীতি করে সস্তায় আর সহজে, রক্ত উৎসর্গ না করেই, বিজয় লাভের দিবা স্বপ্ন অনেক তথাকথিত কমিউনিস্টরা দেখছেন যা অচিরেই তাঁদের চরম সুবিধাবাদের গড্ডালিকায় পড়ার পথ প্রশস্ত করছে।
কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব করতে আগ্রহী মানুষদের আজ এই সুযোগে গ্রাম থেকে শহরে সকল গরিব মানুষ কে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী জোটে যোগদান করানো জরুরী, এবং এই লড়াই কোনদিনই সহজ ছিল না বা হবে না। কঠিন সংগ্রাম, আপসহীন ভাবে শ্রেণীর রাজনীতি কে প্রাধান্য দিয়ে ও সুবিধাবাদের নানা উৎসর্গের বিরুদ্ধে লড়াই করেই সম্ভব গরিব মানুষ কে কর্পোরেটদের কেনা গোলামে পরিণত হওয়ার থেকে রোখার। স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের লেজুড় না হয়ে কমিউনিস্টদের উচিত প্রতিরোধের স্বতস্ফূর্ততা সৃষ্টি করা, যা গরিব মানুষ কে শোষক শ্রেণীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত করবে, তাঁদের দেবে প্রতিরোধের হিম্মত ও ধনিক শ্রেণী কে ধুলো চাটাবার ক্ষমতা। শুধু মাত্র কঠিন অধ্যবসায়ে ও পরিশ্রম দিয়েই গড়ে তোলা যাবে একটি সচেতন, দূরদর্শী, সাহসী ও ব্যাপক শ্রেণী সংগ্রাম, সেই শ্রেণীগুলো কে উচ্ছেদ করতে যাঁরা নিজেদের সিন্দুকে ধনের বোঝা বাড়াতে ১২-১৩ বছরের বাচ্চাদের শ্রম শোষণ করতে লজ্জিত হয় না।