লেনিন ১৫০ বছরেও পুরানো হননি, শেখাচ্ছেন বর্তমানে কী করতে হবে
এই বছর ২২শে এপ্রিল ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ ওরফে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা, শিক্ষক, দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক লেনিন ১৫০ বছর পূর্ণ করলেন। যদিও লেনিনের বয়স হয় না আর লেনিনবাদ কোনদিন পুরানো হয় না, তাই এই এত বছর পরেও লেনিন কেন দুর্বার তা নিয়ে বাকি সবার মতন তাত্ত্বিক ঘ্যান ঘ্যান না করে বা পুরানো কাসুন্দি না ঘেটে চেষ্টা করছি অল্প কিছু কথায় লেনিনের বর্তমান যুগে কী ভূমিকা তা নিয়ে একটু মস্তিষ্কের শ্যাওলা জমা অঞ্চলে আঁচড় কাটার।
ওই যে বললাম, লেনিন বুড়ো হন না, তাঁর বয়েস বাড়ে না, তবে লেনিন আর লেনিনবাদের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে করতে অনেকের চুল পেকে যায়, চুল পড়েও যায় আর আবার চোখে ছানিও পড়ে যায়। তবুও তাঁদের অনেকেই আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, মানে যখন মাথার উপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল আর মাও সেতুঙের মুখে জ্বলন্ত সিগারেট ছিল, তখন থেকেই সেই একই কথা বলে আসছেন, লেনিন কে নাকি ঠিক করে বুঝে প্রয়োগ করতে হবে। লেনিন নিয়ে অবশ্য সবারই এক এক ধরণের মতাদর্শগত স্ট্যান্ডপয়েন্ট বা দলীয় লাইন আছে।
ধরুন আপনি বললেন যে আপনি ভোট বিরোধী, সশস্ত্র বিপ্লব করতে চান, পার্লামেন্ট বয়কট করতে চান তাহলে কিন্তু আপনাকে ধরতে হবে লেনিন কে। লেনিনের নির্বাচন বয়কটের ডাক, লেনিনের বলশেভিক বিপ্লবের ডাক আর পার্লামেন্ট কে শুয়োরের খোঁয়াড় বলা হল আপনার অমোঘ হাতিয়ার। অন্যদিকে ধরুন আপনি খেয়েদেয়ে উঠে ভাবলেন একটু বামপন্থী রাজনীতি করবেন দুপুর বেলা না ঘুমিয়ে আর নির্বাচন লড়বেন এবং অবশ্যই যাঁরা নির্বাচন বয়কট করতে হবে বলে গোল করছে তাঁদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম করবেন, তবুও আপনার লেনিন চাই। সেই “লেফট উইং কমুনিজম — এন ইনফ্যান্টাইল ডিসর্ডার” আপনাকে কোট করতে হবে, বারবার লেনিনের ডুমা কে ব্যবহার করার কথা বলে মানুষ কে বোঝাতে হবে যে বিপ্লব-টিপ্লব না বরং ভোটই আসল হাতিয়ার।
সে যাই হোক, আপনার দেওয়ালে শুধুই কার্ল মার্কস, ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস আর ভই লেনিন টাঙানো, নাকি লেনিনের পরে যোসেফ স্তালিনও শোভা পান, নাকি মাও সেতুঙ’ও আছেন সবার শেষে সে কথা আপনিই ভাল জানেন। তবে এখানে যেটা নিয়ে আলোচনা আমায় সেই বিষয়ে ফিরতে হবে। লেনিন ১৯০২ সালে “কী করতে হবে?” নামক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত করেন যাতে তিনি বার্নস্টাইন এর মার্কসবাদ কে সমালোচনা করার স্বাধীনতার দাবি’র বিরোধিতা, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের লেজুড়বৃত্তি করা, প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন এবং সেই প্রবন্ধের একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি হল — “বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন হয় না।”
যেহেতু বর্তমানে আমাদের দেশের, বা সমগ্র বাংলার বুকে কাজ করা নানা ধরণের বামপন্থী সংগঠনগুলো “সময়ের অভাব” বা কোন টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে নিজেদের দলের নতুন বা পুরানো রিক্রুটদের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূলগুলো নিয়ে তাত্ত্বিক শিক্ষা না দিয়ে চে গেভারা’র ডায়েরি, কমিউনিস্ট পার্টি’র ইস্তাহার, গান্ধী, আম্বেদকর আর দেশের সংবিধানের পাঠ দিয়েই শর্টকাটে তাঁদের পথে নামান তখন বোঝাই যায় যে আসলে কী ধরণের বিপ্লব করার ইচ্ছা তাঁরা পোষণ করেন। এই গল্পে সিপিআই (এম) বা সিপিআই জাতীয় দল কে গণ্যও করলাম না। ফলে আজ তত্ত্বের দিশাহীনতা নতুন কর্মীদের কর্মউদ্যোগের পথে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার কর্মীদের মধ্যে তত্ত্ব শেখাবার যে প্রয়াস করা উচিত একটি নেতৃত্বের তাও সব জায়গায় দেখা যায় না বোধহয় দল থেকে বোর হয়ে লোক পালিয়ে যাবে এই ভয়ে।
তাই আজ যেহেতু তত্ত্বের বালাই নেই তাই যা কিছু একটু যুক্তি বা গল্প দিয়ে দাঁড় করানো যায় তাই তত্ত্ব হয়ে যায়। ফলে বিনা শ্রেণী সংগ্রাম করেই দাবি ওঠে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে ও ভারত উপমহাদেশ থেকে জাতপ্রথা কে উচ্ছেদ করার। কী করে তা সম্ভব সে কথা কিন্তু কেউই বলেন না। আর থেকে যায় মুখস্থ বিদ্যা। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে সেই শত বৎসর পুরানো জর্জি দিমিত্রভের লাইন, অর্থাৎ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট সহ অন্যান্য সকল ফ্যাসিবিরোধী শক্তির সাথে যুক্ত ফ্রন্ট গড়ার লাইন।
এই লাইনের এমন মোহ যে সকল রাখ ঢাক ছেড়ে ১৯৯৮ সালে প্রথমবার সিপিআই (এম) জাতীয় কংগ্রেসের সাথে বর্তমান শাসক ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কে আটকাবার স্বার্থে যুক্তফ্রন্ট করতে রাজি হয়ে যায়। এর থেকেই ২০০৪ সালে ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ এলায়েন্স বা ইউপিএ জন্ম নেয়। এখনো সিপিএই (এম) সেই স্বপ্নই দেখে তবে সাথে আরও অনেক নতুন দোসর জুটেছে তার। বিজেপি যদিও এসব কে আর পাত্তা দেয় না। আবার সিপিআই(এম) এর চেয়ে যারা একটু বা অনেকটা বামে, তাদের অনেকেই আবার আম্বেদকরপন্থী, এনজিও-পন্থী, হ্যানপন্থী-ত্যানপন্থী সকলের সাথেই ফ্যাসি-বিরোধী জোট গড়তে চান। তাদের বক্তব্য যে করেই হোক বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদী কে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। যেন ২০১৪ সালের আগে ভারতবর্ষ শ্রমজীবী মানুষের জন্যে একটি বেহেস্ত ছিল। যেন মোদী শুধু ভোটে জিতেই ক্ষমতায় এসেছে আর তার পিছনে অন্য কোন গূঢ় অভিসন্ধি নেই।
মার্কস এক কালে গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা করে মতাদর্শের ক্ষেত্রে আপস কে তীব্র ভাবে ভর্ৎসনা করেছিলেন। লেনিন সারা জীবন প্র্যাগমাটিজম দেখিয়ে মার্কসবাদ কে সুবিধাবাদ ও গোঁড়ামিবাদের থেকে রক্ষা করেছেন এবং নতুন স্তরে উন্নীত করেছেন, অর্থাৎ লেনিনবাদে বিকশিত করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে, যখন সাম্রাজ্যবাদ — অর্থাৎ পুঁজিবাদের বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির স্তরে উন্নীত হওয়া, যাকে লেনিন চিহ্নিত করেন মুর্মূষু পুঁজিবাদ হিসাবে — নিজের লোভ ও লালসা কে চরিতার্থ করতে মানুষের জীবন নিয়ে, পৃথিবীর জল-বায়ু আর প্রকৃতি কে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছে, যে সময়ে পুরাতন, জরাজীর্ন পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসি বা সংসদীয় গণতন্ত্রের সাইনবোর্ড খুলে দিয়ে একটি ভয়াবহ ও নগ্ন ফ্যাসিবাদী শাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া হয়ে ভারতেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন মার্কস, লেনিন বা মাও’র শিক্ষার আলোকে বর্তমান ফ্যাসিবাদ থেকে মানুষ কে উদ্ধার করার, শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে এই ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করার আর নতুন এক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়তে কী ধরণের পদক্ষেপ করা যায় তা নিয়ে কিন্তু তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে কোন কাজ হয়নি আর হচ্ছেও না।
আসলে তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা’র উপর শুধু বুদ্ধিজীবী, স্কলার ও একাডেমিক মহলেরই একচেটিয়া মালিকানা। মাঠে-ঘাটে যাঁরা শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে কাজ করছেন, যাঁরা জনগণের বিভিদ অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের বাস্তবতার থেকে শিক্ষা লাভ করছেন তাঁদের মধ্যে কিন্তু তত্ত্ব কে বিকশিত করার কাজ বেশি হচ্ছে না। মাও এর শিক্ষার আলোকে যদি আমরা তত্ত্ব ও প্রয়োগের সম্পর্ক কে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তাহলে দেখা যাবে যে ভাবে বাস্তবে তত্ত্বের প্রয়োগের ফলে যে ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে, যা ইতিবাচক ও নেতিবাচক শিক্ষা লাভ হচ্ছে তার সঠিক সারসঙ্কলন করে আগামীদিনে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে, তার মদদদাতা উচ্চবর্ণের সামন্তপ্রভুদের, মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী — বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ — শক্তিদের উচ্ছেদ করতে, তাদের থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নিতে কী করতে হবে এই নিয়ে কিন্তু বিস্তারিত চর্চা হচ্ছে না।
লেনিন কোনদিন ৫০ বছর পুরানো তাত্ত্বিক লাইন কে গোঁড়াদের মতন অনুসরণ করেননি, করলে রুশ বিপ্লব হতো না, সোভিয়েত ইউনিয়ন হতো না। আবার তিনি মার্কসবাদ কে জলাঞ্জলি দিয়ে পাতি-বুর্জোয়া পরিচয় রাজনীতি বা সুবিধাবাদী জোট গঠন করেননি, তিনি মার্কসবাদের মূল শিক্ষাগুলো কে নিয়ে আপস করেননি। বর্তমানের বামেদের বড় অংশগুলোই হয় পরিচয় রাজনীতির জন্যে, না হয় সুবিধাবাদী অবস্থানের জন্যে বা অনৈতিক জোট গঠনের জন্যে মার্কসবাদ কে জলাঞ্জলি দিচ্ছে, বুর্জোয়াদের হাতে তামুক খাচ্ছে। আর এটা করার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও তারা হাজির করছে, যদিও সেই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা মার্কসবাদের আতসকাঁচে ধোপেও টেকে না।
তত্ত্ব কে বর্তমান সময়ের উপযোগী না করলে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্নতা যেমন কাটবে না তেমনি যারা বিপ্লবের বা সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেন, যারা সততার সাথে মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেন, তাদের অনেকেই বর্তমানে যে একটা দিশাহারা বা হতাশাছন্ন অবস্থায় রয়েছেন, তার থেকে মুক্তি পাওয়াও সম্ভব নয়। অথচ তত্ত্বের ক্ষেত্রে যেটুকু নতুন করা দরকার বলে রব উঠেছে, তা উঠেছে তাদের মধ্যে থেকে যাদের লক্ষ্য হলো মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কে উদারনৈতিক গণতন্ত্রী একটি মতবাদে পরিণত করে শ্রমিক শ্রেণী কে চিরতরের জন্যে পুঁজির গোলাম বানিয়ে রাখা। তাই বার বার তত্ত্ব বিকাশ করা ও “নতুন করে ভাবা” নিয়ে যে সব রাজনৈতিক নেতারা ও তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা নিজেদের ঝুড়ি নিয়ে এসেছে ততবার সেই ঝুড়ির থেকে বার্নস্টাইন থেকে কাউটস্কি, টিটো থেকে ক্রুশ্চেভ, তেঙ শিয়াও পিং থেকে গর্বাচেভের পঁচাগলা তত্ত্বের বিকট দুর্গন্ধময় মিশ্রণ বেরিয়েছে। যতবার মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও সেতুঙের চিন্তাধারা কে বর্তমান সময়ে এসে, বাস্তব প্রয়োগের থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলোর সারসঙ্কলন করে, জনগণের ও শ্রমিক শ্রেণীর নানা সংগ্রামের সারসঙ্কলন করে, বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক শিক্ষাগুলোর দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণ করে ও সারসঙ্কলন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোন নতুন তত্ত্বের দ্বারা বলীয়ান করার প্রয়োজন বস্তুগত কারণে পড়েছে, ততবার নানা ধরণের ছাল গায়ে দিয়ে এসে সংশোধনবাদের ফেরিওয়ালারা নিজেদের পুরানো মদ নতুন বোতলে করে বেচতে চেয়েছে।
এটা বোঝা খুব দরকার যে বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন তাত্ত্বিক অস্ত্র ছাড়া বিশ্ব জুড়ে মাথা চাড়া দেওয়া ধর্মীয় ও বর্ণবিদ্বেষী ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা যাবে না। দিমিত্রভের দুনিয়ায় ছিল একটি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র এবং সেই রাষ্ট্রের ছিল একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী — লাল ফৌজ — যা একটি বিপ্লবী সৈন্যবাহিনী ছিল, শ্রমজীবী মানুষের নিজের সেনা ছিল। যেহেতু শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী সেইদিন ছিল তাই প্রতিটি দেশের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের সাথে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন ও শ্রমিক শ্রেণীর নিজের রাষ্ট্র, লেনিনের হাতে গড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক ছিল খুবই নিবিড়। তাই সেইদিন চীনা বিপ্লবের সময়ে চীনা লাল ফৌজ পেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অগাধ সমর্থন এবং বিশ্বের মঞ্চে নানা জাতির নিপীড়িত ও শোষিত মানুষ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস পেয়েছিলেন।
বর্তমানে শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক ঐক্য ভেঙে গেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা বশীভূত শ্রমজীবী মানুষ কে এখন তাঁর নিজের ভাই কে, নিজের বোন কে ঘৃণা করতে শেখাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের ঔরসজাত ফ্যাসিবাদ আর এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সেই সব শক্তির সাথে পুরানো কায়দায় আবার যুক্তফ্রন্ট গঠন করার লাইন সামগ্রিক ভাবে বিপ্লবী গণসংগ্রামের ব্যাপক ক্ষতি করবে। কারণ সেই যুক্তফ্রন্ট গঠিত হতে পারে একটি বাস্তব সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এবং সেই যুক্তফ্রন্ট অবশ্যই আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় শ্রেণীগুলির শক্তি ভারসাম্যের দ্বারা প্রচন্ড প্রভাবিত হয়। আন্তর্জাতিক ভাবে যেহেতু শ্রমিক শ্রেণীর নিজের রাষ্ট্র, সৈন্য ও রাজনৈতিক কেন্দ্র নেই তাই এই রকম জোটে বার বার নেপোয় মারে দই করে যাবে জোটসঙ্গীরা, বুর্জোয়ারা। এইরকম জোট কে ব্যবহার করে তারা শ্রমিক ও কৃষকদের উপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করবে ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত না করে।
বরং এই পরিস্থিতিতে লেনিনের থেকে শেখা উচিত কী করে একটি জাতির মানুষ কে ছিনিয়ে নিতে হয় শাসক শ্রেণীর প্রভাব থেকে। শেখা উচিত কী ভাবে গোপনে ও প্রকাশ্যে কাজ করে, কী ভাবে নিয়মিত প্রচার করে, কী ভাবে শ্রমজীবী মানুষের সংবাদমাধ্যম গড়ে ও মানুষের কাছে তাঁর শ্রেণীর কথা প্রতিদিন নানা ভাবে পৌঁছে দিয়ে তাঁদের শ্রেণী চেতনা কে জাগ্রত করে সংগঠিত করতে হয় শ্রেণী কে। শিখতে হবে নিরলস হয়ে কাজ করা, শিখতে হবে আত্মস্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার কথা। লেনিনের থেকে শিখতে হবে ধৈর্য্য এবং সুযোগ কে কাজে লাগাবার কলা। তবেই সম্ভব হবে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে একটি শ্রেণী চেতনা কে জাগ্রত করা ও তাঁদের শ্রেণী সংগ্রামে’র রাজনীতি দিয়ে নেতৃত্বে উন্নীত করা, যাতে তাঁরা তাঁদের অভীষ্ট অর্জনের জন্যে সমগ্র শ্রেণী ও জাতি কে নেতৃত্ব দিতে পারেন।
লেনিনের ১৫০ বছরে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ একটি ভীষণ খারাপ পরিস্থিতিতে আছেন। করোনা ভাইরাসের নাম করে শুধু যে শ্রমজীবী মানুষদের কর্মহীন করে দেওয়া হয়েছে ভারতের মতন দেশগুলোয় তাই নয়, বরং এই রোগ প্রতিরোধের নাম করে ধীরে ধীরে সমস্ত রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে জনগণের। কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাঁদের মতপ্রকাশের অধিকারও, এবং চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে একটি কর্পোরেট-ফ্যাসিবাদী শাসন, ভারতের মতন দেশে যা আধা-সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের কাঁধে চেপে মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে ও শ্রমজীবী, শোষিত মানুষ কে ধর্ম ও জাতের ভিত্তিতে আলাদা করে দিচ্ছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হয়ে গেছে এবং ফ্যাসিবাদীরা একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্যে নির্লজ্জের মতন ওকালতি করছে কারণ সঙ্কটগ্রস্ত একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির তাই আজ চাই বেঁচে থাকার জন্যে।
এই সঙ্কটের থেকে লেনিন মুক্তি দেবেন না আকাশ থেকে নেমে এসে। কোন বস্তুবাদী সে আশা করে না। এই সঙ্কট থেকে সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় মার্কসবাদ আর আম্বেদকর নিয়ে চর্চা করা মানুষেরা উদ্ধার করতে আসবেন না। এই সঙ্কট থেকে নানা ধরণের তথাকথিত বাম হতে গিয়ে বিধির বাম হওয়া নেতারা রক্ষা করতে আসবেন না শোষিত মানুষ কে। এই সঙ্কট থেকে মুক্তি দেবে সৎ প্রয়াস। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও সেতুঙ’র চিন্তাধারা’র বাস্তব ভিত্তিতে অর্জিত শিক্ষার ও শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের বস্তুগত সারসঙ্কলন এবং তার থেকে গ্রহণ করা শিক্ষা কে তাত্ত্বিক ভাবে বিকশিত করেই মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। অতীতের ভুলের থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্যে সঠিক লাইন নিতেই হবে। আর এই কাজে ভুল হবেই, তবে ভুল না করলে শিখবে কে?
লেনিন এর থেকে শিখতে হবে অন্ধকার পৃথিবীতে, শোষণের কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া দুনিয়ায়, কী করে হতাশ না হয়ে তত্ত্ব ও প্রয়োগের মেলবন্ধন করে, গোঁড়ামিবাদ ও সুবিধাবাদ কে পরাস্ত করে মার্কসবাদের অস্ত্রসম্ভার এ নতুন অস্ত্র যোগান দিতে হয়। শিখতে হবে কী করে শ্রমিক শ্রেণী কে, কৃষকদের ও মেহনতি মানুষদের তাঁদের অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে হয়। কী করে আমরা পুরানো চশমা খুলে নতুন পাওয়ারের চশমা পড়ে বিশ্বকে দেখবো, বুঝবো ও বদলাবো, তার হদিশ পেতেই লেনিন কে ১৫০ বছর পরেও আঁকড়ে ধরতে হবে। কারণ লেনিন বুড়ো হননা, বুড়ো হয়ে হারিয়ে যায় তারা যারা লেনিন কে লেনিনের মতন প্রয়োগ না করে সুউচ্চ মন্দিরে দেবতা করে সাজিয়ে রেখে দেন। অবশেষে মনে থাকে যেন, লেনিন বলেছিলেন — বিলম্ব মানেই মৃত্যু। তাই পা চালিয়ে কমরেডস, একটু পা চালিয়ে।