প্রসঙ্গ: লক ডাউনের ত্রাণ রাজনীতি বনাম বামপন্থী খাদ্য আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি

শনিবার, মে ১৬, ২০২০ 0 Comments A+ a-

বামপন্থী খাদ্য আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি
Add caption

প্রবাদে বলে একই নদীতে দুইবার স্নান করা যায় না। কোনো কিছুই আগের মতন হয় না। যেমন ৭৬’র মন্বন্তর আর ৪৩’র মন্বন্তর এক নয়, ৫৯’র খাদ্য সঙ্কটের সাথেও ৬৬ সালের খাদ্য সঙ্কটের বিস্তর ফারাক আছে। সুতরাং ২০২০ সালের খাদ্য সংকট মোকাবিলার আন্দোলন  আগের খাদ্য আন্দোলনের মতন হবে না সেটা আবিষ্কার করতে অতিরিক্ত বুদ্ধি খরচের প্রয়োজন নেই। সবুজ বিপ্লবের পর খাদ্য উৎপাদন অনেক বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার সাথে উৎপাদন খরচও বেড়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন সংকট। কৃষক ফসলের দাম পাননা। এই সঙ্কটের প্রতিফলন আমরা দেখি কৃষক আত্মহত্যায়, খালি পায়ে কৃষক লং মার্চে বা কৃষী বিপ্লবী আন্দোলনে।

পুঁজি’র রাজত্বে সম্পদের অভাব হয় না।পুঁজির আমলে সম্পদের বা খাদ্য সম্পদের অভাব থাকে না, সমস্যা হয় এর বন্টনে। গুদামে খাবার পঁচে কিন্তু তবুও মানুষ অনাহারে থাকে, কারণ মানুষের হাতে টাকা নামক কাগুজে অর্থ পর্যাপ্ত  পরিমাণে থাকে না, সমস্যাটা বন্টন ব্যবস্থায়, এটাই তো মার্কসবাদের প্রাথমিক “অ, আ, ক, খ” শিক্ষা! এর সাথে ভারতের মতন একটি আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশের আঞ্চলিক ক্ষমতাবানদের দাপট পুষ্ট দূর্নীতি গরিব শ্রমজীবী মানুষের বঞ্চনাকে অন্যমাত্রা দেয়। সঙ্কটের সময় এই সমস্ত আঞ্চলিক ক্ষমতাবানদের লোভি জিভ যে হাঁটুর নিচে নেমে আসে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।  সুতরাং বাজারে খাদ্য শস্যের অভাবে ত্রাণ শিবির বন্ধ হচ্ছে না, এই  পর্যবেক্ষণের ফলে যিনি সিদ্ধান্তে পৌছাবেন যে দেশে কোনো খাদ্য সঙ্কট নেই, তিনি টাইম মেশিনে চড়ে মার্কস পূর্ববর্তি সময়ে বসে ভাবনা চিন্তা করছেন হয়তো!

১৯৪৩ এর মন্বন্তরে বাংলা প্রভিন্সে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ৩০ লক্ষের কাছাকাছি মানুষকে অনাহারে রেখে হত্যা করে। তবুও কিন্তু তখন ব্যাপকভাবে খাদ্য লুটপাট বা খাদ্য দাঙ্গা হয়নি। আবার ২০০৭ সালে যখন পশ্চিমবঙ্গে রেশন দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লো, তখন ব্যাপক ভাবে মানুষ অনাহারে ছিল ব্যাপারটা কিন্তু এই রকম নয়। জমি অধিগ্রহণ-বিরোধী কৃষক আন্দোলন গরিব মানুষকে অধিকার অর্জনের উৎসাহ জুগিয়েছিলো। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের হিসাব অনুযায়ী ভারতে বেকারত্বের হার ৭.৮%। অর্থনীতিবিদরা বলছেন এই পরিমাণ বেকারত্ব বিগত শতাব্দীর সাতের দশকে দেখা গিয়েছিল। সেই সময় কিন্তু ব্যাপক যুব বিদ্রোহ দেখা গিয়েছিল। ফেব্রুয়ারী মাস অবধি কিন্তু সাতের দশকের ধারে কাছের যুব বিদ্রোহ দেখা যায়নি। ১২ মে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি'র তথ্য অনুযায়ী ভারতে বেকারত্বের হার বর্তমানে ২৪.৩%। এখনো কিন্তু কোনো যুব বিদ্রোহ দেখা যাচ্ছে না। তার মানে কি এই যে বেকারত্বের সমস্যা নেই দেশে?

সুতরাং যারা স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের সংখ্যা দিয়ে সমস্যা মাপার চেষ্টা করছেন তাঁরা ইতিহাস বোধের দফা রফা করছেন যে শুধু তাই নয়, বাইরে থেকে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে চেতনা নিয়ে যাওয়ার বা সচেতন উদ্যোগের লেনিনের তত্ত্বের  বিরুদ্ধে আর একটি তত্ত্ব হাজির করছেন। এই যুক্তি অনুযায়ী ভারতে শ্রমিকরা সুখে আছে, কারণ লকডাউনের আগে ব্যাপক শ্রমিক বিক্ষোভের কর্মসূচী দেখা যায়নি। যদিও এই সমস্ত যুক্তি কাঠামো নতুন কিছু নয়। বিপ্লবী আন্দোলন কে নাকচ করার জন্য এই ধরনের যুক্তি বাম আন্দোলনে অনেকবার এসেছে, এখনো আসে। মজার বিষয় হল ত্রাণ কর্মসূচীকে সমর্থন করতে গিয়ে বিপ্লবী শিবিরের কেউ কেউ এমনই ভারত সেবাশ্রম মোডে পৌছে গেছেন যে এত দিন যে যুক্তিগুলোর বিরোধিতা করে এসেছেন বর্তমানে সেই যুক্তিগুলোকেই খড়কুটোর মতন আঁকড়ে ধরছেন।

ঔপনিবেশিক শাসনকালের ১৯৪৩ এর মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্পে যোগী ডাকাত গরিব বুভুক্ষু মানুষের কাছে গিয়ে বিভিন্ন  কর্মসূচী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে বোঝার চেষ্টা চালিয়েছিল যে তাঁরা ছিনিয়ে নিয়ে খাচ্ছেন না কেন? আজ কিছু বাম লেখক বাড়িতে বসে বা ত্রাণ বিলিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন যে  যেহেতু জনগণ খাদ্য ছিনিয়ে খাচ্ছেন না  তাই সব ঠিকঠাকই আছে নিশ্চয়!

কিন্তু সত্যিই কি রেশন নিয়ে বিক্ষোভ অতি নগন্য? প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললেই কোথাও না কোথাও স্বতঃস্ফূর্ত রেশন বিক্ষোভের খবর আসছে, উৎসাহী পাঠক "রেশন ক্ষোভ" লিখে গুগুল করে নিতে পারেন। সমস্ত ঘটনার উল্লেখ করে বর্তমান লেখাটি ভারাক্রান্ত করবো না। শুধু কয়েকটি উদাহরণ দেব। ১লা মে ২০২০ হিন্দুস্থান টাইমস বাংলা লিখেছে "রেশনে সরকার নির্ধারিত পরিমাণে খাদ্যশস্য দিতে হলে ব্যাবসা তুলে দিতে হবে। কারণ, জেলা থেকে কলকাতা পর্যন্ত চলছে বখরা। শুক্রবার এমনই চাঞ্চল্যকর দাবি করলেন বীরভূমের লাভপুরের এক রেশন ডিলার। এদিন রেশনে কম সামগ্রী মিলছে বলে অভিযোগ করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন স্থানীয়রা। কমবেশি একই ছবি দেখা গিয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপের নারায়ণপুর, মুর্শিদাবাদের জলঙ্গীতেও"

গত ১১ই মে জি ২৪ঘন্টা রাজ্য সরকারের রিপোর্ট উল্লেখ করে বলেছে "১ মে থেকে ১০ মে পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগে শোকজ করা হয়েছে ৪৪৫ জন রেশন ডিলারকে। সাসপেন্ড করা হয়েছে ৬৯ জনকে। পেনাল্টি হয়েছে ২৯ জনের। আইনি ব‍্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ৫১ জনের বিরুদ্ধে। গ্রেফতার করা হয়েছে ১৩ জন ডিলারকে। ডিলার ছাড়াও রেশন দুর্নীতিতে যুক্ত ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বরখাস্ত করা হয়েছে এক জনকে। মোট ৬৩৮ জনের বিরুদ্ধে ব‍্যবস্থা নেওয়া হয়েছে"।

বলাবাহুল্য এই সবই হয়েছে গণ অসন্তোষের চাপে। বামপন্থীরা যখন ত্রাণ বিলোচ্ছে তখন নেতাদের অপেক্ষা না করেই শাসকদলের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে খেটে খাওয়া মানুষ বিক্ষোভে নেমেছেন। করোনা ভাইরাস আর স্যোশাল ডিসটেন্সিং নিয়ে বাম নেতারা ব্যতিব্যস্ত থাকতে পারেন, গরিব মানুষ কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করেই পথে নামছেন। যখন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ৮ মে তাড়াতাড়ি ভিডিও কনফারেন্স ডেকে তৃণমূলের জেলা সভাপতিদের রেশন দুর্নীতি নিয়ে শাসাতে বাধ্য হচ্ছেন, তখন কোনো র‍্যাডিক্যাল বাম লেখক যদি রেশন ক্ষোভ কে নগন্য বলেন এবং রেশন বন্টনে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে থাকেন, তবে তাকে দুর্ভাগ্যজনক ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে! অবশ্য যিনি ইতালিতে কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকটি উৎসাহ ব্যঞ্জক কর্মসূচীকে "শ্রেণী সংগ্রামের সংক্রমণ" বলে উল্লেখ করতে পারেন, তিনি কী ভাবে বাংলার লাগাতার রেশন ক্ষোভকে নগন্য বলতে পারেন সেই রহস্যের সমাধান করে দিয়েছেন কবি সৃজন সেন। কবি লিখেছিলেন "মনসার পূজা ঢের বেশী ভালো, কে চাহে পূজিতে জ্যান্ত সাপ!"

সাধারণ ভাবেই আমাদের দেশে মানুষ পুরো রেশন পাননা। এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। লকডাউনের মধ্যেও রেশন দুর্নীতি চলেছে। কোথাও কোথাও জনতার চাপে পড়ে দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে। লকডাউনের ফলে কর্মহীনতা গরিবকে আরো বেশী রেশনকে আকড়ে ধরতে বাধ্য করেছে। সাম্রাজ্যবাদের প্রেসক্রিপশন মেনে অটল বিহারি বাজপেয়ী’র-নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি’র (বিজেপি) সরকার দারিদ্র্য সীমার নিচে ও উপরে হিসাবে (APL-BPL) ভাগ করে ধীরে ধীরে গণবন্টন ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে এসেছে। অন্য দিকে গণবন্টন ব্যবস্থার বিস্তার ঘটানো এবং একে শক্তিশালী করার দাবি ভারতে যে কোনো বাম দলেরই সাধারণ দাবি। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে রেশন আন্দোলন থেকে দূরে থাকার জন্য কিছু লেখক ভারতের গণবন্টন ব্যবস্থার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যদিও ২০১৯ সালে গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্সের তথ্য অনুযায়ী ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের র‍্যাঙ্ক ১০২। এমন পরিস্থিতিতেই মনে হয় ঘোড়া হেসে ওঠে। সৌভাগ্যবশতঃ এমন কুযুক্তি লেখকদের একান্তই নিজস্ব মতামত এবং তা কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে আসেনি। 

তেল নুন সাবান সহ রেশনে আরো বেশী পণ্য সরবরাহের দাবি করা যায়, গণবন্টন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার দাবি করা যায়। কিন্তু মানুষকে প্রাপ্য অধিকার পাওয়ার লড়াইয়ে সংগঠিত না করে বামপন্থীরা যদি ত্রাণ বিতরণে ব্যস্ত থাকে তবে আরো  আগে বাড়ার লড়াই হবে কী ভাবে? বামপন্থীরা চাঁদা তুলে ত্রাণ দিচ্ছেন। আর তৃণমূল কংগ্রেস অধিকারের রেশন চুরি করে ত্রাণ দিয়ে দয়া দেখাচ্ছে। কে কত দয়া দেখাতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে। যেহেতু এক র‍্যাডিক্যাল বাম লেখক লিখেছেন যে রেশনের চাল গম যেহেতু চিবিয়ে খাওয়া যায় না তাই কমিউনিটি কিচেন চালানো হচ্ছে, এই ক্ষেত্রে আমার দুটো প্রশ্ন আছে – যারা ত্রাণে রান্না করা খাবার না দিয়ে চাল ডাল দিচ্ছেন উনি কি সেগুলোর বিরোধিতা করছেন? কারণ ত্রাণের চাল ডালও তো চিবিয়ে খাওয়া যায় না তাই না? দ্বিতীয় প্রশ্ন কমিউনিটি কিচেন নাম হয়েছে যখন তখন সংগঠকরা সপরিবারে গরিব মানুষদের সাথে কমিউনিটি কিচেনের রান্না খাচ্ছেন নাকি বাড়ির খাবার খাচ্ছেন? বাড়ির খাবার খেলে "কমিউনিটি" কিচেন নাম কেন? সাম্যবাদী ফ্লেভার ছড়ানোর জন্য? ত্রাণ দাতারা কি ত্রাণ গ্রহীতাদের সাথে নিজেকে এক কমিউনিটি মনে করছেন?
রেশন দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনে হস্তক্ষেপ করতে গেলে শাসকদলের গুন্ডা বাহিনীর মুখো-মুখোমুখি হতে হয়। মার খাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। ফলে সমস্যাটাকে দেখতে না পাওয়াই প্রথম বিকল্প। কিন্তু যখন মানুষ দেখতে বাধ্য করে তখন প্রেস কনফারেন্স আর ফেসবুকে জঙ্গিপনাই রাজনৈতিক কর্মসূচী হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বিজেপি কিন্তু এই বিক্ষোভকে ভোট বাক্সে চালানের চেষ্টা করছে। জাগো কমরেড! জাগো!

কলকাতা শহরে কিছু রিক্সা চলতে দেখা যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু রিক্সা চালকদের  সাথে কথা বললেই জানা যাবে পেটের দায়ে লকডাউন ভেঙে পুলিশের থেকে লুকিয়ে কিভাবে তাঁদের রিক্সা চালাতে হয়! জানা যাবে কত টাকা আয়, কত টাকা ফাইন দিতে হয় রোজ, শরীরের কত জায়গায় কতগুলো লাঠির দাগ আছে। জানালায় বসে রিক্সা দেখলে আর একটা রিক্সাকে পাঁচবার গুনলে মনে হতেই পারে রিক্সা চলাচল স্বাভাবিক আছে।

২৯ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চিফ সেক্রেটারি জারি করা নোটিশ অনুযায়ী রিক্সা চালক, পরিযায়ী শ্রমিক সহ গরিবদের লকডাউনের মধ্যে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা জেলা প্রশাসনের। আর যাদের রেশন কার্ড আসেনি তাদের কাছে  কাউন্সিলরের মাধ্যে ফুড কুপন সরবরাহ করার কথা খাদ্য দপ্তরের। রাজ্য সরকার নোটিশ দিয়েই খালাস। কলকাতার মেয়র বা জেলা শাসক গরিবদের জন্য কোনো ব্যবস্থাই করেনি। ফুড কুপন গরিবদের হাতে পৌছবার আগেই খেয়ে ফেলেছে শাসক দলের আঞ্চলিক নেতারা।

এই গরিব মেহনতী মানুষেরাও নাগরিক। এরা দেশলাই কিনলেও ট্যাক্স দেন। কেন এই মানুষদের নির্ভর করতে হবে অন্যের ত্রাণ সাহায্যের উপর। এই সমস্ত মানুষকে তাঁদের অধিকার আদায়ে সাহায্য করতে  তাঁদের সচেতন ও সংগঠিত করে নির্দিষ্ট অথরিটির উপর চাপ দেওয়া যেত। কেউ কোথাও এই কাজ করছেন না বা সমস্ত বামপন্থী ভারত সেবাশ্রম মোডে চলে গেছেন এই কথা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু এটা সামগ্রিক চিত্র নয়। ত্রাণ বিতরণই সাধারণ চিত্র। মানুষকে অধিকার আদায়ের জন্য সংগঠিত করার থেকে ত্রাণ বিতরণ সমাজে সুবিধাভোগী অংশের জন্য অনেক বেশী গ্রহণ যোগ্য। নিজেদের সুবিধাবাদী কর্মকাণ্ড দিয়ে গা বাঁচানো’র নীতি কে  উৎসাহী তরুণ বামপন্থী কর্মীদের বাগে রাখতে একটা সাধারণ কর্মসূচী হিসাবে চালানো হচ্ছে নাকি?

আসলে ব্যাতিক্রমহীন ভাবে সবাই নিজের সামাজিক অবস্থান থেকে চিন্তা করেন, সচেতন ভাবে বা অবচেতনে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রমজীবী মানুষের চেতনার ভেতর হীনমন্যতা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর আত্মসম্মান, অধিকার বোধ ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। এই আত্মসম্মান অধিকার বোধ সে ফিরে পায় লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে, সংগঠনের মধ্যে দিয়ে। লড়াই আর সংগঠনের ভাটা আসলে আবার দয়াবান বাবুদের রমরমা বাজার শুরু হয়। গরিব মানুষ তখন অর্জিত অধিকারকেও দয়া ভাবতে শুরু করে। পুলিশ বা সরকারি আধিকারিক স্বাভাবিক ভদ্র ব্যবহার করলে মানুষ ভাবে বাবু কত ভালো মানুষ। গরিব মানুষ অধিকার সচেতন হোক, সমাজে সুবিধাভোগী অংশ  তা কোনদিনই চায় না। গরিব মানুষ অধিকার সচেতন হলে তাঁরা বাবুদের উপর নির্ভর করবেন না। আর গরিবরা বাবুর উপর নির্ভর না করলে বাবু দয়া দেখাবেন কাকে? দয়া দেখাতে না পারলে স্বর্গ দুরে থাক এই জগতেও মহান ব্যক্তিদের তালিকায় ঠাই হবে না।

এই বাবু রাজনীতির বিরুদ্ধে দাড়িয়েই কমিউনিস্ট রাজনীতির উত্থান। অধিকার সচেতন শ্রমজীবী মানুষের গণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠাই মার্কসবাদীর কাজ। উৎপাদ-বন্টন ব্যবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের গণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা মার্কসবাদীর লক্ষ্য বলে জানতাম। এই কাজ লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে হয়। ত্রাণ বিলি করে লড়াকু চেতনার বদলে পরনির্ভরশীল ভিখারি চেতনা ছড়িয়ে নয়। বাবু সেজে দান ধ্যানের মধ্যে জন সংযোগটা কংগ্রেসীরা করে দেখেছি, কমিউনিস্টের জনসংযোগ মানে অধিকার অর্জনের সাথি হওয়া। দান ধ্যানের জনসংযোগ অনেক পুরানো হয়ে গেছে। দক্ষিণপন্থীরাও এখন তৃণমূল স্তরে গরিব মানুষের ইস্যু নিয়ে লড়াই করে।

বামপন্থী আন্দোলনের যে বন্ধুদের সাথে এই বিতর্ক তাঁদের প্রতিক্রিয়াশীল বাবুদের সাথে এক সারিতে বসানোর ধৃষ্টতা আমার নেই। তাঁদের জনগণের প্রতি ভালোবাসা এবং অতীতে তাঁদের করা ত্যাগকে সম্মান করি। কিন্তু মাথার ভিতরে কোথাও বাবুরা গেড়ে বসছে না তো? ভয় কোথাও   কর্মসূচী কে নির্ধারণ করছে না তো? ত্রাণের সমর্থনে নিজেদের ঘোষিত মতাদর্শগত অবস্থানকে নাকচ করে এরকম উদ্ভট যুক্তি না সাজিয়ে বিষয়টা রাজনৈতিক ভাবে ভেবে দেখার অনুরোধ করবো।

যখন দেখা যায় "নকশালপন্থী" হিসেবে পরিচিত একদল বুদ্ধিজীবী এবং নেতা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে চিঠি লিখে জানান যে তাঁরা করোনা পরিস্থিতিতে প্রশাসনের সাথে কাজ করতে চান এবং প্রশাসনকে সাহায্য করতে চান তখন রাজনীতি নিয়ে প্রাথমিক ধারণাটাই গুলিয়ে যায়। বিরোধী দলের কাজ বিরোধিতা করা, শাসক দল বা প্রশাসনকে চাপে রাখা। তার বদলে লিখিত ভাবে সহযোগিতার অঙ্গিকার নতুনই বটে। এর সাথে ত্রাণবিলিয়ে ক্ষোভ  প্রশমিত করার কর্মসূচীরকোনো গুনগত পার্থক্য আছে কি? চারু মজুমদার স্তালিনকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন "ঘৃণা করুন  চূর্ণ করুন মধ্যপন্থাকে"। কিন্তু এখন দেখছি চূর্ণ করার মত কোনো মধ্যপন্থা নেই। গোটা খেলাটাই চলে এসেছে দক্ষিণ দিকে। ফেসবুকে অতিবাম আর রাস্তায় দক্ষিণ। রেশন নিয়ে প্রশাসন কে চাপ দেওয়ার জন্য বিপ্লবী হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রশাসনকে চাপ দেওয়াটা রাজনীতির প্রাথমিক অ আ ক খ।

ত্রাণ বিতরণকে সমর্থন করতে গিয়ে এমনই দক্ষিণপন্থী অরাজনৈতিক চিন্তায় ঢুকে গেছেন কমরেড যে একটি সাধারণ রাজনৈতিক কর্মসূচীকেও “বাম অ্যাডভেঞ্চারিজম” মনে হচ্ছে! জঙ্গি অর্থনীতিবাদ বা “বাম অ্যাডভেঞ্চারিজম” এর বিকল্প হিসাবে ত্রাণ বিলি করা কে বিপ্লবী মডেল হিসাবে তুলে ধরা অবশ্যই লেখকের মৌলিকত্বের দাবি রাখে, কিন্তু এর সাথে মার্কসবাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

না, ৫৯ বা ৬৬র খাদ্য আন্দোনের রিপিট টেলিকাস্ট হবেনা। এখনকার আন্দোলন হবে এখনকারই মতন।  অতীতের খাদ্য আন্দোলনের সংশোধনবাদী গাড্ডায় পরে ভোট বাক্সে চালান হওয়াটা যদি ট্রাজেডি হয়, তবে ২০২০ সালের বৈপ্লবিক ত্রাণ বিলি কর্মসূচী যে একটি কমেডি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে