উগ্র চীন-বিদ্বেষের স্রোতে ভাসা কি কিছু কমিউনিস্ট নামধারীদের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়?
ভারত-চীন সীমানা নিয়ে দ্বন্দ্বের ফলে গোটা ভারত জুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের জোয়ার উঠেছে, যার সাথে সামঞ্জস্য পাওয়া যায় ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের সময়ের। চূড়ান্ত রকমের উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে ঢাকা দেওয়া হচ্ছে আসল ঘটনাগুলো কে, তথ্য কে করা হচ্ছে বিকৃত এবং একটি এমন চিত্র উপস্থাপন করা হচ্ছে যার ফলে মনে হচ্ছে চীন ভারতের মানুষের প্রধান শত্রু এবং চীন-সম্পর্কিত সব কিছু বর্জন করার নামই জাতীয়তাবাদ। যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টেলিভিশনে সমস্ত সংসদীয় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের সাথে আলোচনার শেষে স্বীকার করে নিয়েছেন যে ভারতের ভূখণ্ডে চীনা গণ মুক্তি ফৌজ অনুপ্রবেশ করেনি, তবুও দেশজুড়ে চীন ও চীনা সামগ্রী বয়কটের নামে এক উগ্র জাতীয়তাবাদের জোয়ার উঠেছে। এই জোয়ারের ফলে মোদী সরকার কে বারবার করে চীনের সাথে যুদ্ধ করার উস্কানি দেওয়া হচ্ছে।
ঠিক যেমন ১৯৬২ সালে উত্তর-পূর্ব আসাম ফ্রন্টিয়ার বা নেফায়, যা এখন অরুণাচল প্রদেশ নামে পরিচিত, চীনা গণ মুক্তি ফৌজের হাতে ভারতীয় সেনা পর্যুদস্ত হওয়ায় সারা ভারত জুড়ে কমিউনিস্টদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনার সাথে কংগ্রেসি গুণ্ডারা লাল ব্লাউজ পরিহিত মহিলাদের উপর ব্লেড চালায়, চিনা বাদামওয়ালা কে বেধড়ক মারধর করে, চীন সংক্রান্ত বই ও তথ্য পুড়িয়ে দেয় আর চীন থেকে সামগ্রী আমদানি করে বিক্রি করা দোকানদারদের উপর হামলা চালায়, তেমনি, বর্তমানে চীনের সামগ্রী ভাঙচুর, আগুন জ্বালানো আর এমন কী চীনা খাবার বিক্রি করা দোকানদারদের উপর হামলা, ইত্যাদি করে ভারতের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ একটি আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে। এবার এই উগ্র জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা নিয়ে তান্ডব শুধু হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) বা তার সংসদীয় সংগঠন, মোদী’র ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) করছে না, বরং কংগ্রেস পার্টি থেকে শুরু করে সব রঙের সংসদীয় দলগুলোই করছে। আর হাস্যকর ভাবে এই বালখিল্যতায়, মোদী বিরোধিতা করার নামে যোগ দিয়েছে সাবেকি বামপন্থীদের একটা বড় অংশ।
শুধুই সেদিনের “চীন ভারত কে আক্রমণ করেছে” বলে উগ্র জাতীয়তাবাদের মোড়কে নিজেদের দলীয় পতাকা কে মুড়ে জওহরলাল নেহরুর লেজুড় হওয়া ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) নয়, সেদিন সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা সিপিএমের জন্ম, যে দল এখনো চীন যে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ মনে করে, তাঁরাও উগ্র চীন বিরোধিতার খেলায় শরিক। কিছু সাবেক “নকশালপন্থী” দল, যাঁদের পরিচয় এক কালে ছিল মাওপন্থী হিসাবে আর কিছু বিপ্লবী সাজা ইন্টারনেট-ভিত্তিক “নকশালপন্থী” যাঁরা চীন কে “সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী” বলে আমেরিকার চেয়েও বেশি গালাগাল করে থাকেন, তাঁরাও আজ এই চীন-বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী জিগির তোলা দেখে আর চুপ করে বসে থাকতে পারেনি। ভারত কেন চীন কে উচিত শিক্ষা দিচ্ছে না, কেন মোদী ভয় পেয়েছে গোছের উদ্ভট বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের ঝোলে ডোবানো রুটি চিবিয়ে তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক কর্মসূচী সারছেন। গোটা ভারতবর্ষে হাতে গোনা কিছু কমিউনিস্ট নামধারী দল বাদ দিলে, বেশির ভাগের অবস্থানের সাথে কংগ্রেসের অবস্থানের পার্থক্য খুঁজে পাওয়া দুস্কর।
চীনে সমাজতন্ত্র আছে না পুঁজিবাদ? চীন কে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী বলা উচিত না সাধারণ পুঁজিবাদী দেশ? শী জিংপিং কে সন্দেহ করা উচিত না খিস্তি দেওয়া উচিত? এই সব বিতর্কের জন্যে আমরা অন্য কোন দিন নির্ধারণ করবো। বর্তমানে প্রশ্ন হলো যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) কি ১৯৬২ থেকে আজ অবধি কখনো সীমান্ত নিয়ে নিজেদের অবস্থান বদলেছে? ভারত কি কোনদিন ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা নির্ধারিত, চীন কে চরম অপমান করে তার থেকে কেড়ে নেওয়া আকসাই চীন ও গ্যালোয়ান নদীর উপত্যকা সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর, সীমারেখা কে “ঐতিহাসিক অন্যায়” বলে স্বীকার করবে?
উক্ত দুইটি প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক হওয়ার তাৎপর্য খুব গভীর। প্রথমতঃ যেহেতু ভারত আর চীনের সীমান্ত নিয়ে বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয়নি তাই সুস্পষ্ট করে বলা যেতে পারে যে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের সময়কার দুই দেশের অবস্থান বর্তমানেও বিরাজ করছে। অর্থাৎ যে অবস্থান থেকে সেদিন সিপিএম বা সাবেকি “নকশালপন্থীরা” ভারতের চীন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হন, বর্তমানে সেই রাজনৈতিক অবস্থান ত্যাগ করে তাঁরা উগ্র জাতীয়তাবাদের নামাবলী গায়ে দিয়েছেন নিজেদের ভোটের বাজারে বা চায়ের দোকানের রাজনীতির আড্ডায় একটু প্রাসঙ্গিক করে রাখতে।
অথচ ১৯৬২ সালে ভারতের সমাজতান্ত্রিক চীন আক্রমণের বিরোধিতা করে, পুলিশের সন্ত্রাস সহ্য করেও কিন্তু সিপিএম ১৯৬৭ তে নির্বাচনে কংগ্রেস কে মাত দিয়েছিল ও পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করেছিল। যদিও তারপরের ইতিহাস অনেক কালিঝুলি মাখা ও সিপিএমের বেইমানির উপাখ্যানে ভরা, তবুও এটা কিন্তু ঘটনা যে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধ করেও রাজনীতির ময়দানে, এমন কী ভোটের বাজারেও, প্রাসঙ্গিকই শুধু না, বরং একটি নির্ণয়কারক শক্তি হিসাবে একটি কমিউনিস্ট পার্টি থাকতে পারে যদি তার মাটির সাথে, শ্রেণীর সাথে আর শ্রেণী সংগ্রামের সাথে নিবিড় সম্পর্ক থাকে। ঠিক যেমন মাও বলেছিলেন “জলের ভিতর মাছের মতন থাকা” তা যদি এই কমিউনিস্টরা অল্প স্বল্প প্রয়োগ করতেন তাহলে নির্লজ্জের মতন বিজেপি আর আরএসএস এর সাথে উগ্র চীন বিরোধিতার প্রতিযোগিতায় নামতে হতো না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত চীন আক্রমণ করছে না চীন ভারত আক্রমণ করছে এই বিষয় নিয়ে অনেকে কোন ধরণের অনুসন্ধান না করেই বুর্জোয়া কাগজ পড়ে চীন কে আগ্রাসী বলে স্ট্যাম্প মেরে দিচ্ছেন। এই কাজ যে সংসদীয় বামেরা করছে তাই নয় বরং বুকে নকশাল লেবেল আঁটা অনেক বিদ্বজনেরাও করছেন। চীন ভারতের যে এলএসি আছে তার উপর দ্বন্দ্বের মূল কারণ হলো “ম্যাক মাহন লাইন” যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা গায়ের জোরে তৎকালীন দুর্বল রাজতন্ত্রী চীনের উপর সীমানা হিসাবে চাপায়। সেই বেআইনি “ম্যাক মাহন লাইন” কে চীনের সামন্ততন্ত্রী সম্রাটেরাও মানতে পারেননি, তবে ব্রিটিশদের সামনে দুর্বল শক্তি হওয়ায় তাঁরা বিরোধিতা কে তীব্র করতে পারেননি।
যখন ১৯৪৯ সালে চীন মুক্ত হয় সামন্ততন্ত্র আর আধা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে তখন সিপিসি’র নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেন চীনের থেকে যে সমস্ত ভূখণ্ড সাম্রাজ্যবাদীরা চীনের দুর্বলতার ও পরাধীনতার সুযোগ নিয়ে কেড়ে নেয়, তা ফেরত নেওয়ার। তার মধ্যে অন্যতম হয় ফরমোজা দ্বীপ যেখানে চীনের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক চিয়াং কাইশেক পালিয়ে যায় নিজের গো-হারা হারা বাহিনী কে নিয়ে আর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কোলে বসে গঠন করে এক প্রতিবিপ্লবী সরকার। সেই ফরমোজা বহুদিন ধরে চীনা প্রজাতন্ত্র হিসাবে পরিচিত হলেও পরে তার নাম হয় তাইওয়ান। আজও চীন কে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ঠিক তেমনি হংকং, ম্যাকাও, প্রভৃতি দ্বীপের উপর চীনের আধিপত্য পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হলেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার তল্পিবাহকেরা বারবার সেখানে প্রতিবিপ্লবী বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছে মাও-পরবর্তী, দেঙ-পন্থী সিপিসি’র নৈতিক ও আদর্শগত দেউলিয়াপনার সুযোগ নিয়ে।
ভারতের সাথে সীমান্ত নিয়েও চীন বারবার আলোচনা চালিয়েছে এবং ঐতিহাসিক পঞ্চশীল নীতি, যা সমাজতান্ত্রিক বিদেশনীতির ক্ষেত্রে মাও এর দূরদৃষ্টির এক অনবদ্য অবদান, কে ভিত্তি করে সমস্ত বিরোধ মেটানোর চেষ্টা চালিয়েছে। অথচ ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী ও তাদের প্রতিনিধি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহারলাল নেহরু কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দখলকৃত ভূমি ত্যাগ করতে অস্বীকার করে ও প্রতিক্রিয়াশীল সম্প্রসারণবাদী নীতিতে অনড় থাকে। পরবর্তী কালে, যখন স্তালিন-পরবর্তী সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি’র বেইমান নেতৃত্বের সাথে সিপিসি’র আদর্শগত বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে, তখন চীন কে জব্দ করতে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ নেহরু কে হাত করে ও মার্কিন-সোভিয়েত সমর্থনে বলীয়ান হয়ে নেহরু চীন-বিরোধিতা কে তুঙ্গে তোলে আর “ফরোয়ার্ড প্যাট্রলিং" এর নাম করে ভারতের বাহিনী কে বারবার চীনা সীমান্ত উল্লঙ্ঘন করায় ও চীনের উপর হামলা করে বসে।
সেই সময়ে চীন ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল আক্রমণ কে শুধু মাত্র ঠেকায়নি, বরং গণ মুক্তি ফৌজ ভারতের সীমানা অতিক্রম করে এগিয়ে এসেও আবার পুনরায় নিজের পুরানো অবস্থানে ফিরে গিয়েছিল। ভারতের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণী যেহেতু জাতিগত ও বর্ণগত শ্রেষ্ঠতায় বিশ্বাস করে তাই সাদা চামড়ার ফৌজ বাদে আর কারুর হাতে পরাস্ত হওয়া তাদের ব্রাক্ষণত্ববাদী শ্রেষ্ঠতন্ত্রের দর্প কে চূর্ণ করে দেয়। চীনের কাছে পরাজয়ের জ্বালা তাই সোভিয়েত-মার্কিন আর ইজরায়েলিদের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করা নেহরু’র সহ্য হয়নি। পক্ষাঘাতে তাঁর মৃত্যু হয় চীনের কাছে হারের কয়েক বছরের মধ্যেই। তবে ভারতের চীন-বিরোধী প্রচার কিন্তু তুঙ্গে থাকে আর কোন সরকারই মাও বেঁচে থাকাকালীন চীনের সাথে সম্পর্ক কে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেনি। ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টির সরকার তৈরি হওয়ার পরে দেঙ-পন্থী নেতৃত্বের সাথে ভাব জমাতে যদিও তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী ও আরএসএস কর্মী অটল বিহারি বাজপেয়ী চীন যান, তবে সম্পর্কের বরফ গলতে অনেক সময় লাগে।
চীনা নেতৃত্ব যদিও চিরকাল পঞ্চশীলের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান চেয়ে এসেছে, কিন্তু ভারতের আগ্রাসী ভূমিকা বারবার সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। যদিও ১৯৯৬ সালের আর ২০০৫ সালের দুটি চুক্তির পরে চীন সীমান্তে ভারত ও চীনা সৈন্যরা কোন ধরণের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে, তবুও এই সীমান্তে ভারতের শাসক শ্রেণী নিজের সেনা জমায়েত করে, সামরিক পরিকাঠামো গড়ে তুলে, চীন নিয়ে গণ মাধ্যম কে ব্যবহার করে ভীতি সঞ্চার করে ও মনমোহন সিংহ এর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের সময় থেকেই “ফরোয়ার্ড প্যাট্রলিং” এর পদ্ধতি পুনরায় গ্রহণ করে বারবার সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এই পরিকাঠামো গড়ার মূল কারণ হলো ভারতের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-নেতৃত্বাধীন চীন-বিরোধী জোট, যার পোশাকি নাম ইন্দো-প্যাসিফিক এলায়েন্স, এর একটি মুখ্য সদস্য হওয়া। এই দলে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদীরা আছে এবং এদের লক্ষ্য হল চীন কে সামরিক ভাবে ঘিরে ফেলা।
ভারতের সংবাদ মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে চীন-বিরোধী উস্কানিমূলক কথা বার্তা বলে বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হচ্ছে জনমানসে। চীন-বিরোধী এই উগ্র জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তোলার কারণ হলো ইন্দো-প্যাসিফিক এলায়েন্স ও কোয়াড কে জনমানসে ন্যায়সঙ্গত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা ও একটি দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে ভারত কে চীন-বিরোধী যুদ্ধের জন্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘাঁটিতে পরিণত করা। ভারতের মানুষ যাতে ভারতের বুকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির বিরোধিতা না করেন, চীন-বিরোধী যুদ্ধে ভারতের গরীবদের কামানের খোরাক বানানোর বিরোধিতা না করেন, তাই এই উগ্র চীন-বিরোধী জাতীয়তাবাদের জিগির বারবার তোলা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হতেও থাকবে।
বর্তমানে পূর্ব লাদাখে ভারতীয় বাহিনী আর চীনা গণ মুক্তি ফৌজের মধ্যে যে সংঘাত হয়েছে তার কারণ কিন্তু লুকিয়ে আছে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীন-বিরোধী আস্ফালনে। চীনের সাথে “বাণিজ্য যুদ্ধ” যখন থেকে ট্রাম্প শুরু করেছে তখন থেকে ভারতে বিজেপি চীন-বিরোধী প্রচার তুঙ্গে তুলেছে ও চেষ্টা করেছে ভারত কে বিদেশী পুঁজির কাছে চীনের বিকল্প একটি সস্তা রসদ, সম্পদ ও শ্রমের দেশ হিসাবে তুলে ধরে নিলাম করতে। চীনের নামে কোভিড-১৯ অতিমারী ছড়ানোর অভিযোগ কে ভারত সরকার বেসরকারি ভাবে, ভারতের শাসক শ্রেণীর মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা ন্যায্য প্রতিপন্ন করে। চীন-বিরোধী উগ্র প্রচারের মধ্যেই মোদী কিন্তু “আত্মনির্ভর ভারত” অভিযানের নামে দেশ কে সাম্রাজ্যবাদের নাগপাশে বাঁধার কর্মসূচী নিয়েছেন। চীন-বিরোধী যুদ্ধের জিগির ওঠার আগে থেকেই কোভিড-১৯, “আত্মনির্ভর ভারত” ও নানা অজুহাতে চীনের পণ্য বয়কটের রাজনীতি ভারতে তীব্র হয়েছে। আর এর পিছনে ট্রাম্পের অবদান কম না।
ট্রাম্পের ভারত ভ্রমণের সময়ে যখন দিল্লী শহরে মুসলিম-নিধন যজ্ঞ চলছিল, ঠিক তখন মুখোমুখি বৈঠকে ভারতের বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা ট্রাম্পকে জানান যে তাঁরা চীনা প্রযুক্তি ও আমদানি কম করার পক্ষে। মোদী সরকারের প্রাণপুরুষ রিলায়েন্স কোম্পানির মালিক মুকেশ আম্বানি তো ট্রাম্প কে দেখিয়েও দেন যে তাঁর জিও কোম্পানির ৫জি প্রযুক্তিতে কোন চীনা উপকরণ ব্যবহার হয়নি। ট্রাম্প সাহেব খুশি হন ও চীন-বিরোধী জিগির তীব্র করার আদেশ দিয়ে, ভারতে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে, মার্কিন মুলুকে ফিরে যান। বেশ কিছু সময় বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা মানুষের ভয়ে গর্তে সেঁধিয়ে থেকে বর্তমানে সেখান থেকে বেরিয়েই আবার চীন-বিরোধী উস্কানি মূলক ও বিদ্বেষের বাণী নিঃসৃত করা শুরু করেছেন তিনি, যা মোদী ও ভারতের শাসকশ্রেণী মন দিয়ে শ্রবণ করছে।
বর্তমানে চীন-বিরোধী লড়াই ভারত একা করতে পারবে না কারণ চীন পাকিস্তান নয়। আর চীনের সাথে যেহেতু রাশিয়ার সম্পর্ক খুব মধুর এবং দুই দেশ মিলে বিশ্বে মার্কিন সাম্রাজ্যের বিস্তারের পথে বারবার বাঁধা দিচ্ছে, তাই ভারতের পক্ষে হঠাৎ করে রাশিয়া কে ক্ষেপানো সম্ভব হবে না। উল্টো দিকে চীনের ভারতে ব্যবসায়িক স্বার্থ যেমন জড়িয়ে তেমনি রাশিয়ারও। তাই শি আর ভ্লাদিমির পুতিন দুই জনই কিন্তু কোন ভাবে ভারত কে চটাতে চাননা। তাই চীনা গণমাধ্যমে ভারতের সাথে সীমান্ত সংঘাত কে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। চীনা উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচার না করে সিপিসি নেতৃত্ব বারবার শান্তিপূর্ণ ভাবে ভারতের সাথে সীমান্ত সমস্যার সমাধান করার বার্তা দিতে থাকে এবং সীমান্তে উত্তেজনা কমানোর উপর জোর দেয়। রেনমিন রিবাও বা পিপল'স ডেলি ও গ্লোবাল টাইমস - এর মতন সিপিসি’র মুখপত্রগুলো কিন্তু ভারতের বিজেপি-পন্থী ও বিজেপি-বিরোধী মূলধারার সংবাদপত্রগুলোর মতন যুদ্ধ ও হিংসার জিগির তোলেনি। চীনা টেলিভিশন উপস্থাপকরা সামরিক পোশাক পড়ে দর্শকদের মধ্যে প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে বিদ্বেষ উস্কে দিতে আসেনি। বরং বারবার করে তাঁরা ভারত কে ও মোদী সরকার কে আবেদন করেন শান্তিপূর্ণ আলোচনার মধ্যে দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে।
মোদী হঠাৎ যে শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন প্রতিনিধি রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে চীন নিয়ে বিবৃতি দিলেন, এটা কিন্তু শুধু চীনের চাপে না বা ভারতের শান্তির প্রতি আকঙ্ক্ষা থেকে না। মোদী চেয়েছিলেন চীন সীমান্তে উত্তেজনা টিকিয়ে রেখে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে ও তার সাথে কোভিড-১৯ প্রকোপের ফলে ভারতের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে বীভৎস, জীর্ণ কঙ্কালসার চেহারা জনসমক্ষে বেরিয়ে এসেছে, সরকারের ব্যর্থতা ও অন্যায়গুলো যে ভাবে প্রকাশ পেয়েছে, তা ঢেকে দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে। তবে আন্তর্জাতিক স্তরে নিজের নতুন উত্থান নিয়ে ব্যস্ত চীন যে ভারতের উস্কানির আর মোদীর রাজনৈতিক অভিলাষায় অচিরেই জল ঢেলে দিতে পারে সে কথা নয়া দিল্লী ও ভারতের শাসক শ্রেণী কিন্তু আন্দাজ করতে পারেনি।
এটা ঘটনা যে ভারতের একার শক্তিতে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব না। যখন নেহরু ১৯৬২ সালে চীন-বিরোধী যুদ্ধ শুরু করেন, তখন তাঁর সমর্থনে দাঁড়িয়েছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদী সোভিয়েত নেতৃত্ব ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল জায়নবাদী ইজরায়েল। বর্তমান বিশ্বের ভৌগলিক রাজনীতির সমীকরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসার ফলে ভারত এখন মার্কিন দিকে ঝুঁকে আছে, ইজরায়েলের সাথে মোদী নিবিড় ভাবে ভারতের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক কে বেঁধেছেন, আর অন্যদিকে চীন রাশিয়া, ইরান, ভেনেজুয়েলা, প্রভৃতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য-বিরোধী দেশের সাথে হাত মিলিয়ে একটি নতুন সমীকরণ তৈরি করছে। যদি ভারত বর্তমানে চীন আক্রমণ করতে চায় তবে রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল ও অর্থনৈতিক ভাবে দেউলিয়া হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু শুকনো সমর্থন করতে পারবে আর অস্ত্র ব্যবসায়ী ইজরায়েল কোটি কোটি ডলার মুনাফা করবে। ফলে সেই যুদ্ধে চীনের লাভ বেশি আর ভারতের কম। ভারতের মধ্যবিত্তদের বাদ দিলে বিশ্বের আর কোন দেশে এই রকম অর্বাচীন ভাবে যুদ্ধের নাম নিয়ে মানুষ ক্ষেপানো সম্ভব না। ব্রাক্ষণত্ববাদী ভারতের উচ্চ জাতির ধনী ও মধ্যবিত্তরা যুদ্ধের উপাসক কারণ যুদ্ধে তাঁদের বাড়ির লোকের প্রাণ যেমন যাবে না তেমনি তাঁদের আর্থিক স্বার্থ সিদ্ধিও হবে।
মোদী ও বিজেপি-আরএসএস যেহেতু এই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের স্বার্থ রক্ষাকারী রাজনৈতিক শক্তি তাই নানা কায়দায় যুদ্ধের আর উগ্র দেশপ্রেমের জিগির তুলে রাজনীতির ময়দান গরম করার চেষ্টা এরা চালিয়ে যাবেই। দেশের আর্থিক সংকট, কর্মহীনতা, মূল্যবৃদ্ধি, দেশের সম্পদ বিদেশী পুঁজির কাছে বিক্রি করে দেওয়া, প্রভৃতির থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে মোদী সরকার ও আরএসএস এর যেমন যুদ্ধ প্রয়োজন ঠিক তেমনি দেশের আপামর শ্রমিক ও কৃষকের কাছে এহেন যুদ্ধ হল একটা অভিশাপ, কারণ তার ফলেই তাঁদের কাঁধে চাপবে দেশপ্রেমের নাম চড়া করের বোঝা, সৃষ্টি হবে কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কটের আর চরম ভাবে বৃদ্ধি পাবে কালোবাজারি। তাই দেশের শ্রমজীবী মানুষ কে অবশ্যই যুদ্ধের বিরোধিতা করতে হবে। কমিউনিস্ট নামধারী শক্তিগুলো যদি এই সোজা হিসাব গুলিয়ে দিয়ে ভারতের শাসকশ্রেণীর চোঙা ফুঁকে মানুষ কে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা চালান, মোদী কেন চীনাদের হাতে নিহত ভারতীয় সেনাদের বদলা নিচ্ছে না গোছের অভিযোগ তুলে ন্যাকামো করেন, ও বিজেপি-কংগ্রেসের সাথে দেশপ্রেম দেখাবার বা চীন-বিরোধিতা দেখাবার প্রতিযোগিতায় নামেন তাহলে বুঝতে হবে কাউটস্কি’র নেতৃত্বাধীন উগ্র-দেশপ্রেমের জোয়ারে গা-ভাসানো দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বেইমান পীত সমাজতন্ত্রীদের তালিকায় নাম তুলেছেন এই সব বিপ্লবী সাজা বাঘা বাঘা সংগঠকেরা। এদের থেকে ভারতের শ্রমজীবী মানুষদের শত যোজন দূরে রাখতে হবে।