করোনা ভাইরাসের সময়ে ঐতিহাসিক ২৫শে মে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের ৫৩তম বার্ষিকী পালন
বর্তমানে ঐতিহাসিক ২৫শে মে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের ৫৩তম বার্ষিকী এমন একটা সময়ে পালন হচ্ছে, যে সময়ে বিশ্বের বুকে আন্তর্জাতিক একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি আর্থিক সঙ্কটের পাঁকে পড়ে নিজের ব্যর্থতার, নিজের কুকর্মের ফলে সৃষ্ট মন্দার দায় করোনা ভাইরাসের মতন একটি জীবাণু-বাহিত ছয় মাস পুরানো রোগের উপর চাপিয়ে দিয়ে সেই অজুহাতে শ্রমজীবী মানুষের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে। শ্রমিকশ্রেণীর বহু সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত অধিকারগুলো কেড়ে নিতে চাইছে। এই সময়ে আমাদের গতানুগতিক তাত্ত্বিক বাগড়ম্বরতা বাদ দিয়ে, পুরানো কাসুন্দি না ঘেটে, দেখা দরকার যে এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের রাজনীতির আলোকে আন্তর্জাতিক বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির এবং তাদের দেশীয় দালাল মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের দ্বারা সাধারণ মানুষ কে নিজেদের শোষণের জাঁতাকলে পিষে, তাঁদের রক্ত চুষে, এই সঙ্কট থেকে পরিত্রান পাওয়ার অপচেষ্টা কে রোখা যায় ও শ্রমজীবী মানুষ কে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সংগ্রামের বৃহৎ রণক্ষেত্রে আনা যায়।
ভারতের আর্থিক সঙ্কট বিশ্বের বাজারে চলমান বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির সঙ্কটেরই একটা পরিণাম বা প্রতিবিম্ব। যেহেতু ১৯৭০ এর থেকেই পুঁজির উপর মুনাফার হার কমছে এবং নানা ধরণের শিল্পের বৃদ্ধি নিম্নগামী হয়ে যায়, যেহেতু লগ্নি পুঁজি নিজের চরিত্র অনুসারে চরম মুনাফার খোঁজে উৎপাদন প্রক্রিয়ার থেকে বেরিয়ে ফাটকা খেলে অনুৎপাদক পুঁজির পাহাড় সৃষ্টি করা শুরু করে এবং অর্থ দিয়ে আরও অর্থ তৈরি করে সমাজে চরম বৈষম্যের সৃষ্টি করে, তার ফলে বার বার এই ফাটকা খেলার বুদবুদ ফেটে যাওয়ায় সঙ্কট আরও গভীর হয় বারবার। এই ফাটকা খেলা, এই কাল্পনিক পুঁজির উদ্ভব ও গায়েব হওয়া এবং গোটা বিশ্বে একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির সঙ্কটের থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে লগ্নি ও স্থায়ী খরচ কমানো ছাড়া গতি নেই। আর এই খরচ কমানো যেতে পারে জমি, শ্রম ও কাঁচামাল হয় আরও সস্তা করে দিয়ে বা একেবারে বিনামূল্যে যদি তা সরকার বৃহৎ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেয়। আর শুধু তাই না, বৃহৎ কর্পোরেটদের আজ চাই পুঁজির যোগানও, যে পুঁজি যদিও তারা বৃহৎ ব্যাঙ্কগুলোর থেকে, বিশেষ করে ভারতের মতন দেশের সরকারি মালিকানাধীন ব্যাঙ্কগুলোর থেকে ঋণ হিসাবে অল্প সুদে জুটিয়ে নেবে, কিন্তু ফেরত দেবে না। এর ফলে ব্যাঙ্কে লগ্নিকারী পুঁজির মালিকেরা সঙ্কটে পড়বে আর সবচেয়ে বেশি সঙ্কটগ্রস্ত হবেন দেশের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ীরা।
আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার এই সস্তা জমি আর কাঁচামাল তুলে দিতে দেশের সমস্ত ক্ষেত্রে বেসরকারি পুঁজির ও বিদেশী পুঁজির আনাগোনা অবাধ করে দিয়েছে। ঋণের সুযোগ করে দিয়েছে ব্যাঙ্কগুলোর থেকে আর চরম মন্দার মধ্যেও মানুষের হাতে টাকার যোগান বাড়িয়ে অর্থনীতিতে পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বৃদ্ধি না করে, মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ না তৈরি করে বরং একের পর এক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিশেষ করে শ্রম আইন সংশোধন করে, শ্রমিকশ্রেণীর বহু সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জিত অধিকারগুলো কেড়ে নিয়ে, আর জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) বানিয়ে কোটি কোটি গরিব মানুষ কে, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে, নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সস্তা শ্রমিক বানাবার পথ প্রশস্ত করেছে।
পুঁজির সঙ্কটের কারণে ভারতের অর্থনীতি গড্ডালিকায় পড়ে সেই ২০১১-১২ সাল নাগাদ আর তারপরে কোনদিনই অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বরং ডিসেম্বর ২০১৯ এ শেষ হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ৪.৭% এ এসে পড়ে। জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০২০ বা চতুর্থ ত্রৈমাসিকের সঠিক হিসাব এখনো এসে পৌঁছায়নি তবে এই ভাবে আর্থিক বৃদ্ধির হার পড়তে থাকায় অর্থনীতিবিদদের একাংশের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েও মোদী সরকার কিন্তু সেই অর্থবছর ২০১৭-১৮ থেকেই আর্থিক মন্দার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে এসেছে।
দেশের লোক সিনেমা দেখছে বলে দেশে আর্থিক মন্দা নেই বা গাড়ি শিল্পে চাহিদা পড়ে গেছে মানুষ বেশি ট্যাক্সি চড়ছে বলে বা পকৌড়া বিক্রি করাও একধরণের কর্মসংস্থান, ইত্যাদি কথা বলে আসল আর্থিক ইস্যু কে বারবার চাপা দিলেও, মার্চের মাঝামাঝি এসে তা সম্ভব না হওয়ায়, আমেরিকা সহ পশ্চিমী অর্থনীতিগুলোর মতন সব দোষ নন্দ ঘোষ বলে করোনা ভাইরাস কে দোষ দিয়েছে মোদী সরকার। করোনা ভাইরাসের ফলে মধ্যবিত্তদের মধ্যে সৃষ্ট আতঙ্ক কে হাতিয়ার করে নিজের পুরানো অভিলাষ চরিতার্থ করা শুরু করেছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জনবিরোধী আইনগুলো কে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের সাথে লড়ার উপকরণ হিসাবে দেখিয়ে।
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, যখন লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে ভারতের এক রাজ্যের থেকে অন্য রাজ্যে প্রায় কয়েকশ বা কয়েক হাজার কিলোমিটার হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে বা ট্রাকে লুকিয়ে যেতে হচ্ছে, যখন দেশের শ্রমজীবী মানুষ পথ দুর্ঘটনায় রাস্তার পশুর মতন প্রাণ হারাচ্ছেন, যখন গর্ভবতী মহিলা কে ৫০০ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হচ্ছে, ছোট শিশুদের কাঁধে চাপিয়ে প্রখর রৌদ্রে শ্রমিকেরা গ্রামের পানে যাচ্ছেন, আর সরকার তাঁদের পরিবহন দেওয়া তো দূরের কথা, দেখা মাত্রই অমানবিক ভাবে অত্যাচার করছে, তাঁদের উপর নানা ধরণের কেমিক্যাল স্প্রে করে তাঁদের জীবাণুমুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে আর যেনতেন প্রকারে চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে শ্রমিকেরা মালিকদের জন্যে সমস্যা সৃষ্টি করে নিজেদের কর্মস্থল থেকে না চলে যান, সেই সময়ে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের শিক্ষা আমাদের বলে যে এই শ্রমিকদের লাঞ্ছনা, এদের বেদনা ও চরম হতাশার মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে আছে আগামী কে পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা ও সেই ক্ষমতা কে ইন্ধন যোগান দেওয়ার মতন ক্ষোভ।
ভারতের শাসকশ্রেণী যে এই শ্রমজীবী মানুষ কে কীটপতঙ্গের চেয়ে বেশি কিছু ভাবে না তা বারবার দেখা গেল বিজেপি’র নানা ধরণের শ্রমিক-বিরোধী ও ধনী-বান্ধব প্রকল্পে। ধনী আর মধ্যবিত্তরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থালা বাটি বাজালেন, প্রদীপ জ্বালালেন আর অন্যদিকে সেই বারান্দার নিচ দিয়ে, নিজেদের হাতে বানানো অট্টালিকাগুলো কে তীব্র ঘৃণা ভরা নজরে দেখে, তপ্ত রাজপথে ছেঁড়া চটি পড়ে এগিয়ে চললেন শ্রমিকেরা। এই দেশের বুকে যখন প্রধানমন্ত্রী টিভিতে মধ্যবিত্ত কে ভারতবর্ষ কে বিদেশী পুঁজি কে বিক্রি করে দিয়ে “আত্মনির্ভর” বানাবার সোনার পাথরবাটি বিক্রি করছেন, তখন কিন্তু হাজার মাইল নিজের বাবা কে সাইকেলের কেরিয়ারে বসে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে কিশোরী মেয়ে প্রমাণ করছে আত্মনির্ভরতা একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের শ্রমজীবী মানুষের জন্যে কত জরুরী। এই সঙ্কটের সময়ে যেমন পুঁজি চেষ্টা করছে গ্রামাঞ্চলের সামন্তশ্রেণীগুলোর সাথে মিলে একটি বৃহৎ জাঁতাকলে কৃষক ও শ্রমিকদের পিষবার, তখনই তাঁর উপর অত্যাচার ও তাঁর লাঞ্ছনার কথা নিজের গ্রামে গিয়ে শোনাচ্ছেন শ্রমিকেরা। আর এর ফলে ক্ষোভের আগুন প্রশমিত হচ্ছে না, ক্ষোভ নিভে যাচ্ছে না, বরং ধিকিধিকি করে জ্বলছে।
এরই মধ্যে আম্ফান ঘূর্ণি ঝড়ে যাঁরা সর্বস্বান্ত হলেন তাঁদের মাথার উপর কিন্তু এনআরসি’র ঘন কালো মেঘ। তাঁদের বাড়ি ঘর, গরু ছাগলের সাথে তাঁদের পরিচয়ের কাগজী টুকরোও ভেসে গেছে। তাঁদের কাঁচা বাড়ির দেওয়ালের সাথে তাঁদের নাগরিকত্বের শেষ নিশানীও ধ্বসে গেছে। ঝড়ের পরে পুনর্গঠনের মাঝেই আবার হিন্দুত্ববাদী বর্গী সেনা এনআরসি দিয়ে হতদরিদ্র বাঙালি নমঃশূদ্র, আদিবাসী ও মুসলিম মানুষের থেকে শ্রমের মূল্যের দর কষাকষির ক্ষমতা কেড়ে নেবে। নিংড়ে তাঁদের রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে আম্বানি আর আদানীদের সিন্দুকে মোহর ভরবে।
এই পরিস্থিতিতে শাসকশ্রেণী কে আটকাতে ও পরাস্ত করতে পারে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের চেতনা। নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহ ছিল ভারতবর্ষের কৃষকদের প্রথম রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্যে সংগ্রাম। পরবর্তীকালে এই সংগ্রাম উন্নত হলেও নকশালবাড়ি এক চিরন্তন সূর্যের মতন জ্বলজ্বল করে শোষিত ও নির্যাতিত মানুষ কে আশার বাণী শুনিয়েছে। তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেছে প্রতি পদে। আজ যখন শাসকশ্রেণী, আন্তর্জাতিক বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি, তাদের তাঁবেদার দেশীয় মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ চরম সঙ্কটে নিম্মজিত ও এর থেকে পরিত্রাণ পেতে শ্রমজীবী মানুষের ঘাড়ে আরও ভারী শোষণের বোঝা চাপাতে চাইছে তখন দেশের শ্রমজীবী মানুষ কে রাজনৈতিক ভাবে জাগিয়ে তোলার ও নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহ ও তার শিক্ষার আলোকে সুসজ্জিত করার এর চেয়ে বেশি ভাল পরিস্থিতি কিন্তু আর হবে না।
বর্তমানে যদি নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষেরা এবং সংগঠনগুলো নিজেদের বৈরিতা ও সংকীর্ণতার গণ্ডি পার হয়ে এই করোনা ভাইরাসের আড়ালে ভারতের শাসকশ্রেণীর দ্বারা শ্রমজীবী মানুষের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষদের নিয়ে নিজেদের সাধ্য অনুসারে এবং সৎ প্রচেষ্টা দ্বারা জোট বাঁধতে পারেন, সমন্বয় করে যৌথ ও সংহতিমূলক সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেন তবে বিগত ৫৩ বছরে বারবার ধাক্কা খাওয়ার, বারবার পিছিয়ে পড়ার ও একে অপরকে ল্যাং মারার প্রক্রিয়া শেষ হয়ে একটি নতুন সূচনা হতে পারে। চারু মজুমদার নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহ ও তারপরে শ্রীকাকুলামের বিদ্রোহের জন্মদাতা। তিনি বলেছিলেন নকশালবাড়ি মরেনি আর মরবে না কোনদিন। তার বক্তব্য এই ৫৩ বছরে শুধু সঠিকই প্রতিপন্ন হয়েছে। তবে নকশালবাড়ি বেঁচে থাকবে ঠিক ততক্ষণ যতক্ষণ তার প্রয়োগ হচ্ছে।
যতক্ষণ নকশালবাড়ি’র রাজনীতি দেশের শ্রমিক আর কৃষকের মধ্যে প্রবেশ করবে ততক্ষণ নকশালবাড়ি বেঁচে থাকবে। চারু মজুমদারের রাজনীতি দিয়ে করোনা ভাইরাসের নামে চালিত শাসকশ্রেণীর আক্রমণ কে প্রতিহত করা, প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও জনগণের বিজয় সুনিশ্চিত করাই নয়, বর্তমান পরিস্থিতি দাবি করছে এই রাজনীতি দিয়ে মানুষ কে সচেতন করে দেশের সমস্ত এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন কে শ্রমজীবী মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে পরিণত করা। যদি ৫৩তম নকশালবাড়ি দিবসের কোন ডাক থাকে তাহলে তা এর চেয়ে আলাদা কিছু হতে পারে না।