ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য লোপ পায়নি তীব্র হয়েছে
খুব হৈচৈ করে পার হলো আরও একটা ২১শে ফেব্রুয়ারি। এই বছরে জাতীয় শহীদ বেদিতে মাল্যদান করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টলছিলেন ও চরম বিভ্রান্তের মতন তাকিয়ে ছিলেন। যে ভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতারা কোলা ব্যাঙের মতন থপ থপ করে গিয়ে ভীষণ লোক দেখানো ঢং করে পুস্পস্তবক দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন তাতে কারুরই বুঝতে অসুবিধা থাকে না যে কী ভীষণ আনুষ্ঠানিকতা হয়ে গেছে অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি’র ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করা। এর ফলে মানুষের মধ্যেও ভাষা আন্দোলন ও বাংলা ভাষার মর্যাদার লড়াই নিয়ে, সালাম, বরকত, জব্বার, রফিকদের শাহাদাত নিয়ে, একটা গতানুগতিক ভাব দেখা দিয়েছে। মনে হয় ভাষা আন্দোলন আর ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আর বাঙালির চেতনা কে ছোঁয় না, তাঁর জীবনের সাথে সম্পর্ক রাখে না। যদি বাংলাদেশে বাঙালি নেতৃত্বের নিজের দেশের গৌরবজ্জল অধ্যায় নিয়ে এই রকম মনোভাব থাকে তাহলে যে বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ এক খাদের দিকে গড়িয়ে চলেছে তা বলাই বাহুল্য।
বাঙালির কাছে ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও তাৎপর্য কোনদিন কম হবে না। বাংলা ভাষা কে রক্ষা করতেই নয়, বাংলার বুকে বাস করা অসংখ্য আদিবাসী জনজাতির মানুষের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি কে রক্ষা করার দায়ও কিন্তু বাঙালির। ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলা ভাষা কে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই ছিল না, শুধুই উর্দু উপনিবেশবাদ কে উৎখাত করার লড়াই ছিল না, শুধুই সমমর্যাদার বা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লড়াই ছিল না। ভাষা আন্দোলন যে কোন রাষ্ট্রীয় মদতপ্রাপ্ত ভাষার রোলার সেই রাষ্ট্রের নিপীড়িত, শোষিত, প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু মানুষের নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি’র উপর চালানো রোখার লড়াই। তাই চাকমা, পাহাড়ি, রাজবংশী, কোচ, সাঁওতাল প্রভৃতি জনজাতির মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচিতি কে সমমর্যাদা দেওয়ারও লড়াই হল ভাষা আন্দোলন। এটা বাংলাদেশের পরিচয়। এটা বাংলাদেশের ঐতিহ্য।
সেই মধ্যযুগ থেকে বাংলা কে ক্রমাগত লড়াই চালাতে হয়েছে নিজ অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে। বাংলার বুকে এসে জেঁকে বসা ব্রাক্ষণ জাতির শাসকেরা, যাঁদের বেশির ভাগের আগমন হয়েছিল বর্তমান ভারতের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকগুলোর থেকে, ধীরে ধীরে যে ভাবে বাংলার মানুষের উপর শুধু রাজনৈতিক নয় বরং সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম করেছিল তার থেকে মুক্তি এসেছিল নবাব যুগে, যখন থেকে বাংলা ভাষার ব্যবহার সাহিত্যে শুরু হয়। ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণীরা যা করতে দিতে চায়নি, মুসলিম নবাব শাসনকালে তাই সম্ভব হয়ে উঠেছিল, যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো কৃত্তিবাসের রামায়ণ, যা সংস্কৃতের বাইরে এনে একটা মহাকাব্য কে মানুষের ভাষায় প্রচার করেছিল।
অথচ আজ, তথাকথিত স্বাধীনতার ৪৮ বছরে এসেও, আমরা কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভাষা আন্দোলন কে তাঁদের নিজেদের, তাঁদের আপন করে তুলতে পারিনি কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হল পাকিস্তানী মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের থেকে ক্ষমতার ব্যাটন ভারতপন্থী কিছু বাঙালি মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি আর বৃহৎ জোতদার-জমিদারদের হাতে যাওয়া। যাদের নেতা হলো মুজিব থেকে হাসিনা। যে গরিব, খেটে খাওয়া শ্রমিক আর কৃষক হলো বাংলার ৮০ শতাংশ তাঁদের কাছে যেহেতু স্বাধীনতা আজও এক অজানা বস্তু হয়ে রয়েছে তাই জোর করে তাঁদের মধ্যে ভাষা আন্দোলন ও ২১শে ফেব্রুয়ারি’র শহীদদের নিয়ে কোন উদ্দীপনা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। অভুক্ত বাঙালি ভাষার চেয়ে বেশি খাবার কে চায়, ইতিহাসের চেয়ে বেশি বর্তমান কে চায়।
তাই দলে দলে বাঙালিকে আজও দেশ ছেড়ে বিদেশ গিয়ে টাকা অর্জন করতে হয়, বিশ্বের দেশে দেশে গিয়ে নানা জাতির ভাষায় কথা বলে, তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করে বাংলাদেশে নিজের পরিবারের মুখে দুই বেলা অন্ন তুলে দিতে হয়। এর চেয়ে চরম অপমানের কথা কী হতে পারে যে ধনে ধানে, পুষ্পে ভরা, শস্য-শ্যামলা এই দেশে নানা জাতির, নানা ভাষার, নানা সংস্কৃতির মানুষের দুই বেলা পেট ভরানোর বন্দোবস্ত করা যায় না? কী কারণ যে আজও বাংলাদেশে সেই সাম্য এল না যার জন্যে একদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে লক্ষ লক্ষ বাঙালি প্রাণ দিয়েছেন?
বাংলা ভাষা আন্দোলন কে শুধু একটা দিবসে পরিণত করে তার শপথগুলো ভুলিয়ে দেওয়ার পিছনে যে রাজনীতি আছে, দেশের ভিতর অসাম্যের উর্দ্ধগামী গ্রাফের যে রাজনীতি আছে, তার মূল হলো মুষ্টিময় কিছু বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি, জোতদার-জমিদারদের হাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়া। জনগণের, আদিবাসী-পাহাড়ি মানুষের, পানি-জঙ্গল-জমি কেড়ে নিয়ে, মানুষের শ্রম কে নিংড়ে নিয়ে, গার্মেন্ট শ্রমিকের রক্ত চুষে, মাঠের কৃষকের ঘাড় ভেঙে যে বিপুল সম্পদের পাহাড় এই হাতেগোনা কীট পতঙ্গের দলেরা করেছে তার ফলেই কিন্তু আজ বাঙালি তাঁর নিজভূমি বাংলাদেশে অভুক্ত থাকছেন, তাই বাঙালি শ্রমিক বিদেশ যাচ্ছেন পয়সা রোজগার করতে আর ফিরছেন লাশ হয়ে।
ভাষা আন্দোলন কে মানুষের মুক্তির আন্দোলন থেকে, সামন্তবাদ-মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ-বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির দাপট থেকে মুক্তির আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানো একটা অন্যায়। রফিক-জব্বাররা কিন্তু শুধুই ভাষার সমমর্যাদার জন্যে প্রাণ দেননি। একুশে ফেব্রুয়ারি কোনদিনই শুধু বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের দিন নয়, এই দিন হলো বাংলার শোষিত-নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের রুখে দাঁড়াবার দিন। যা স্বাভাবিক ভাবে তাঁদের বাংলাদেশের সমস্ত সম্পদের উপর মালিকানা কায়েম করার লড়াই, সমমর্যাদা, ন্যায়, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের লড়াই। চরম ফ্যাসিবাদী, স্বাধীনতা-বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী, ভারতের দালাল হাসিনা সরকার তাই যখন শহীদ দিবস পালন করার নাটক করে, যখন আওয়ামী লীগের কর্তাব্যক্তিরা রফিক-জব্বারদের আত্মত্যাগ নিয়ে জ্ঞান দেয়, ঠিক তখন তাঁদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে হবে বাংলাদেশের আপামর মানুষ কে। গড়ে তুলতে হবে গ্রামে গ্রামে ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম, যা দিয়ে মুক্ত করা যাবে বাংলাদেশ কে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি সত্যিই সম্মান জানানো যাবে অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ কে সম্পন্ন করে। দেশের প্রতিটি কোনে শ্রমজীবী মানুষের বিজয় ঝান্ডা উড়িয়ে। বাংলার সাথে সাথে সমস্ত আদিবাসী, পাহাড়ি, নির্যাতিত জনজাতির ভাষা ও সংস্কৃতি কে রক্ষা করে ও সমমর্যাদা দিয়ে।