প্রতিবাদে - প্রতিরোধে সামিল হলেন কোটি কোটি শ্রমিক - কর্মচারী এবং স্তব্ধ হলো ভারত

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

প্রতিবাদে - প্রতিরোধে সামিল হলেন কোটি কোটি শ্রমিক - কর্মচারী এবং স্তব্ধ হলো ভারত। বাজারী সংবাদ মাধ্যম ও কাগজগুলির ধর্মঘটের বিরুদ্ধে বিটকেল চিত্কার, ধর্মঘটকে ওদের 'উন্নয়ন বিরোধী' বলে গাল দেওয়া সত্তেও দেশের ১৫ কোটি সংগঠিত শ্রমজীবি মানুষ ও কোটি কোটি অসংগঠিত শ্রমিক - কর্মচারীগণ যৌথ লড়াইয়ের মাধ্যমে ২রা সেপ্টেম্বর দেশ জোড়া ধর্মঘট সফল করলেন। 

বাংলা - ত্রিপুরা - কেরালা তো স্তব্ধ হলোই, সাথে সাথে যুক্ত হলো মুম্বাই সহ মহারাষ্ট্র, বিহার, উত্তর প্রদেশ, ওডিশা, ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, উত্তরাখন্ড, দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব,  তামিল নাডু, গোয়া, কর্নাটক,  তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র প্রদেশ। মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ধর্মঘটে সামিল হলেন হাজারো কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী, ব্যাঙ্ক কর্মচারীগণ, এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। সরকার কে হজম করতেই হলো বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়। আরএসএস আশা করেছিল যে তাদের শ্রমিক সংঘ - বিএমএস কে ধর্মঘট থেকে সরিয়ে নিয়ে হয়তো তারা ধর্মঘটকে ধাক্কা দিতে পারবে কিন্তু সে আশা যে গুড়ে বালি তা ২রা সেপ্টেম্বর প্রমাণ হলো উত্তর ও মধ্য ভারতে যেখানে বিএমএস এর শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রভাব বেশি।  

কেন্দ্রীয় সরকারের জন বিরোধী ও শ্রমিক বিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে, বিদেশী বৃহত এক চেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির তোষণের বিরুদ্ধে এই ধর্মঘটে সামিল হয়ে নিজেদের প্রতিবাদ বধির রাষ্ট্র ও তার মালিক শ্রেণীগুলি কে ধাক্কা দিয়ে জানানো ছাড়া আর কোনো পথই শ্রমিক - কর্মচারী, মেহনতী জনগণের কাছে খোলা নেই।  এবার সময় হয়েছে এই লড়াই কে আরও তীব্র করে তোলা, যাতে বিদেশী বৃহত একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে শ্রমিক-কৃষক- খেটে খাওয়া মানুষের উপর শোষণ অত্যাচারের রোলার চালানোর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়, এবং এই কাজে আজ শ্রমিক শ্রেণীকে বিশেষ করে অংশ গ্রহণ করতে হবে। 

সারা দেশে ধর্মঘটের সময়ে বিছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া বড় হিংসার কোনও খবর না থাকলেও পশ্চিম বাংলা কিন্তু এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো। যেমন আশংকা গত কয়েকদিন যাবত করা হচ্ছিল সেই ভাবনার সাথে তাল রেখেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর বদন্যতায় তার দলীয় গুন্ডা বাহিনী দিকে দিকে পুলিশের সাথে সাথে ধর্মঘটকারীদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে। তাদের হিংসাত্মক আক্রমণের শিকার হন বহু শ্রমজীবি ধর্মঘট সমর্থনকারী, এবং বামপন্থী ধর্মঘট সমর্থনকারীদের অভিযোগ যে পুলিশের সাথে সাথে এই লুম্পেন বাহিনীকে সরাসরি পরিচালনা করা হয়েছে নবান্ন থেকে। 

প্রশ্ন হলো যেখানে বিজেপি শাসিত রাজ্যেও আরএসএস বা বিজেপি কর্মীরা অস্ত্র হাতে ধর্মঘট সমর্থনকারীদের উপর ঝাঁপালো না, সেখানে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও তার সাগরেদরা বাড়িয়ে কেন ধর্মঘট সমর্থনকারীদের আক্রমন করছে ? তাও আবার যখন ধর্মঘট রাজ্য সরকার বা তৃণমূলের কোনো নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়নি ? 

এর তিনটি মূল কারণ আছে। প্রথমত: মমতা ব্যানার্জী তার নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী সরকারের শেষ বছরে বিদেশী বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি, ও তার দেশীয় দালালদের ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তার সরকার ও পার্টি পুঁজির উলঙ্গ শোষনের পক্ষে যথাযত প্রয়াস চালাবে আগামী পর্বে জিতলে। দেশী ও বিদেশী পুঁজির প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে জ্যোতি বোসের কায়দায় তার সরকারও পিছপা হবে না সেটা জানান দেওয়া ছিল তৃণমূলী গুন্ডাদের দ্বারা ধর্মঘটে সামিল শ্রমিক ও কর্মচারীদের উপর হামলার প্রধান কারণ।  
দ্বিতীয় কারণ : মোদী সরকারের প্রতি তার মৈত্রী বার্তা পাঠালো মমতা সরকার, যাতে বিজেপি মমতার সাথে কৌশলগত ভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার রাস্তা খোলা রাখে, সারদা কেলেঙ্কারী কান্ডে মদনের থেকে আগে না আসে, এবং ফিরতি হিসাবে সংসদের অধিবেশনে মমতার গোমস্তাদের বিজেপির সমস্ত বিল পাশে সমর্থনের প্রতিশ্রুতিও থাকলো এই শ্রমিক আন্দোলন দমনের নামে।  
তৃতীয় কারণ : রাজ্যে আগামী বছরের নির্বাচনে সরকারী বামেদের বিকল্প হিসাবে শক্তিবৃদ্ধিতে নেহাতই আতঙ্কে মমতার সরকার ও পার্টি, তার শুকনো কথায় যে চিড়ে ভেজেনি গোটা বাংলা তার সাক্ষী দিচ্ছে।  কৃষকের আত্মহত্যা বাড়ছে তীব্র ভাবে, চাষের সংকট গভীর হচ্ছে, সেচ উন্নয়ন না হওয়ায় এবং সরকারী উদাসীনতায় ফি বছর শস্য হয় খরায় না হয় বন্যায় নষ্ট হচ্ছে, শ্রমিকেরা কাজ হারাচ্ছেন, লক আউট হচ্ছে বেশি বেশি, শিক্ষিত বেকারদের জন্যে চাকরীর সুযোগ অনেক কম, বাকি দেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বেতন মান কম, এবং সর্বোপরি রিয়েল এস্টেট, সিন্ডিকেট, ও তেলে ভাজা বাদে এই রাজ্যে নতুন কোনও শিল্প গড়ে ওঠেনি, কর্ম সংস্থান তো দুরের কথা।  তাই ধর্মঘট সমর্থনকারীদের পিটিয়ে শুধু গায়ের ঝাল মেটানো নয়, সাথে সাথে আগামী বছরের নির্বাচনের আগে একটা ভীতি ও সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করাও এই আক্রমণের অন্যতম কারণ। 

শত বাঁধা সত্তেও, বাজারী আনন্দবাজারের বিলাপ সত্তেও এই রাজ্যের শ্রমিকরা দেশের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে লড়াই করে যে ভাবে ২রা সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটকে বাংলায় সফল করেছেন তার জন্যে তাঁদের জানাতেই হচ্ছে অশেষ অভিনন্দন ও ধন্যবাদ। এই লড়াই করে তাঁরা প্রমাণ করলেন আবার কবি সুকান্তের সেই কবিতা আজও কত প্রাসঙ্গিক - 

বন্ধু, তোমার ছাড়ো-উদ্বেগ, সুতীক্ষ করো চিত্ত,

বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।

মূঢ় শত্রুকে হানো স্রোত রুখে, তন্দ্রাকে করো ছিন্ন,
একাগ্র দেশে শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন।

ঘরে তোলো ধান, বিপ্লবী প্রাণ প্রস্তুত রাখো কাস্তে,
গাও সারিগান, হাতিয়ারে শান দাও আজ উদয়াস্তে।

আজ দৃঢ় দাঁতে পুঞ্জিত হাতে প্রতিরোধ করো শক্ত,
প্রতি ঘাসে ঘাসে বিদ্যুত আসে জাগে সাড়া অব্যক্ত।

আজকে মজুর হাতুড়ির সুর ক্রমশই করে দৃপ্ত,
আসে সংহতি; শত্রুর প্রতি ঘৃণা হয় নিক্ষিপ্ত।

ভীরু অন্যায় প্রাণ-বন্যায় জেনো আজ উচ্ছেদ্য,
বিপন্ন দেশে তাই নিঃশেষে ঢালো প্রাণ দুর্ভেদ্য!

সব প্রস্তুত যুদ্ধের দূত হানা দেয় পূব দরজায়,
ফেনী ও আসামে, চট্টগ্রামে ক্ষিপ্ত জনতা গর্জায়।

বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ম করো চিত্ত,
                                      বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।                                     

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে