ব্যাপক শ্রমিক ঐক্যের স্বার্থে আজ প্রয়োজন শ্রমিক-কর্মচারীদের মঞ্চ

বুধবার, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

শ্রমিক সংঘ গুলির মধ্যে এক ব্যাপকতম ঐক্য গড়ে তোলা ও তার মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেনীর সংহতিমূলক সংগ্রাম গড়ে তোলা আজ এক জরুরি কর্তব্য রূপে দেখা দিচ্ছে।  ৮০'র দশকে সিপিআই (এম-এল) নেতা মহাদেব মুখার্জী শ্রমিক ঐক্য কেন্দ্র নামে একটি মঞ্চ গঠন করেন, যার কর্মসূচি ছিল শ্রমিকদের, বিশেষ করে চটকল শ্রমিকদের বিভিন্ন ইউনিয়নে ভাগ হয়ে থাকা শ্রমিকদের একটি ঐক্যের জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাতে করে তাঁরা তাঁদের ইউনিয়ন করতে করতে অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে  বাঁধায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন।  গোঁড়াতে এই মডেল এ সাফল্য পাওয়া গেলেও পরবর্তীকালে শ্রমিক ঐক্য কেন্দ্র এক ধরণের বিলুপ্তির শিকার হয়।  অথচ আজকের পরিস্থিতিতে যখন শ্রমিক শ্রেনীর সংগ্রামগুলি বিভিন্ন বাম ও দক্ষিণপন্থী ইউনিয়নের পতাকাতলে বিভাজিত হয়ে রয়েছে, সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্র ছাড়া শ্রমিকদের স্থানীয় সংগ্রামে ইউনিয়নগুলির কোনো ঐক্যই যখন চোখে পড়ে না এবং যখন নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতির চোলাই জোর করে শ্রমিকদের খাওয়ানো হচ্ছে, তখন এই রূপ একটি মঞ্চ বড় বেশি জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। 

শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পারে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক - ফ্যাসিবাদী রাজনীতির মোকাবিলা করতে। আজ একের পর এক শ্রমিক বিরোধী নীতি ও প্রস্তাব গ্রহণ করে নরেন্দ্র মোদীর সরকার যখন তার মালিক মার্কিন বৃহত পুঁজির কাছে দেশের স্বার্থ কে অর্পণ করছে, তখন শ্রমিকদের দেশব্যাপী সংগ্রাম গড়ে তোলা আজ এক জরুরি কর্তব্য। প্রধানত শ্রমিকদের আজ লড়তে হবে সারা দেশে সমান হারে ন্যুনতম বেতনের দাবিকে উর্দ্ধে তুলে। একদিকে যখন বিজেপি সরকার প্রাক্তন সেনাদের জন্যে এক পদ এক পেনশন নীতি সমর্থন করছে ও সেই নীতি নানা কায়দায় প্রণয়ন করার নাম করে প্রাক্তন সেনাদের লবিকে তোয়াজ করছে, যখন তারা রাজ্যে - রাজ্যে কর বৈষম্য তুলে দিয়ে কর্পোরেট ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলির স্বার্থ রক্ষায় অভিন্ন পণ্য ও পরিষেবা করের ব্যবস্থা প্রণয়ন করার প্রস্তাব সংসদে রাখছে এবং সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিকে এই বিষয়ে আলোচনায় বসার ডাক দিচ্ছে তখন শ্রমিকদের স্বার্থে সারা দেশে অভিন্ন ন্যুনতম মজুরি আইন পাশ করাতে বিজেপির সামনে বাঁধা কি ? কোন রাজনৈতিক দল খোলাখুলি এমন কোনো আইনের বিরোধিতা করে তা লোকসভায় বা রাজ্যসভায় রুখে দেওয়ার চেষ্টা করবে? তাহলে শ্রমিকদের স্বার্থে এমন আইন আনতে বাঁধা কোথায় ?


বাঁধা হল মোদী সরকারের শ্রেণী স্বার্থ।যে শ্রেনীর স্বার্থ রক্ষা করার ব্রতী হয়েছে মোদী সরকার, সেই শ্রেনিগুলির স্বার্থ রক্ষা হয় একমাত্র চরম নগ্ন ভাবে শ্রমিকদের শ্রম কে শোষণ করে এবং তাঁদের ন্যায্য অধিকার হরণ করে। তাই দেখা যায় যখন দেশের জনগণের উপর নানা ভাবে পরোক্ষ করের বোঝা বাড়িয়ে চলেছে অরুণ জেটলি ঠিক সেই সময় কারণে অকারণে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলি কে উদারতার সাথে কর ছাড়ের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হচ্ছে, এমন কি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন কালেও যেটুকু অধিকার শ্রমিক শ্রেণী উপভোগ করতে পারতো তাও আজ বিজেপি সরকারের খাঁড়ার কোপে পড়ছে।  বাজারী সংবাদ মাধ্যমগুলি তারস্বরে চিত্কার করে এই সমস্ত শ্রমিক মারা নয়া উদারনৈতিক নীতিগুলিকে দু হাত তুলে সমর্থন করছে, তারা মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করছে যে এই রকম ভাবে মালিক স্বার্থ রক্ষাকারী আইন কানুন থাকলে দেশে বিনিয়োগের আবহাওয়া তৈরি হবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে।  কিন্তু একটি সত্য তারা কেউ বলে না যে, এই সমস্ত নয়া উদারনৈতিক নীতি প্রণয়ন করার পর থেকে ভারতে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম ভাবে বেড়েছে, বেকার সংখ্যা ক্রমাগত উর্ধ্বমুখী হয়েছে এবং মালিক পক্ষের তরফ থেকে কল কারখানা বন্ধ করে শ্রমিক কর্মচারীদের পেটে লাথি মারার ঘটনাও বেড়েছে চরম ভাবে। 


আমরা দেখেছি কি ভাবে সংবাদ মাধ্যম ও উচ্চবিত্তদের বড় অংশ ইন্টারনেট সহ প্রচার মাধ্যমের সকল জায়গায় প্রাক্তন সেনা কর্মীদের জন্যে এক পদে এক পেনশন ব্যবস্থা প্রণয়নের আন্দোলনকে সমর্থন করে এসেছে। এই সমর্থনের কারণ দেশের বিশাল সেনা বাহিনীকে নিজেদের পক্ষে রাখার প্রচেষ্টা। অথচ যে মুহুর্তে ট্রেড ইউনিয়নগুলি জোট বেঁধে শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরী মাস প্রতি ১৫০০০ টাকা করার দাবি তুলছে তখন ক্ষিপ্ত হয়ে হায়নার মত শ্রমিকদের এই ন্যায্য দাবির উপর বিজেপি ও তার দালাল পেটোয়া প্রচার মাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়ছে।  যদিও শ্রমিকদের এই মজুরী কেন্দ্র সরকার বা রাজ্য সরকার কে নয়, দিতে হবে সেই সব বৃহত মুত্সুদ্দি পুঁজিপতি ও বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে, তবুও এই ক্রোধ ও বিদ্বেষ প্রমান করে যে শ্রমিকদের তাঁদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য দিতে আজ এই সব কর্পোরেটদের বুক কাঁপছে।  এই সমস্ত কর্পোরেট সংস্থাগুলি চায় একমাত্র নগ্ন শ্রমিক ও সম্পদ শোষণ ও লুণ্ঠনের অধিকার, যে দল বা যে সরকার এদের এই ঘৃণ্য অভিলাষা পূর্ণ করতে সক্ষম হবে তার পক্ষে এরা প্রচার করবে এবং সেই দল কে ভোটে জিতিয়ে আনতে কোটি কোটি টাকা খরচা করবে।  

আজ বিজেপি - আরএসএস এর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এই সমস্ত কর্পোরেটদের নয়নতারা হয়েছে এই কারণেই যে এরা দাঙ্গা হাঙ্গামা - জাতি ও ধর্ম বিদ্বেষের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির মাধ্যমে প্রথমত শ্রমিক ঐক্য ভাঙ্গতে ওস্তাদ, অন্যদিকে এরা খোলাখুলি রাখঢাক ছাড়া শ্রমিক বিরোধী মালিক তোষণকারী নীতি প্রণয়ন করতে সক্ষম, যা ভারতের বেশির ভাগ ভোটবাজ পার্টি পারে না। তাই আজ মোদী সরকারকে দেশের শাসক শ্রেণী নিজেদের কাঁধে তুলে নাচছে।  

শ্রমিক মারা এই নীতিগুলির বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বর্তমান সংগ্রাম বড়ই বিছিন্ন ও অনৈক্যে ভরা।  তার কারণ দেশের মধ্যে সমস্ত শ্রমিক সংগঠনগুলি, ট্রেড ইউনিয়নগুলি আজ নিজেদের অভিভাবক পার্টির নীতি গ্রহণ করে শ্রমিক সংগ্রামে আগুয়ান হতে ব্যর্থ। যদি এক জায়গায় বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন আন্দোলন করে মালিকের বিরুদ্ধে তবে সেখানে নিজেদের সুবিধাবাদী অবস্থান বজায় রেখে বিরোধী ইউনিয়ন মালিকের পক্ষ নেবে। সর্ব ভারতীয় শ্রমিক ধর্মঘটেও  এই ভাগাভাগি প্রকট হয়েছিল এবং ২রা সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটের সাফল্য অর্জনের পর শ্রমিক ইউনিয়ন এর নেতারা আর কোনও বৃহত আন্দোলনের পথে না নেমে শুধু অপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করে বসে থাকলো।  এই ভাবে ইউনিয়নগুলির ভেদাভেদের ফলে মার খাচ্ছে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই গড়ে তোলার কাজ, এবং এইরূপ অবস্থায় শ্রমিকদের ঐক্য অর্জনের জন্যে একটি যৌথ মঞ্চ গঠন করা খুব জরুরি।  

নীতিগত ভাবে এই মঞ্চে যে কোনও ইউনিয়নের শ্রমিকরা যোগ দিতে পারবেন ও ঐক্যবদ্ধ ভাবে সংগ্রাম করতে পারবেন কর্পোরেট সংস্থা ও মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে সেই ব্যবস্থা গড়ে তোলা আজ শ্রমিক শ্রেনীর মধ্যে কাজ করা সংগঠকদের এক অবশ্য কর্তব্য। নিত্য নতুন নতুন কারখানায় - অফিস কাছারীতে শ্রমিক ও কর্মচারীদের উপর আক্রমণ বাড়ছে এবং এই অবস্থায় শ্রমিক - কর্মচারীদের একটি ঐক্যের মঞ্চে এনে এবং ইউনিয়নগুলির সংকীর্ণ গন্ডির থেকে বের করে নতুন ভাবে রাজনীতিতে শিক্ষিত করে তোলার জন্যে এই রকম একটি মঞ্চ আজ বিশেষ ভাবে গড়ে তোলা দরকার। 

কি রকম হবে এই মঞ্চ ?

যে কোনো ইউনিয়নের শ্রমিক সভ্য বা তার বাইরের শ্রমিকরাও এই মঞ্চে যোগদান করতে পারবেন।ইউনিয়নগুলির ঝান্ডা ছাড়াই এই মঞ্চে তাঁরা সামিল হলে একে অপরের সাথে হাত মিলিয়ে ঘোষিত শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যে তাঁদের ইউনিয়ন থেকে বহিস্কৃত করতে পারবে না সেখানকার নেতৃবৃন্দ আবার ইউনিয়নগুলির থেকে স্বাধীন মঞ্চ হওয়ার কারণে এই মঞ্চে ইউনিয়নের নীতি মেনে কারুর সাথে হাত মেলানো বা না মেলানোর কোনও বাঁধা থাকবে না। আধুনিক কলকারখানা ও অফিস কর্মচারীগণ, যাদের ইউনিয়ন করার অধিকার মালিকপক্ষ ও সরকার কেড়ে নিয়েছে, তাঁরাও এই মঞ্চে যোগ দিয়ে বৃহত সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এই ভাবে একই মঞ্চে বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ইউনিয়নগুলির বাইরে যে সমস্ত শ্রমিক ও কর্মচারীগণ আছেন তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেন। 

আন্দোলনের দিশা নির্দেশ 

প্রতিটি রাজনৈতিক বিষয় নিয়েই শ্রমিক ও কর্মচারীদের শিক্ষিত করে তোলা যেমন এই মঞ্চের প্রধান কাজ হবে, যাতে তাঁদের চেতনার মান উন্নত হয় এবং তাঁরা রাজনৈতিক ভাবে অগ্রগামী হন, তেমনি সেই সমস্ত শ্রমিক কর্মচারীদের স্বার্থে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে তাঁদের সামিল করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ও আন্দোলনের দিশা নির্দেশ ঠিক করা এই মঞ্চের কাজ হবে।  নেতৃত্ব সবসময় শ্রমিক ও কর্মচারীদের হাতেই রাখতে হবে যাতে তাঁরা স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন এবং সেই সিদ্ধান্ত কে কার্যকরী করার জন্যে যাবতীয় নীতি ও কৌশল গ্রহণ করতে পারে। এই মঞ্চ কে রাজনৈতিক ভাবে সক্ষম ও উন্নত করে তোলা ছাড়া এই মঞ্চের কর্মকান্ডে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ শ্রমিক সংগঠক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ কে করতে দেওয়া উচিত হবে না। বরং যত বেশি শ্রমিকরা রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত হয়ে নিজেরা সংগ্রামের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন তত বেশি করে তাঁদের চেতনার মান এবং লড়াই করার ক্ষমতার উন্নতি হবে।  
  

            
        

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে