মার্কিন নির্বাচনের চাপেই মোদী'র "সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের" গল্পে বাজার গরম করার প্রচেষ্টা

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

মোদীর মুখে শান্তি বাণী  সত্বেও উরি বা অন্য কোনো ঘটনা নিয়ে মার্কিন সমর্থনে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হতে পারে




অনেক বছর আগে যখন নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিল আর মনমোহন সিংহ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিল, তখন প্রায় প্রতিদিন পাকিস্তানের সাথে সীমানায় সংঘর্ষ ও উগ্রপন্থী হানা নিয়ে কড়া কড়া ভাষণ দিত নরেন্দ্র মোদী। সেই সময়ে নরেন্দ্র মোদী দাবি করতো যে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হলে পাকিস্তানকে কড়া জবাব দেবে বিজেপির সরকার। প্রধানমন্ত্রী পদে বসার দুই বছরের মধ্যে মোদীর রাজত্বে ঘটেছে পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর, পাঠানকোট বিমান ঘাঁটিতে হামলা, এবং সর্বশেষ হলো উরি সেনা ছাউনিতে হামলা। এই হামলার পরেই তথাকথিত “জাতীয়তাবাদী” মিডিয়া একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধের ডঙ্কা বাজিয়ে, ভারী ভারী শব্দ বাণ ছুড়ে টিভির পর্দা আলো করে স্টুডিওর শীত তাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে পাকিস্তান কে সীমিত ও পূর্ণ যুদ্ধ দ্বারা একেবারে কাবু করার নানা ফন্দি দর্শকদের জানালো টিভি সামরিক বিশেষজ্ঞরা, এছাড়াও সমস্ত অন্তর্জাল জুড়ে ভাসতে থাকলো মোদী ভক্তদের যুদ্ধের হুঙ্কার, কেউ কেউ হিসেব কষে বলে দিল যে মার্কিন যুক্তরাস্ট্র কে সাথে নিয়ে পাকিস্তানকে কি ভাবে বিচ্ছিন্ন করে কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে হারিয়ে দেওয়া যায় এবং পাকিস্তানের ভূ খন্ডকে দখল করা যায়। এরই মধ্যে একাংশ আবার পাকিস্তান ও চীন দুই দেশকেই জব্দ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সাথে অন্যান্য সামরিক শক্তির মদত চাওয়ার বুদ্ধিও দিল। এত শতের মধ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস চুপ থাকে কি করে? আরএসএস নেতা ও কাশ্মীরের উপর ভারতীয় খবরদারি ও দখলদারি বজায় রাখার কৌশল ও রণনীতি পরিকল্পনা করার মূল হোতা রাম মাধব বললো যে দাঁতের বদলে পাকিস্তানের চোয়াল ভেঙে দিতে হবে। আরএসএস ময়দানে নামতেই অনেকে আশা করেছিল যে মোদী যুদ্ধ বা সীমিত যুদ্ধের পরিকল্পনা তো করবেই। রিলায়েন্স গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ কুইন্ট নামক ওয়েবসাইটটি তো “গোপন সূত্রের” খবর পাওয়ার ভিত্তিতে একেবারে জানান দিয়ে দিল যে ভারতীয় সেনা নাকি একেবারে সানি দেওলের সিনেমার মতন হেলিকপ্টারে করে পাকিস্তানে ঢুকে ব্যাপক যুদ্ধ করে ২০ জন ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী সহ ২০০ জন কে মেরেছে। চাটুকারিতার এহেন নিদর্শনে তাজ্জব হয়ে গেল সেনাবাহিনীই। ভারতের সৈন্য বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিরা খোলাখুলি অস্বীকার করলো এই রকম কোনো অভিযানের কথা। ফলে কুইন্টের ঢপের কীর্তন শুনে যে ভক্তকূল উল্লাস করছিল তাদের উপর যেন একেবারে পাহাড় ভেঙে পড়লো।

বেশ কিছুদিন পরে আবার ২৮শে সেপ্টেম্বর সার্জিকাল স্ট্রাইক করে ৩৫ জন জঙ্গী খতমের দাবি করে ভারতের সেনাবাহিনীর ডিজিএমও রণবীর সিংহ। দাবি করা হয় যে ভারতের বাহিনী নাকি বলিউডি কায়দায় পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে নানা জঙ্গী ঘাঁটিতে হামলা করেছে আর এই ঘটনার ফলে নাকি পাকিস্তানের সাথে ভারতের সেনার গোলাগুলি হয়েছে। খবরের সততা অবশ্য পাকিস্তান অস্বীকার করেছে আর দাবি করেছে ভারত শুধু গোলাবর্ষণ করেছে যার ফলে দুই পাকিস্তান সৈনিকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আগু পিছু কিছুই বিচার না করে ভারতের সেনা কর্তার বক্তব্য কে বেদ বাক্য মেনে ভারতের কর্পোরেট মিডিয়া অক্ষরে অক্ষরে প্রচার করে জানান দিতে থাকলো যে ভারত উরির ঘটনার বদলা নিয়ে নিয়েছে এবং মোদী নিজের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে। যদিও মোদীর উপর ভক্তকূলের আশা ছিল ইন্দিরা বা লাল বাহাদুরের কায়দায় এক সম্পূর্ণ যুদ্ধ করার তবে কোঝিকোডের মোদী উবাচের প্রিয় তার ঢাক বাজানো বন্ধ হয়েছে মাত্র কিছু দিন আগে। আর ঠিক কি হয়েছিল কোঝিকোডে?  

মোদী ভক্ত ও কর্পোরেট মিডিয়ার শেষ আশা ছিল যে মোদী উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের আগে দলীয় কর্মীদের তাঁতিয়ে তুলতে এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সাথে সাথে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট,ও পাঞ্জাবের নির্বাচনের প্রাক্কালে উগ্র জাতীয়তাবাদের জোয়ার ছড়িয়ে হিন্দুত্ববাদ কে জেতাতে নিশ্চয় কোনো জঙ্গী পদক্ষেপ নেবে। দেশজোড়া সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো কেরলের কোঝিকোডে বিজেপির সমাবেশে। কেরলে মোদী মুখ খুললো বটে তবে সেই মুখ খোলা ছিল ধূর্ততায় ভরা। একদিকে মোদী পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একঘরে করার, সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র ঘোষণা করার কথা বললো, অন্যদিকে বেকারি, দারিদ্র্, অশিক্ষা ইত্যাদির বিরুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তান কে একসাথে যুদ্ধ করে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার কথা বললো। কানহাইয়া কুমারের ঐতিহাসিক “আজাদী” স্লোগানের কয়েকটা বিষয়কে কাটছাঁট করে, বিশেষ করে আরএসএস এর কাছে নিষিদ্ধ “আজাদী” শব্দটা বাদ দিয়ে কিছু ভেজাল নেহরুবাদী ভাষণ দিল মোদী।

ভক্তকূল যে যুদ্ধের আশায় দিনরাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি, সেই যুদ্ধ তাদের কল্পনাতেই থেকে গেল। যুদ্ধের লাইভ কভারেজের জন্যে যে সমস্ত কর্পোরেট মিডিয়া গোষ্ঠী স্পন্সর খুঁজছিল, তারাও কেমন ম্রিয়মান হয়ে গেল আর যুদ্ধ না শান্তি নিয়ে বিতর্ক সভা করার জন্যে স্পন্সর খোঁজা শুরু করলো1। আর ২৮শে সেপ্টেম্বরের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর আবার যুদ্ধের খিদেতে কাতর হয়ে রক্তের জন্যে হাহাকার করা সেই কর্পোরেট মিডিয়া ও হিন্দুত্ববাদী এজেন্টদের জন্যে অক্সিজেন নিয়ে আসলো। সবার আগে মোদীর সমর্থক ভারতীয় মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা ও তাদের পোষা বড় কর্তারা চিৎকার করে সমর্থন জানান দিল আর সেই আওয়াজ শুনে পদলেহী মিডিয়ার কেষ্ট বিস্টুরা সব তর্ক-বিতর্ক সরিয়ে রেখে মিনিটে মিনিটে প্রচার করতে থাকলো ভারতের বদলার, দেখে মনে হচ্ছে কর্পোরেট মিডিয়ার ন্যাংটো হয়ে বাজারে এসে নিজেকে সরকারের প্রচার মন্ত্রকের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করার দিন খুব বেশি দূরে নয়। কোন সাংবাদিক প্রশ্ন করলো না যে কেমন করে এই হামলা করা হয়, যে তিনটি সেক্টরের কথা ভারতীয় সেনা বলছে সেখানে যে জঙ্গী ঘাঁটির উপর আক্রমণের কথা বলা হলো সেগুলো কাদের, কি করে জানা গেল সেগুলো জঙ্গী ঘাঁটি তা নিয়ে কোনো উচ্চ বাচ্য ভারতের সেনা বাহিনীর নেই।কর্পোরেট মিডিয়াও জনগণের চোখে ঠুলি পড়াতে পেরে খুশি আর ভারতীয় সেনা কর্তারাও মোদী ও বিজেপির মুখ রক্ষা করতে পারার জন্যে খুশি। আর কোনো প্রশ্নই উঠলো না যে যদি এক রাতের হামলায় ভারতীয় সেনা এত জঙ্গী কে মারতে পারে তাহলে আবার ভবিষ্যতে এই রকম অভিযান আর হবে না ঘোষণা করে রণবীর সিংহ কাকে বার্তা দিতে চাইলো? ঘটনাগুলো অনেকটা নাটুকে হয়ে গেল না ?


মোদীর খোলাখুলি যুদ্ধে না যাওয়ার স্বিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই পরিণত রাজনীতির পরিচয় বলে মনে হয়েছে, অনেক তথাকথিত বামপন্থী লোকেরাও মোদী সাহেবের কোঝিকোডে দেওয়া দারিদ্র মোচন ও অশিক্ষা দূর করার আহ্বান কে সাধুবাদ জানালো, চারিদিকে যখন মোদীর ভক্তকূল যুদ্ধং দেহি ফানুস ফেটে যাওয়ায় হা হুতাশ করছিল ঠিক তখন দেশের গণতান্ত্রিক শিবিরের অনেকেই মোদীর এই নয়া নাটকের শিকার হয়ে গেলেন। যুদ্ধ হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আরএসএস বা বিজেপি জঙ্গী হিন্দুত্ববাদ আর যুদ্ধের পক্ষে জনমত কে উগ্র জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলার রাজনীতি থেকে সরে শান্তি আর প্রগতির রাজনীতি গ্রহণ করেছে। আরএসএস আর বিজেপি কে উত্তর প্রদেশ, গুজরাট আর পাঞ্জাবে কোনঠাসা অবস্থা থেকে উঠে এসে রাজ্যের মসনদে বসতে যুদ্ধ না হোক তো অন্তত পক্ষে যুদ্ধ যুদ্ধ জঙ্গীপনার আবহাওয়া কে জিইয়ে রাখতে হবে ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্র দেশপ্রেমের জোয়ার কে জাগিয়ে তুলতে হবে প্রতি কয়েক সপ্তাহ অন্তর। বর্তমানে ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে সরকারী ভাবে যুদ্ধ বা সীমিত সামরিক হঠকারিতার পিছনে মার্কিন সমর্থন ভীষণ প্রয়োজন, বিশেষ করে এমন এক সময়ে যখন পাকিস্তানের সাথে ভারতের পুরানো প্রভু রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে আর চীনের সাথেও ইসলামাবাদের দোস্তি সুদৃঢ় অন্যদিকে ভারতের সরকারও পাকিস্তানের আব্বা মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সাথে শুধু সামরিক ও পারমানবিক সমঝোতায় নয় বরং একে অপরের ঘাঁটি ব্যবহার করার মতন লিমোয়া চুক্তির নাগপাশে বাঁধা পড়েছে। মার্কিন দেশে এই সময়ে নির্বাচনের হাওয়া, মুসলমান বিদ্বেষ, এশীয় জনজাতির প্রতি বিদ্বেষ ও অন্যন্য প্রকারের বর্ণ বিদ্বেষ ছড়িয়ে রিপাব্লিকান পার্টির  ডোনাল্ড ট্রাম্প যে প্রচারের ঝড় তুলে সাদা চামড়ার ভোটের মেরুকরণ করছে তাকে রুখতে ডেমোক্রাট হিলারি ক্লিন্টনের পক্ষে ভারতীয় ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভত মার্কিন ভোটারদের নিজের পক্ষে ধরে রাখা ভীষণ দরকার, আর তাই এই মুহূর্তে কোনো রকম যুদ্ধ অভিযানে মার্কিন আশীর্বাদ জুটবে না। তাই মোদী ৫৬ ইঞ্চির ছাতি ফুলিয়ে পাকিস্তান ধ্বংস করার কথা না বলে সেই পুরানো বামপন্থী বুলিগুলো কে নতুন সংঘ পরিবারের বোতলে করে চোলাই করে সময় কাটাচ্ছে। বড় মাত্রার যুদ্ধের জন্যে অন্তত নভেম্বর অবধি অপেক্ষা করতে হবে। ততদিন রণবীর ও মনোহর পরিক্করেরা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের গল্প শুনিয়ে বাজার গরম করে রাখবে।

মোদী যখন ক্ষমতায় এসেছিল সেই সময় দেশজোড়া একটা কংগ্রেস বিরোধী রোষানলের লাভা বয়ে চলেছিল। ব্র্যান্ড মোদীর পক্ষে নির্বাচনে প্রায় ১৬ কোটি ভোট পাওয়া সম্ভব হয়েছিল কারণ জাতীয় স্তরে বিজেপি ছাড়া কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে কেউ উঠে আসতে পারেনি। দুই বছরের মোদী শাসনকালে জনগণের দুর্দশা মনমোহন সিংহের কংগ্রেসী আমলের চেয়েও বেশি হয়েছে, খাদ্যবস্তু ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া হয়েছে, জনকল্যাণ প্রকল্পগুলোর খাতে খরচা কমানো হয়েছে বার বার, কৃষি সংকট তীব্র হয়েছে - ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বিতরণ তো দূর অস্ত, বরং যাদের হাতে স্বল্প জমি আছে তাঁদেরও জমির উপর কর্পোরেট আগ্রাসনের জূজূ তাড়া করে বেড়াচ্ছে। প্রতিটি বিদেশ ভ্রমণেই মোদী ভারত কে “হার্ড সেল” করার চেষ্টা করে, বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যের জমি-জল-জঙ্গল বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজি ও তাদের ভারতীয় দালাল আদানি-আম্বানি গোষ্ঠী কে বেচার জন্যে মৌ এর পর মৌ সই করেছে কেন্দ্র ও সেই সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা। সম্প্রতি বিজেপি শাসিত ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস এই সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে মুম্বাই শহরে  “মোমেন্টাম ঝাড়খন্ড গ্লোবাল ইনভেস্টর্স সামিট ২০১৭” অনুষ্ঠানে খনিজ সমৃদ্ধ ঝাড়খন্ডকে “মেক ইন ইন্ডিয়া” অভিযানের গেটওয়ে হিসেবে তুলে ধরে প্রায় ১৯৫০ কোটি টাকার মৌ সই করেছে। ঠিক উরি সেনা ছাউনির উপর আক্রমণের দুই দিনের মাথায়। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ, যখন দেশের রাজনীতি জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে উত্তাল ছিল তখনই চুপচাপ কুখ্যাত আদানি গোষ্ঠী ও বেদান্ত গোষ্ঠীর সাথে ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকার প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকার মৌ চুক্তি সই করে তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প ও ইস্পাত প্রকল্পের নামে। এই সমস্ত প্রকল্প রূপায়ন করতে ঝাড়খণ্ডে ব্যাপক হারে আদিবাসী উচ্ছেদ অভিযান চলবে, অপারেশন গ্রিন হান্টের নামে চলবে আদিবাসীদের উপর দমন পীড়ন। কেন্দ্রের মোদী সরকার ও বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির সরকার একের পর এক প্রকল্প নিয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর উন্নয়ন করার জন্যে যখন লেগে পড়ে রয়েছে তখন জনতা কে শুধু “সুদিন” বা “আচ্ছে দিন” আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের বাক্সের দিকে টেনে আনা যে খুবই কঠিন তা নাগপুরের জানা আছে। এর সাথেই মাথায় রাখুন সমগ্র গুজরাটের দলিতদের মাথা তুলে ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, সমগ্র উত্তর প্রদেশের দলিত জনতার মধ্যে বিজেপি বিরোধী হাওয়ার প্রবলতর হওয়ার কথা, পাতিদার আন্দোলনের ফলে বিজেপির আর মোদীর হিন্দুত্ববাদের গবেষণাগার গুজরাটে ব্যাকফুটে যাওয়ার ঘটনা, যে ঘটনাগুলো তীক্ষ ইঙ্গিত করছে বিজেপির অতি কষ্টে সাজানো হিন্দুত্ববাদের মেরুকরণের তাসের ঘরের ভেঙে পড়ার সম্ভাবনার দিকে। ফলে নতুন করে সেই পুরানো ফর্মুলায় মেরুকরণ করা অসম্ভব হওয়ায় এবং তিন রাজ্যে নির্বাচনের মুখে জনগণের দৃষ্টি মূল্যবৃদ্ধি, ঘনীভূত হওয়া অর্থনৈতিক সংকট, ও সামগ্রিক ভাবে মোদী সরকারের ব্যর্থতা থেকে সরাতে যুদ্ধের ডংকা বাজানো ছাড়া আরএসএস ও বিজেপির সামনে অন্য কোন রাস্তা নেই আর নওয়াজ শরীফের কাছেও শাপে বরদানের মতই ভারতের সাথে যুদ্ধ পাকিস্তানের আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতে এবং তীব্র ইসলামিক মেরুকরণ করার কাজে মদত করবে। আর যুদ্ধ না হওয়া অবধি নওয়াজ শরীফ ও মুসলিম লীগ ভারত বিরোধী ও হিন্দু বিরোধী বিষাক্ত আবহাওয়া সৃষ্টি করে নিজের সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা জনগণের স্বর কে, গণ আন্দোলনগুলোকে শক্ত হাতে দেশপ্রেমের নামে দমন করতে পারবে।

তাই বন্ধু, যুদ্ধ যে হবে না তা নয়, হয়তো সম্পূর্ণ যুদ্ধ  না হয়ে একটা সীমিত লড়াই হতে পারে যাতে বেশ কিছু সৈনিক কে দুই দেশের সরকার ও শাসকেরা  কোরবানির পাঁঠা বানিয়ে একদিকে নির্বাচনের জন্যে ইস্যু সৃষ্টি করতে পারবে আর অন্য দিকে নানা রকমের অস্ত্র, গোলাগুলি, কফিন বা অন্য সামরিক চুক্তি বা কেনা বেচার কাজে প্রচুর কমিশন আয় করতে পারবে। ঠিক যেমন একদিন বাজপেয়ীর আমলে একদিকে কার্গিল যুদ্ধ কে ব্যবহার করে মূল্য বৃদ্ধি ও বিলগ্নিকরণের ফলে নাজেহাল হওয়া জনতার দৃষ্টি ঘুরিয়ে উগ্র দেশপ্রেমের হাওয়া তুলে ভোট কুক্ষিগত করেছিল বিজেপি আর অন্যদিকে সেই কার্গিলে মৃত সৈন্যদের দেহাবশেষ নিয়ে যাওয়ার জন্যে কফিন কেনার অছিলায় কোটি কোটি টাকা পকেটস্থ করেছিল বড় বড় রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, আমলা ও সেনা কর্তারা। ভুলে গেলে চলবে না যে সৈন্য বাহিনীর নামে দেশপ্রেমের শপথ নেয় যে বিজেপি সেই বিজেপিই কিন্তু বঙ্গারু লক্ষণের মতন লোকেদের পুষে রাখে। আর যদি তাও করা সম্ভব না হয় নভেম্বরের পরে তাহলে দেশজুড়ে সাবর্ণ হিন্দুদের তাঁতিয়ে তুলতে এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতন কাহিনী জনগণের কানে যুদ্ধবাজ কর্পোরেট মিডিয়া ঠুসে ঠুসে ভরবে।

যদি সংকট ঘনীভূত হয় আর মার্কিন স্বার্থের অনুকূলে হয় তাহলে হয়তো নভেম্বরের পরে আর উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব ও গুজরাট নির্বাচনের আগেই পুরো মাত্রার যুদ্ধ হতে পারে, যার ফলে আবার দেশপ্রেমের জিগির তুলে নির্বাচনের মাঠে গোল দেওয়ার চেষ্টা করবে বিজেপি এবং জনগণের ঘাড়ে অসম্ভব মাত্রার করের বোঝা চাপবে। জনতার থেকে আদায় করা করের টাকায় যেমন মার্কিন সামরিক শিল্প ও আমাদের দেশের নেতা-মন্ত্রী-আমলারা ফুলে ফেঁপে উঠবে অন্যদিকে তেমনি ব্যাপক হারে কালোবাজারি করে বিজেপির আসল ভোটার মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা লাভ করবে। মৃত্যু আর ধ্বংসের দৃশ্য দেখিয়ে যখন কর্পোরেট মিডিয়া কোটি কোটি টাকা রোজগার করবে ঠিক তখনই দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র আদিবাসী জনগণ কে সামরিক শক্তির দমে তাঁদের জমি-জল-জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ করবে, তাঁদের প্রতিরোধ কে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করবে গুলি আর বোমা মেরে। সেই আদিবাসী জনগণ যদি তাঁদের জঙ্গল আর জমি রক্ষার সংগ্রামে কর্পোরেট-রাষ্ট্র যন্ত্রের এই চক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তখন এই আদিবাসীদের উগ্রপন্থী আর মাওবাদী আখ্যা দিয়ে ব্রাক্ষণত্ববাদী সরকার হত্যা করবে। এই যুদ্ধই আবার মোদী আর ভারতের শাসক শ্রেণী কে সুযোগ দেবে দেশের জনগণের, বিশেষ করে শ্রমিক ও কৃষকের রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অধিকার কেড়ে নিতে, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো খর্ব করে উগ্র দেশপ্রেমের জোয়ার তুলে ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদ কে প্রতিষ্ঠা করতে। ভারতের শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে নিজেদের স্বার্থে শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনগণ, দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো যে কয়েকটি হাতে গোনা সাংবিধানিক অধিকার আদায় করতে পেরেছিলেন তা কিন্তু যুদ্ধের নামে, রাষ্ট্র রক্ষার নামে মোদীর নেতৃত্বে ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণী খর্ব করবে, কেড়ে নেবে, এবং যুদ্ধের দোহাই দিয়ে সমগ্র দেশকে একটা রাজনৈতিক জেলখানায় পরিণত করবে।


আমাদের মধ্যে যে সকল মানুষ প্রগতিশীল রাজনীতির কথা ভাবেন, খেটে খাওয়া মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্যে লড়াই করেন তাঁদের আজ সাবধানে পা ফেলতে হবে। শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধি নরেন্দ্র মোদী বা আরএসএস-বিজেপির যুদ্ধ বিরোধী রূপে যেন আমরা বশ না হয়ে যাই। জনগণ কে যেন আমরা এই নেকড়ের দলের কন্ঠে কোকিলের স্বরে ভুলে যেতে না দিই যে এই সুন্দর সুর আসলে ভবিষ্যতের হিংস্রতা কে আড়াল করার ছল। নেকড়ের ফাঁদে পড়বেন না, নেকড়ের লক্ষ্য মানুষের বুক চিরে রক্ত মাংস খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করা।নেকড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে আমাদের তৈরি হতে হবে, মানুষকে নেকড়ের থাবা থেকে বাঁচাতে আমাদের মাঠে নামতেই হবে।       


  1. সম্প্রতি ২৮শে সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার গোষ্ঠী ঠিক এই রকমই এক বিতর্ক সভার আয়োজন একেবারে খাস “দা পার্কে” করেছিল, যেখানে জনতার টাকায় মোটা পেনশন আয় করা প্রাক্তন সেনা কর্তা ও আধা সামরিক বাহিনীর কর্তারা শুনিয়ে গেল জনতার ঘাড়ে করের বাড়তি বোঝা চাপিয়ে কেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। সেই বিতর্ক সভায় সবচেয়ে ভালো ভাবে যুদ্ধের উন্মাদনার বেলুন চুপসে দিয়েছিলেন অভিনেত্রী  দেবলীনা, যাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য তথাকথিত সামরিক বিশারদদের কপালে ওই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেও ঘামের বিন্দু এনে দিয়েছিল।


এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে