বাংলায় বিরহ শেষ হয়ে আবার মিলনের পর্বে সিপিএম - কংগ্রেস

বুধবার, জানুয়ারী ১৩, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

প্রণয়ের যে কত জোর তা আমরা ৮০-৯০ এর দশকের বাংলা ছায়াছবির পর্দায় চিত্তপুরী যাত্রার কায়দায় ব্যক্ত হতে দেখেছি৷ এক সুন্দর প্রেমের কাহিনীতে হয় মনুষ্য সৃষ্ট অথবা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির দ্বারা সৃষ্টি হওয়া কারণে প্রেমিক যুগলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়৷ তবুও সমস্ত বাঁধা বিপত্তি পার করে প্রেমিক যুগল একত্রিত হয়, বিচ্ছেদ শেষে মিলনের মধুময় সঙ্গীতে ভুবন ভরে যায়৷ মোটামুটি ভাবে বলতে গেলে এই ছকে চলেই বোম্বাই মার্কা প্রেমের ছবি বানাবার প্রচেষ্টা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা সিনেমার পশ্চাত্দ্বারে আঘাত হেনে গেছে৷

যাই হোক, আজ বাংলার বুকে ঠিক সেই রকমই একটি বিচ্ছেদে শোকাহত প্রেমিক যুগলের প্রণয়ের পর্বে নতুন করে মিলনের পর্ব ফিরে আসছে৷ যদিও দুষ্টু লোকগুলো এখনো ব্যঙ্গ করছে আর বিদ্রুপের তীর ছুড়ছে, তবুও এ মিলনের মধুর পর্ব কে কেউ এবেলা ঠেকাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না৷ কারণ মিলন তো প্রণয়ে আবদ্ধ সিপিএম আর কংগ্রেসের, যে সে কংগ্রেস নয়, একেবারে খাঁটি দিশি জাতীয় কংগ্রেস, সেই কংগ্রেস যার দালাল বলে জ্যোতি বাবুরা এক কালে হিরেন বাবুদের গাল পারতেন৷

আগে লুকোচুরি করে চুমু খাওয়া চলতো সজনে গাছের তলায়, পরে ব্যাপারটা অনেকটা সেই - পাড়ায় সবাই জানে কার সাথে কার ইয়ে চলছে কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলেনা- অবস্থা ছিল৷ পরবর্তীকালে সিপিএমের এককালের শত্রুর কাছে জ্যোতি বোস - হরকিষেণ সুরজীতরা ধুতির কাছা খুলে খোলাখুলি প্রেম নিবেদন করে সেই ৯০ এর দশকের শেষ কালে, যার পরিনাম স্বরূপ সংসদীয় বামেদের কাঁধে চেপে কংগ্রেসের ২০০৪ সালে দিল্লীর মসনদ দখল৷ মধুচন্দ্রিমা পর্ব শেষ হওয়ার পর অবশ্য সম্পর্কে প্রকাশ্যে চিড় ধরে৷

প্রকাশ কারাতের তীব্র গগনভেদী বিপ্লবী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হুঙ্কার আর নীতির দ্বন্ধ সেই সম্পর্কে অবনতির কারণ হিসাবে জ্ঞানী-গুণী-সুধীগণ দেখাতে চাইলেও ব্যাপারটা একটু বেশি গভীর ছিল৷ ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি বাম সিপিএমের তাগিদ ছিল নিজের বাম গন্ধ যুক্ত আলখাল্লাটি ধারণ করে রাখা৷ সব ঠিক চলছিল কিন্তু পশ্চিম বাংলায় টাটা ও সেলিমের পুঁজির জন্যে খেমটা নাচার সময় আচমকা সিপিএমের ঘোমটা খুলে যায়৷ সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামে পুলিশ আর জোতদারদের খুনি বাহিনী দিয়ে প্রতিবাদী কৃষকদের উপর নির্মম অত্যাচারের যখন সারা দেশে আর বিদেশে বিরোধিতা হচ্ছে আর রাজনৈতিক ভাবে ২০০৪-২০০৬ সালের নির্বাচনের পর শেষ হয়ে যাওয়া তৃণমূল যখন জনদরদী বামপন্থী স্লোগানের আড়ালে বাংলার মাটিতে ভিত্তি তৈরি করছে, ঠিক সেই সময়ে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এবং বাংলার মানুষকে ক্ষণিকের জন্যে বিভ্রান্ত করতে কারাতের সেই কংগ্রেস বিরোধী আস্ফালন জন্ম নিয়েছিল৷

যাই হোক ২০০৮ সাল থেকে মোটামুটি ভাবে সিপিএম ও সরকারি বামফ্রন্টের নির্বাচনী পতন শুরু হয়৷ কংগ্রেসের নির্বাচনী বিপত্তি শুরু ২০১৩ থেকেই৷ পশ্চিমবাংলার মসনদে মমতাকে শিখন্ডি করে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসলেও কিছুদিনের মধ্যেই ওদের মধ্যে গদির চামড়া নিয়ে কামড়া কামড়িতে কংগ্রেসীদের চাকরী যায়৷

অনেক পাঁড় কংগ্রেসী যারা এক কালে ঘাড়ে পাউডার লাগিয়ে টিভি চ্যানেলে মমতাকে গাল পারতেন, তাঁরাও পরে নিজের থুতু নিজে চেটে মমতাময়ী মুখ্যমন্ত্রীর দলে নাম লেখান৷ শেষে এক সময়ে অবস্থাটি সেই ৯৭-৯৮ সালের মতন হয়ে যায়, কে যে মূল আর কে তৃণমূল ঠাওর করা মুশকিল হয়ে যায়৷

একটা পর্বে আবার সিপিএম ও কংগ্রেস দুই দলেরই দোকান থুড়ি আপিস খুলে ধূপ ধুনো জ্বালাবার লোকের অভাব প্রচন্ড ভাবে প্রকট হয় আর নিজ রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদ দুই শিবিরে চোখে পড়ে৷ মানুষের স্বার্থ বলে অশোক ভট্টাচার্য মশাই কংগ্রেস - বিজেপি সবাই কে নিয়ে শিলিগুড়ি মডেল গড়ে তোলেন৷ এই মডেলের মূল কথা হলো নীতি চুলোয় যাক, যে করেই হোক ক্ষমতা চাই৷

এই শিলিগুড়ি মডেলের 'পথনির্দেশক তাত্বিক ভিত্তির' উপর দাঁড়িয়ে সিপিএম আজ সার্বিক জোটের পক্ষে ওকালতি করছে, বুদ্ধ - গৌতম - ইয়েচুরি-সূর্য সব শেয়ালের এখন এক রা, কংগ্রেসের সাথে জোট গড়ে তোলো বাংলায়৷ জোটের পক্ষে ওকালতি করার সময়ে অবশ্যই সেই "এটা একটা রণকৌশল কমরেড" আর "কংগ্রেস একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল" সুর দুটিকে আবার ঝেড়ে মুছে পুরানো গ্রামোফোনে বাজানো হচ্ছে৷

বস্তুতঃ এই জোটের খবরে আনন্দবাজার মার্কা বাজারী কর্পোরেট মিডিয়া গোষ্ঠীর আনন্দের শেষ নেই৷ আনন্দবাজার খুব খুশি যে সিপিএমের প্লেনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে কোন লোক দেখানো হম্বিতম্বি নেই৷ মালিকের উপর থেকে সিপিএমের কটু কথার আক্রমণ শেষ হতেই আনন্দবাজার দু হাত তুলে শাসকশ্রেণীর পক্ষ থেকে সিপিএমের সাথে কংগ্রেসের জোটের সম্ভাবনা কে সাধুবাদ জানিয়েছে৷ এর মানে অবশ্য এই নয় যে শাসকশ্রেণী মমতার পক্ষ থেকে সরে গেছে৷ সম্প্রতি বঙ্গে বিশ্ব ও দিশি বৃহৎ পুঁজির সমাবেশে মমতা নর্তন কীর্তন করে জানান দিয়েছেন - "মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক - আমি তোমাদেরই লোক"৷ তাই মমতার পতন যে ২০১৬ তে সহজে হবে সে কথা বাতুলতা৷

পশ্চিমবাংলার রাজনীতির নীতি আদর্শ ও তথাকথিত কৌশলের যদি একটি মূল্যায়ন করা হয় তাহলে নিম্ন লিখিত সূত্রগুলি বের হয়:

১. তৃণমূল কংগ্রেস - জন্ম হয়েছিল কংগ্রেস কে সিপিএমের বি টিম বলে, বিশেষ করে সোমেন মিত্তির, সুব্রত মুখুজ্জ্যে, ইত্যাদী কে গাল পেড়ে মমতার তৃণমূলের জন্ম৷ পরবর্তীকালে সেই সুব্রত আর সোমেন তৃণমূলের টিকিটে জেতে৷ প্রথমে মমতার তৃণমূল টিকে থাকে বিজেপির ভেলায় চেপে, পরবর্তী কালে সেই বিজেপির সাথ ছেড়ে কংগ্রেসের সাথে জোট গড়ে সরকার গঠন এবং তারপর কংগ্রেস কে লাথি মারা হয় সরকার থেকে, বর্তমানে তৃণমূল পুরানো মিত্র বিজেপির বৃহৎ বিরোধী সাজার প্রচেষ্টায় রত৷ নিন্দুকেরা বলেন যে ভিতরে ভিতরে গট আপ কেস, তৃণমূলের মদতে বাংলায় কল্কে পেয়েছে আরএসএস আর বিজেপি৷

২. বিজেপি - বাংলায় মমতার হাত ধরে প্রবেশ, পরে মমতা বিজেপিকে অচ্ছুত বললেও বিজেপি মমতাকে টানার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে অবিরত৷ শোনা যায় সারদা কান্ডের চাপে গোপন বোঝাপড়া হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে কিছু কেন্দ্রে তীব্র বিভাজন সৃষ্টি করার স্বার্থে৷ একার দমে বাংলার মাটিতে কোনো নির্বাচন জেতার ক্ষমতা নেই৷

৩. কংগ্রেস- বিজেপির মতন নিজের ক্ষমতায় নির্বাচনে জিততে পারবে না, চাই সহযোগিতা৷ মমতার সাথে জোটে গেলে পার্টির স্বাধীন অস্তিত্ব আর থাকবে না৷ কংগ্রেস কে ব্যবহার করে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছিল এবং এবার সিপিএম ও মেকি বামেরা সেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে৷

৪. সিপিএম ও বামফ্রন্ট - একার জোরে এক কালে ভোটে জেতার ক্ষমতা রাখলেও বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা নিমতলার ঘাটে এসে ভিড়েছে। পার্টি ফান্ডে দেওয়ার লোক নেই, পার্টি আপিসে ধুপ ধুনো দেওয়ার লোক নেই, মে রিগিং করে ভোটে জেতানোর মেশিনটাই তৃণমূলি ভেলায় ভিড়েছে। ফলে আজ প্রচেষ্টা হলো কংগ্রেস কে সাথে নিয়ে যে করেই হোক ভোটের হার বাড়িয়ে মমতাকে গদিচ্যুত করা।       ​

এত সবের মাঝে যখন বিশ্লেষকের দৃষ্টি থেকে এই পুরানো মদ নতুন বোতলে চোলাই হওয়া দেখি, এবং তার সাথে সাথে দেখি মমতা আর বিজেপির পশ্চিমবাংলার মানুষকে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও অসহনশীলতার ভিত্তিতে গোপনে ভাগ করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা তখন সব চেয়ে বেশি করে রাগ হয় সেই সব তথাকথিত বামপন্থীদের উপর যারা পত্র-পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেটে সিপিএম তথা সমগ্র বামফ্রন্ট কে এই জোটের বিরুদ্ধে যেতে বলছে শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের স্বার্থের কথা বলে৷

এই মেকি বাম সংসদীয় তুলসী পাতা বেটে খাওয়া আঁতেলদের একটা অংশ এই সিপিএমের সাথে জোট গড়ে কিছুদিন আগে বিহারের নির্বাচন লড়েছিল, আর বিরাট বাম ঐক্যের কথা বলে পশ্চিমবাংলার মাটিতেও বৃহৎ বামফ্রন্টের পক্ষে ওকালতি করেছিল৷

এদের এই সমালোচনা কিছু সুধীগণের কাছে বাম রাজনীতির বিশুদ্ধতা রক্ষার লক্ষণ মনে হলেও আদতে এই প্রচেষ্টা বিশ্ব একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির স্বার্থে রক্ষিতার মতন জনগণের দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা করছে৷ তাঁদের প্রচেষ্টা হলো যে সিপিএম জনগণের চোখে হেয় হয়ে গেছে, সাম্রাজ্যবাদ ও দালাল দিশি বৃহৎ পুঁজির কাছে আত্মসম্মান বিক্রি করেছে আর কংগ্রেসের দালাল হিসাবে পরিচিত হয়েছে, সেই সিপিএম যে আজও শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থের ধ্বজাধারক তা প্রতিপন্ন করা৷ এই আধুনিক কালের কাউত্স্কি মার্কা আঁতেলদের দল সিপিএমের খুলে ফেলা বিপ্লবী মুখোশ আবার বুদ্ধ-ইয়েচুরির মুখে জোর করে লাগাতে চায়৷

বর্তমানে ভারতবর্ষের জনগণের জীবন ও জীবিকার উপর যখন আরএসএস-বিজেপির সাম্প্রদায়িক ব্রাক্ষণবাদী ফ্যাসিবাদের খড়্গ ঝুলছে, যে সময়ে দেশের সম্পদ ও জনতাকে পাইকারি দরে মার্কিন ও পশ্চিমী বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির কাছে মোদী সরকার বিক্রি করছে, যে সময়ে পশ্চিমবাংলার মানুষ কে তৃণমূল ও বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও হিংসার রাজনীতির সম্মুক্ষীন হতে হচ্ছে, সেই সময়ে সব চেয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হচ্ছে এক দেশজোড়া বৃহৎ ফ্যাসিবিরোধী ফ্রন্ট গড়ে তোলা৷ যে ফ্রন্ট শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের ঐক্য রক্ষার্থে বিভাজন ও লুণ্ঠনকারী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে শক্তিশালী এক প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারবে৷ আর ঠিক এই নীতির মোড়কে সিপিএম আজ মৃতপ্রায় কংগ্রেস কে আবার বাঁচিয়ে তুলতে চাইছে৷ সেই কংগ্রেস যার সাথে গরু বাদে বিজেপির নীতিগত কোনো পার্থক্য নেই৷

তাই আজ প্রকৃত ফ্যাসিবিরোধী শক্তির কর্তব্য সিপিএম কে নীতি জ্ঞান দেওয়া নয়, বরং তীব্র কষাঘাত করে সিপিএমের স্বরূপ সমগ্র দেশের শ্রমিক ও কৃষকের কাছে প্রকাশ করা এবং মৃতপ্রায় সিপিএম ও তার লেজুড় সরকারি ও আধা সরকারি বামেদের আজ দেশজোড়া গণতান্ত্রিক ফ্যাসিবিরোধী ফ্রন্ট থেকে আলাদা করা৷ যে সকল লোকেরা আজ সিপিএম - কংগ্রেসের অবৈধ মিলনের বিরোধিতা করছেন তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন অথবা ভুলিয়ে দিতে চাইছেন যে সিপিএম ও কংগ্রেস যুগ যুগ ধরে প্রণয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ, এ কোনো নতুন কৃষ্ণ লীলা নয়৷ তাই তাঁদের সিপিএম কে দেওয়া জ্ঞান ভস্মতে ঘৃত ঢালার চেয়ে বেশি কিছু নয়৷ জাগ্রত জনতার তীব্র গণসংগ্রামের ঢেউ এই নীতিকথা শোনানো বিভীষণদের পশ্চাত্দেশে সপাটে লাথি কবে মারবে সেই অপেক্ষায় অধীর (চৌধুরী নয়) হয়ে অপেক্ষা করি৷

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে