তৃণমূলের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ

শুক্রবার, জানুয়ারী ১৫, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

অডি গাড়িকে আমি অনেকদিন শুধু অলিম্পিকের গাড়ি ভাবতাম, ওই চক্র লাগানো গাড়িটা যে বিশাল দামী কিছু একটা সে খবর কখনও রাখিনি৷ যাই হোক রাস্তায় দুই দশক সাইকেল চালিয়ে এই সত্যটা খুব হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম যে যত দামী গাড়ি তার নিচে ততই বেশি চাপা পড়ে মরার সম্ভাবনা৷ অতএব আমরা যারা সাধারণ পথচলতি মানুষ তাঁরা চিরকাল ওই গাড়ির গর্জনে ভয় পাই৷

হয়তো সেই বায়ুসেনার কর্মী অত কিছু জানতেন না৷ জানলে বোধহয় এভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাতেন না৷ আবার বায়ু সেনার কর্মী, রেড রোড এলাকায় ২৬ জানুয়ারীর আগে গাড়িতে পিষ্ট হয়ে মৃত্যু, আর গাড়ির মালিক মমতাময়ী মুখ্যমন্ত্রীর দলের লোক, তাই তো মৃত্যুর ঘটনা রাজ্য রাজনীতিকে নাড়া দিল৷ নয়তো জ্যোতি বাবু তো বলেই গেছেন - এমনটা তো হয়েই থাকে৷

সত্যিই তো, এমনটাই তো হয়ে থাকে৷ অর্থবল, রাজনৈতিক ক্ষমতা, ইত্যাদির নেশায় বুঁদ হয়ে যখন বাবুদের অথবা বাবুদের হাফ-বাবু ড্রাইভারদের পা এক্সিলারেটরে চাপ দেয় তখন তো সাধারণ মানুষেরই সাবধান হয়ে চলা উচিত৷ কারণ সেই গাড়ির চালকের কাছে তাঁরা সামান্য কীট পতঙ্গের বেশি কিছু নন৷ যখন তখন আমাদের উড়িয়ে দিয়ে সেই অডি বা মার্সিডিজ তো পগার পার আর আমরা পটল তুলে পরের দিনের খবরের কাগজের অন্যন্য খবরের তালিকায় "পথ দুর্ঘটনায় হত" শিরোনামে হয় একটি নাম জুড়ে দেব না হয় অজ্ঞাত পরিচিত থেকে যাব৷ শুধু বাড়ির লোক পথ চেয়ে বসে থাকবে ফিরে আসার অপেক্ষায়, যতক্ষণ না কাঁটাপুকুর থেকে খবর এসে  অপেক্ষার ইতি টানবে৷

মমতা বলেছেন দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে, পুলিশ ধরবে, এই হবে আর সেই হবে, ইত্যাদী হম্বিতম্বি৷ সত্যই এই দুর্ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তির কপাল একদিক থেকে ভালো যে বায়ু সেনার চাপে সরকার স্বীকার করেছে যে দুর্ঘটনায় একজনের প্রাণ গেছে৷ নাহলে তো "সাজানো ঘটনা", "ষড়যন্ত্র", ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত হতে হতো মৃত্যুর পরে৷ কারণ গাড়ি তো শাসকদলের নেতার, যাদের পেশী পশ্চিমবঙ্গে সরকারি সীলমোহরের চেয়ে বেশি শক্তিশালী৷

চাপে পড়ে মমতা ব্যানার্জী বলেছেন যে ঘটনার তদন্ত হবে, ফেরার অভিযুক্তকে পুলিশ ধরবে, ইত্যাদি৷ অথচ সেই নৌ সেনার প্রাক্তন প্রধানের নাতির দ্বারা চালিত বিএমডব্লিউ'র তলায় চাপা পড়ে মৃত্যু, সলমান খানের গাড়িতে পিষ্ট হয়ে ফুটপাথবাসীদের মৃত্যু (আদালতের রায় বলছে সেই খুনি গাড়ি কেউই চালাচ্ছিল না), আর এই গত বছরে হেমা মালিনীর গাড়িতে চাপা পরে এক শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ভারতবাসী সাধারণ মানুষদের কি এই শিক্ষা দেয়নি যে বড়লোকের গাড়ি চাপা পড়ে মরলে কোনো বিচারব্যবস্থাই গাড়ির চালক বা মালিককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারে না?

তৃণমূলের পুলিশ প্রশাসন যে সত্যিই দোষীদের ধরে বিচারে পাঠাবার সাহস দেখাবে সে কথা বদ্ধ উন্মাদ ও অন্ধ তৃণমূল ভক্ত বাদে পশ্চিমবঙ্গের কোনো নাগরিক বিশ্বাস করেন না৷ যে রাজ্যে পুলিশকে পেঁদিয়ে পুলিশের খাতায় ফেরার থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সাথে হাঁটা যায়, যে রাজ্যে তৃণমূল না করলে বাড়ির রেশন বন্ধ হয়ে যায়, যে রাজ্যে শাসকদলের যাত্রা নায়ক সাংসদ ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে বিরোধী দলের মহিলা সমর্থকদের ধর্ষণ করার হুমকি দেয়;  সেই রাজ্যে আইন মেনে তৃণমূল নেতার শাস্তি হবে ভোটের বছরে সে আশা গুড়ে বালি৷

বিশ্লেষকের বিশ্লেষণ হলো যে লোক দেখানো তদন্ত হবে এবং তার দুই ধরনের ফলাফল হতে পারে:

১) সাত তাড়াতাড়ি একজন ড্রাইভার সেই হিন্দি সিনেমার কায়দায় আত্মসমর্পণ করে দুর্ঘটনার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে রেড রোডের অডি কান্ডের ইতি টেনে মোটর গাড়ি আইন মোতাবেক কয়েক বছরের জন্যে ঘানি টেনে ফিরে আসবেন৷ তৃণমূল নেতা অথবা নেতা পুত্র কেউই সেদিন বা কোনদিনই ওই অডিতে চড়েননি সেকথা আদালতে প্রমাণ করা তৃণমূলের দুঁদে উকিল বাহিনীর কাছে নস্যি৷

২) চেনা ছকের থেকে বেড়িয়ে দেখা যাবে আচমকা পুলিশ বাহিনী সেই অভিযুক্ত কে জেলে বন্দী করলো এবং রীতিমত মোকদ্দমা দায়ের করা হলো৷ চারিদিকে তখন শুধু জয় মমতাময়ী মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর নিরপেক্ষ প্রশাসনের জয়৷ কিছু নিন্দুকেরা জিভ কামড়ে কালীঘাটে পাঁঠা বলি দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করবেন৷ অথচ সেই অভিযুক্ত জামিনের আবেদন করে কিছুদিন পরেই বাইরে চলে আসবেন, হয়তো একেবারে ভোটের আগেই৷ তখন ভোটের বাজারে নানা খবরের ঠেলায় এই কেসের খবর কারুর মনেই থাকবে না৷ ঠিক যেমন মানুষ আজ মনে করতে পারেন না যে সিদ্ধার্থ বশীষ্ঠ ওরফে মনু শর্মা লোকটা কে৷

বিচারের বাণী শ্রেণী বিভক্ত সমাজে চিরকাল নিভৃতে কাঁদবে যদি না অভিযুক্ত গরীব আর আভিযোগকারী ধনী হয়৷ শ্রমিক কৃষক ও মেহনতি মানুষ পথে ঘাটে, চাষের ক্ষেতে, বন্ধ কারখানার কোয়ার্টারে বা চা বাগানের চিলতে কুঠিরে শোষণের আর লুণ্ঠনের রোলারের নিচে চাপা পড়ে রোজ রোজ মরে৷ আর এভাবে মরতে হয় বলেই হয়তো নিজ শ্রেণীর শাসন স্থাপন করার উদ্দ্যেশ্য বারবার উত্তোলিত হয়ে আগুয়ান হয় সমাজ বিপ্লবের পথে৷ হয়তো সেই সমাজে গাড়ি চড়ে ঘোরা শিক্ষা ও সাফল্যের মানদণ্ড হবে না এবং তীব্র গতিতে বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালানো কোনো বীরত্বের পরিচয় হবে না৷

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে