হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত ছাত্র নেতা রোহিথ ভেমুলার মৃত্যু ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার মুখোশ খুলে দিল

সোমবার, জানুয়ারী ১৮, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

হায়দ্রাবাদের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত ছাত্র নেতা ও বিজ্ঞান গবেষক রোহিথ ভেমুলার আত্মহত্যার খবর চাউর হয়ে যেতেই দেশের কোনে কোনে ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র ও যুব সম্প্রদায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। প্রায় ১২ দিন ধরে হোস্টেল থেকে বিতারিত হয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়ে ধর্না ও অনশন আন্দোলন চালানোর পরে ১৭ই জানুয়ারী বিকেলবেলায় রোহিথ ভেমুলা আত্মহত্যা করেন।

রোহিত ভেমুলা সহ মোট পাঁচজন দলিত সম্প্রদায়ের ছাত্রদের প্রায় দুই সপ্তাহ আগে হোস্টেল থেকে বিতাড়িত করে হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ছাত্র - ছাত্রীদের মতে ভেমুলার মৃত্যু শুধু আত্মহত্যা নয়, এটা জাতি বিদ্বেষী হত্যা যার জন্যে দায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, আরএসএসের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি,  বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বন্দ্রায়ু দত্তাত্রেয়া, ও ব্রাক্ষণত্ববাদী প্রশাসন।

রোহিথ ভেমুলা ও তাঁর সাথীরা নব্য বামপন্থী দলিত আন্দোলনে জড়িত এবং আম্বেদকর ছাত্র সমিতির সাথে জড়িত ছিলেন। গত বছরের ২রা অগাস্ট মুজ্জাফারনগর দাঙ্গার উপর বানানো চলচিত্র প্রদর্শনে বাঁধা দিয়ে আরএসএস এর ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের গুন্ডারা যে সন্ত্রাস চালায় দেশের মুক্ত ও স্বাধীন চেতনার মানুষদের উপর, তার তীব্র প্রতিবাদ করে রোহিথ ও তাঁর সাথীরা হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত ছাত্রদের তরফ থেকে কঠিন ভাষায় নিন্দা করেন। এরই সাথে তাঁরা তীব্র বিরোধিতা করেন ইউসুফ মেমনের ফাঁসির, যা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের নেতাদের তুষ্ট করার এক রাষ্ট্রীয় প্রয়াসের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না।  

রোহিথ ও তাঁর সঙ্গীদের আরএসএসের ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে  এই তীব্র আক্রমণ বন্দ্রায়ু দত্তাত্রেয়া ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের প্রচন্ড উত্তেজিত করে তোলে, কারণ আম্বেদকর ছাত্র সমিতির ছেলে মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে মুসলমান ও দলিত ছাত্র ছাত্রীদের অধিকারের কথা বলে আরএসএসের ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলছিলেন। ক্ষিপ্ত দত্তাত্রেয়া তাঁর সাগরেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কে নির্দেশ দেয় যেন এই “দেশদ্রোহী” এবং “উগ্রপন্থী” ছাত্র ছাত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যার ফলস্বরূপ বহু দিন ধরে চলা বিভিন্ন ধরনের বিভেদমূলক আচরণ করার পর একদিন আচমকা এই আম্বেদকর ছাত্র সমিতির পাঁচ মেধাবী ছাত্র ও গবেষককে হোস্টেল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় উপাচার্যের আদেশে। ব্রাক্ষণত্ববাদী নিয়মে তাঁদের প্রায় এক ঘরে করে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর, তাঁদের অবাধ চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে উপাচার্য’র দফতর।

এই ঘৃণ্য ব্রাক্ষণত্ববাদী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে এই পাঁচ ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনেই অবস্থানে বসেন। তাঁরা প্রতিবাদ করেন এবং সেই প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি সারা ভারতে এবং ক্রমেই বিদেশেও শোনা যায়। দেশের প্রগতিশীল ও বাম - গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠনগুলি এই পাঁচ দলিত ছাত্র ও তাঁদের লড়াইয়ের সমর্থনে সংহতিমূলক আন্দোলন গড়ে তোলেন দেশের কোনায় কোনায়। হায়্দ্রাবাদেও লড়াই তুঙ্গে ওঠে, যার ফলে এক সময়ে প্রশাসনিক দফতর দখল করার আন্দোলনেরও সাক্ষী থাকে এই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

এই জঙ্গী আন্দোলনে এবং প্রগতিশীল ছাত্র জোট এবিভিপি ও সংঘ পরিবারকে এত আতঙ্কিত করে তোলে যে তারা সাম্প্রদায়িক ও জাতি বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দলিত ছাত্র আন্দোলনের বিরোধিতা করা শুরু করে। অতি দক্ষিণপন্থীদের নিত্য করা জাতি বিদ্বেষ মাখানো কটুক্তি ও নিম্ন মানের সমালোচনা শুনেও এই ছাত্ররা তাঁদের আন্দোলন চালিয়ে যান। কিন্তু একটা স্তরে এসে ব্রাক্ষণত্ববাদী এবিভিপি, আরএসএস দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা ব্যবস্থার চরম ঘৃণ্য ব্যবস্থা রোহিথ ভেমুলার অন্তরকে নাড়িয়ে দেয়। ধীরে ধীরে হত্যা করে তাঁর স্বপ্ন ও ইচ্ছাগুলিকে, এবং এর ফলে একদিন এই চাপের সামনে নতি স্বীকার করার চেয়ে মৃত্যুকেই সহজ মনে করেন রোহিথ।

দলিত-আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু মানুষের উপর যে ভাবে আদি সনাতনী সামন্ত প্রথায় এই দেশে আক্রমণ আজও চলছে স্বাবর্ণ শাসক শ্রেণী ও তাঁদের পোষা প্রচার মাধ্যম ক্রমাগত সেই সংবাদকে বিছিন্ন ঘটনা বলে চতুরতার সাথে ঢেকে দেয় নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির ঢাক বাজিয়ে।

রোহিথের মৃত্যু আজ সংবাদ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু উচ্চ জাতির শাসক শ্রেণীর মুখপত্র ও প্রচার মাধ্যমগুলি রোহিথের মৃত্যুকে শুধু এক আত্মহত্যা বলে প্রচার করে তাঁর নিদারুণ পীড়ন, বেদনা ও কষ্টকে শুধুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা হিসেবে দেখিয়ে ঢেকে দিতে চাইবে ভারতবর্ষে দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘু মানুষের উপর স্বাবর্ণ শাসক শ্রেণীর অত্যাচার কে। এই ঘটনার পিছনের রাজনীতিকে, আর্থ - সামাজিক শোষণ ও অত্যাচারকে লুকিয়ে রেখেই তো সম্ভব শোষিত ও নিপীড়িত জাতির যেটুকু অধিকার এই দেশে আছে, যেমন উচ্চ শিক্ষায় ও সরকারি চাকরিতে সামান্য সংরক্ষণ, তার বিরুদ্ধে দেশের স্বাবর্ণ উচ্চ শ্রেণীর মানুষদের ক্ষেপিয়ে তোলা, ঠিক যেমনটা একদিন কর্পোরেট প্রচার মাধ্যম ২০০৬ সাল নাগাদ করেছিল দিল্লিতে দলিত ছাত্রদের বিরুদ্ধে স্বাবর্ণ সমাজকে পথে নামিয়ে।

বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির বাঁশের ডগায় চেপে আরএসএস ও বিজেপি ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করার রাস্তায় আজ ভীষণ জোরে দৌড়াচ্ছে। পেছনে ধোঁয়া দিচ্ছে কর্পোরেট প্রচার মাধ্যম। দেশজুড়ে স্বাবর্ণ উচ্চ ও মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজকে ধর্মের মেরুকরণের মাধ্যমে এক ছাতার তলায় আনা হচ্ছে। যাতে করে সংখ্যালঘু ও দলিত-আদিবাসী সমাজের দমন পীড়নের স্বার্থে এবং শ্রমিক কৃষকের আন্দোলন ভাঙ্গার স্বার্থে এক চরম ফ্যাসিবাদী বর্ণ বিদ্বেষী ব্রাক্ষণত্ববাদী ব্যবস্থার গোড়া পত্তন করা যায়।

ভারতবর্ষ আজ সারা দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির লুণ্ঠনের এক স্বর্গ রাজ্য। এই বেহেস্তে ৭২টি সুন্দরী কুমারী পরীর জায়গায় আছে সস্তা শ্রম, অবাধ কাঁচা মাল ও প্রাকৃতিক সম্পদের পাহাড়। আর এই দেশকে নির্বিবাদে লুট করার স্বার্থে দরকার শ্মশানের শান্তি। সেই শান্তি আজকের পরিস্থিতিতে একমাত্র শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের ঐক্য ভেঙ্গে, তাঁদের একে অপরের রক্ত পিপাসু নেকড়েতে পরিণত করেই সম্ভব। তাই তো আজ হিন্দুর সাথে মুসলমানের যে কোনো মূল্যে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিতে শাসক শ্রেণীর তল্পিবাহক খাকি হাফ প্যান্ট বাহিনী এত উদগ্রীব। তাই তো স্বাবর্ণ হিন্দুদের পদ লেহন করতে অস্বীকার করা দলিত সমাজের উপর নেমে আসে নির্মম অত্যাচারের খাঁড়া। এই অবাধ লুণ্ঠনের স্বার্থেই তো আজ আদিবাসী জনগণের থেকে জল-জমি-জঙ্গল কেড়ে নেওয়ার স্বার্থে চালানো হচ্ছে অপারেশন গ্রীন হান্ট নামক সামরিক অভিযান। আর আদিবাসী দলিত ও সংখ্যালঘু মানুষের উপর অত্যাচারের বিরোধিতা যে বা যাঁরা করছেন তাঁদের হয় রাষ্ট্রদ্রোহী বলে গারদের পিছনে পুরে দেওয়া হচ্ছে অথবা রোহিথের মতন মৃত্যুর পথে জোর করে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

রোহিথের মৃত্যু চোখে আঙ্গুল তুলে সমাজের সেই রক্ষকদের ভন্ডামো কে আবার দেখিয়ে দিল, যারা কথায় কথায় প্রকান্ড ঐক্যবদ্ধ হিন্দু সমাজের গান গায় এবং দলিতদের ভোট ব্যাঙ্ক দখল করতে দলিতদের দুঃখ কষ্ট নিয়ে কুম্ভিরাশ্রুর বান ছোটায়। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি জাস্টিস মার্কান্ডেয় কাটজু যেমন রোহিথের মৃত্যুতে বলেছেন যে এ দেশে এক সম্পূর্ণ সমাজ বিপ্লব ছাড়া এই সকল ঘৃণ্য ব্যবস্থা থেকে ভারতীয় জনগণের মুক্তির কোনো পথ নেই; ঠিক সেভাবেই বিশ্লেষক মনে করে যে এক সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে বর্তমান ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণী ও তাঁদের তাঁবেদারদের উৎখাত করে শ্রমিক কৃষক ও মেহনতি মানুষের স্বার্থে, দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘু মানুষের স্বার্থে এক স্বাধীন, মুক্ত ও নয়া গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ গড়া ব্যাতিরেকে হাজার বাতলামো করলে দেশের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির কোনো সুরাহা হবে না।

সিদ্ধান্ত আজ দেশের কাঁচা চুলের গরীব ঘরের যুবদের নিতে হবে যে তাঁরা কি এই শোষণ অত্যাচার আর বঞ্চনার মাঝে নিজেরা মরে মরে বাঁচবেন এবং পরবর্তী প্রজন্মকেও সেই জীবনই দিয়ে যাবেন, না কি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে শাসক শ্রেণী ও তাঁদের তল্পিবাহকদের বিরুদ্ধে লড়ে নিজের দেশের উপর নিজের অধিকার কায়েম করবেন।

          

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে