মমতার রাজত্বে বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবার কারণ সত্যিই এক বৃহৎ ষড়যন্ত্র

বুধবার, আগস্ট ৩১, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

মুর্শিদাবাদের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আগুন লাগার পর থেকেই যেন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরে আগুন লেগেছে। তাপ যে স্বাস্থ্য মন্ত্রক নিজের দখলে রাখা মমতার পক্ষে কষ্টদায়ক হচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সাংবাদিক বৈঠকে আলপটকা মন্তব্য শুনে।আগুনের পিছনে কি কারণ তা যদিও দমকল দফতরের তদন্ত করা উচিত কিন্তু মহাময়ী মমতা সরকারের নির্দেশে এবার সে কাজে নামবে রাজ্য সিআইডি, যে সংস্থার একমাত্র কাজ হলো পুলিশ মন্ত্রী মমতার খাড়া করা তত্ব কে সত্যে প্রমাণিত করা। নির্বাচনে গদি হারিয়ে খিড়কির দরজা দিয়ে রাজ্যের একটি নিধিরাম সর্দার স্বাস্থ্য সমিতির উচ্চ পদে আসীন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য যে কি ভীষণ দূরদর্শী তা বোধহয় "চক্রান্তের" তত্ব আসার আগে বাংলার মানুষ জানতে পারেননি। জানতে পারলে বোধহয় এবার চন্দ্রিমা কে ভোটে গো হারা হারতে হতো না।

তৃণমূলের রাজত্বে পশ্চিম বাংলার রাজনীতি যে কোন গড্ডালিকায় ঢুকেছে তা দেখতে বেশি দূরদৃষ্টি লাগে না


চক্রান্তের তত্ব তো প্রতিষ্ঠা হয়েই গেছে। এয়ার কন্ডিশনার চালিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গদি কাড়তে নাকি অধীর চৌধুরীর লোকেরা হাসপাতালে আগুন লাগাতে চেয়েছিল। তিনজন মানুষ, যার মধ্যে একটি ছোট মেয়েও আছে, তাঁরা হঠাৎ মারা গেলেন আর তাঁদের নিকট আত্মীয় স্বজনরা জানলেন যে মৃত্যু যে হাসপাতালে আগুন লাগলো সেই হাসপাতালের উর্দ্ধতন কতৃপক্ষ বা স্বাস্থ্য দফতরের গাফিলতির ফলে লাগেনি বরং লেগেছে কংগ্রেস আর সিপিএমের (মুর্শিদাবাদে সিপিএমের হাল যদিও হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের থেকেও বেহাল) চক্রান্তের কারণে। স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর মানুষের কাছে সরকারের ফরমান এলো, তাঁরা যেন বেশি দাবি দাওয়া না করেন, করলে বিপদ আছে সে কথাও বুঝিয়ে দেওয়া হলো। আর মমতার রাজত্বে স্বাস্থ্য দফতরের অব্যবস্থার কথা বলাও বা ভাবাও মহা পাপ। কারণ এই রাজ্য উন্নয়নের স্বর্গরাজ্য, এই হলো সব পেয়েছির রাজ্য। তাই তো বিরোধীরা গায়ের জ্বালা মেটাতে হাসপাতালে আগুন লাগায় !

তৃণমূলের রাজত্বে পশ্চিম বাংলার রাজনীতি যে কোন গড্ডালিকায় ঢুকেছে তা দেখতে বেশি দূরদৃষ্টি লাগে না। এক দিকে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যেমন আল্ট্রা সাউন্ড, এমআরআই, সিটি স্ক্যান, মায় এক্সরে মেশিনের অভাব, অন্যদিকে প্রতিদিন বেড়ে চলেছে রুগীর সংখ্যা। অপ্রতুল পরিকাঠামো আর গড়িমসির সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও যে সকল ডাক্তার, নার্স, ও হাসপাতাল কর্মীরা মানুষ কে সুস্থ করে তোলার ভয়ানক যুদ্ধ করছেন, আর এর মধ্যেই অবহেলার ঘটনা স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে চলেছে যার ফলে মৃত্যু হচ্ছে শিশু থেকে প্রৌঢ় সকলের, আর প্রতিটি মৃত্যুর পরেই সেই মৃতের পরিবার ও স্বজনদের ক্রোধের শিকার সরকারের বদলে, তৃণমূলের মেজ-সেজ নেতাদের বদলে হচ্ছেন ডাক্তার, নার্স, আর হাসপাতাল কর্মীরা। এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে মুর্শিদাবাদের মতন যে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলো ঘটছে তার আসল কারণ তো সরকারের উদাসীনতা আর অবহেলা। কিন্তু সেই সত্য জনতা জনার্দনের থেকে গোপন করে রাখার তাগিদটা আমাদের গণতন্ত্রের ভজন গাওয়া তৃণমূলীদের কাছে বড় বেশি প্রয়োজন, তাই দরকার যে কোনো বিরোধী দলের সদস্য বা নেতাকে ধরে জেলে পুরে একটা ষড়যন্ত্রের তত্ব খাড়া করা। বয়স্ক মানুষদের আশা করি মনে আছে ১৯৭০ এর দশকে কথায় কথায় নিজের সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যবহার করা "বিদেশী হাতের" গল্প। মমতার দলের জন্ম তো সেই ফ্যাসিবাদী - মিথ্যাচারী কংগ্রেসের ঔরসেই, ফলে সেই পুরানো ষড়যন্ত্রের মদ কে নতুন বোতলে নতুন লেবেল সেঁটে বিক্রি করায় আশ্চর্য হওয়ার কোনো ব্যাপার নেই।

নাটকের বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, সেই নাটক কে অতিরঞ্জিত করে একেবারে স্বপন সাহার সিনেমা বানানোতে মমতা বাঁড়ুজ্যের জুটি নেই। শুধু মমতা বাঁড়ুজ্যের একটিই খামতি থাকে যে সে জনগণ কে চিরকালই গবেট ভেবে এসেছে। এই ধরুন যখন রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এমন মরণ দশা, যখন ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, ইত্যাদী রোগে ভোগা মানুষ সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না, যখন হাসপাতালে আগুন লাগায় বা চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশার কারণে মমতার রাজত্বে রুগীদের প্রাণ যাচ্ছে সেই হাসপাতালে যেখানে তাঁরা সুস্থ হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে এসেছিলেন, তখন  সরকারের নিজস্ব ত্রুটি ও দুর্বলতার কথা স্বীকার করে নিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করার অঙ্গীকার করা কি বেশি জরুরী ছিল না ? কিন্তু ভারতবর্ষে কোন কালে কোন নেতা বা মন্ত্রী নিজের দলের বা সরকারের গাফিলতির কথা জন সমক্ষে স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে ? মমতা তাই সেই মমতাতে, কারণ জনসমক্ষে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর সাজে না। কারণ যে সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে মমতা বা তার দল রাজনীতি করে, সেই মানসিকতা জনগণ কে গণতন্ত্রে শাসক নয় বরং প্রজা, তাও ভিখারি প্রজা, হিসেবে গণ্য করে। যাদের কিছু দান খয়রাত করলেই, দুই জন পার্টি কর্মী কে সাময়িক চাকরি দিয়ে সিভিক পুলিশ বানালেই, অসম্ভব রকমের আনুগত্য পাওয়া যায়। তাই নিজের দলের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের কোনো আত্মসমালোচনা মমতার করা সাজে না। রাজা কে বলা যায় যে ব্যাটা তুই ন্যাংটা, রাজা নিজে কখনোই সে কথা স্বীকার করবে না।

যাবতীয় তাত্বিক ও নৈতিক কচকচানির মধ্যে একটি সত্য কিন্তু প্রকাশ্যে জ্বল জ্বল করছে, তা হলো এই যে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি, বা গণ স্বাস্থ্য পরিষেবা, চরম সংকটে ডুবে আছে, আর এই ডুবিয়ে রাখার পিছনে আছে এক গভীর ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্র কোনো বিরোধী দলের দুষ্ট বুদ্ধির পরিণাম নয়, বরং দীর্ঘ সময় ধরে সমস্ত সংসদীয় দলগুলোর সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের ফসল।

পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কে পঙ্গু করার কার্য শুরু করে জ্যোতি বোসের সরকার, সেই ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিক থেকে। তখন সবে সবে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির হাওয়া ঢুকতে শুরু করেছে আর তারই সাথে সাথে শুরু হয় নার্সিং হোমের আগমন। অতীতের ছোট ছোট নার্সিং হোম ও বেসরকারি বা দাতব্য হাসপাতালের জায়গায় আস্তে থাকে বড় আর মাঝারি মাপের নার্সিং হোম যাদের বেশির ভাগের মালিক ছিল সরকারি হাসপাতালে চাকরি করা ডাক্তাররা, আবার অনেক নার্সিং হোমে কমিশনের ভিত্তিতে নিয়োগ করা হতো সরকারি ডাক্তারদের। সিপিএমের লোকাল কমিটি আর ডাক্তারি গণ সংগঠন কে হাত করেই এই ব্যবসার ভিত গভীরে শিকড় গাড়ে।পরবর্তী কালে মনমোহনীয় নয়া উদারনৈতিক বাতাসে ভেসে আসে রুবি, পিয়ারলেস থেকে এই কয়েক বছর আগে আগুন লাগা আমরি। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালগুলোয় মানুষে কুকুরে একসাথে থাকতে শুরু করে, একটা বেডের জন্যে দালাল থেকে পার্টির নেতা সবাই কমিশন খেতে শুরু করে। ফলে প্রথমে স্বছল মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আর পরবর্তী কালে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষদেরও একটু ভালো চিকিৎসার আশায় সারা জীবনের কষ্টে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে নার্সিং হোম ও বেসরকারি হাসপাতালের শরণার্থী হতে হয়। আর এই ফাঁকেই জ্যোতি বোস আর বুদ্ধ ভট্টাচার্যের আমলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রোজগার করে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে শুরু করে নার্সিং হোমগুলো। অন্যদিকে হুহু করে মান পড়তে থাকে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার। রাজ্যের সবচেয়ে নাম করা চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষা কেন্দ্র এসএসকেএম (পিজি হাসপাতাল), মেডিক্যাল কলেজ, নীল রতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ, ইত্যাদী ধুঁকতে থাকে পরিকাঠামো আর চিকিৎসকের অভাবে। রাজ্যের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগ তুলে বামফ্রন্ট সরকার চিরকাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নিজেদের কুকীর্তি চেপে রাখার চেষ্টা করতে থাকে।

পরিবর্তনের হাওয়ায় চেপে যখন মমতা ক্ষমতায় আসে তখন জন মোহিনী প্রকল্পের আড়ালে সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের হাল ফেরানোর কথা বলা হলেও (২০১২ সালে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চালু হয়) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকে সেই তিমিরেই। বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থে মমতার নেতৃত্বে চলা তৃণমূল সরকার ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের ধুঁকতে থাকা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও জোরে গড্ডালিকায় দিকে ঠেলে দেয়। ফলে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের হাল তো আরও খারাপ হতেই থাকে আর তার সাথে সাথে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর লাভের অঙ্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে।স্বাস্থ্য দফতর কে মুখ্যমন্ত্রী নিজের হাতে রাখার সাথে সাথে আরইটি স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১১-১২ সালের পরে আর প্রকাশ হতে দেয়নি, এর ফলে শেষ সমীক্ষার পরে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঠিক অবস্থানটা কোথায় তা বোঝা দুস্কর হয়ে গেছে। কথায় কথায় নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির ফর্মুলা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল ফেরানোর দাওয়াই সেই বস্তা পঁচা পাবলিক - প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলের মধ্যে খোঁজার গল্প বাদে মমতার খাতায় হাতে রয়েছে শুধু পেন্সিল।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর চাপে ভারতের শাসক শ্রেণী যখন দেশের জনগণ কে ঢপের কীর্তন শুনিয়ে শান্ত করে রাখার "উন্নয়নমূলক রাষ্ট্রের" শেষ স্তম্ভ, খাদ্য-স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙে, বেসরকারিকরণের মাধ্যমে, বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর তখন কোনো প্রদেশেই গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুস্থ্য হয়ে ওঠার আশা করা একটা অলীক কল্পনার বেশি কিছুই হবে না। কারণ বিশ্ব জুড়ে বৃহৎ পুঁজির লোভ ও লালসাকে চরিতার্থ করতে যেভাবে প্রকৃতি কে ধ্বংস করে একের পর এক দেশকে নিঃশেষ করা হচ্ছে তার ফলে বেড়ে চলা প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট দূষণের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যে অবনতি হওয়া ভীষণ সাধারণ ব্যাপার। ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে মারণ রোগগুলোর প্রকোপ ও সংখ্যা। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, কালা জ্বর, জন্ডিস, সহ অসংখ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের দিকে পা বাড়াচ্ছেন। যাদের মধ্যে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা যেমন আছেন তেমনি আছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত, গরিব, আরে একেবারে হতদরিদ্র শ্রেণীর মানুষ। উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তরা যদিও বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার সাহায্যে আরোগ্য লাভ করতে পারেন কিন্তু সেই পরিষেবার দিকে যেতে নিম্ন মধ্যবিত্তদের পা কাঁপে, গরিব বা হতদরিদ্রদের কথা বাদ দেওয়াই ভালো। কিন্তু এই ৭০ শতাংশ মানুষের আশা ও ভরসার গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অনেক উৎসাহী ও পরিশ্রমী এবং সৎ ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মী থাকা সত্বেও শুধু মাত্র লোকবল, পরিকাঠামো, আর্থিক অনুদান, এবং আমলাতান্ত্রিক ফিতের ফাঁসের চাপে এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জনগণের কোনো কল্যাণ হচ্ছে না।

২০১০-১১ সালের স্বাস্থ্য বিষয়ক সমীক্ষার ফলে দেখা গেছিল যে ভারতবর্ষে প্রায় ৬.৩ কোটি মানুষ প্রতি বছর স্বাস্থ্যের পিছনে খরচের কারণে দরিদ্র সীমার নিচে নেমে যান।গ্রামাঞ্চলে ৬.৯ শতাংশ মানুষ এবং শহরাঞ্চলে ৫.৫ শতাংশ মানুষ এই ব্যবস্থার শিকার।  এই সংখ্যাটা এই ছয় বছরে নিশ্চয় মনমোহন ও নরেন্দ্র মোদীর বিদেশী পুঁজি ও নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দামামা বাজিয়ে পুজো করার সৌজন্যে বেড়েছে, এবং এর প্রকোপ যে পশ্চিমবঙ্গে ছেয়ে গেছে সে কথাও নিশ্চয় সত্য, কারণ সমগ্র দেশে ২০০৪-০৫ সালের পরিসংখ্যানে ১৫ শতাংশ মানুষ ব্যাপক হারে বেড়ে চলা স্বাস্থ্য পরিষেবার মূল্যের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, আর ২০১১-১২ তে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১৮ শতাংশ। জনগণের এই সংকটের সুযোগ নিয়েই তো আজ দুর্গাপুরের একটা বেসরকারি হাসপাতাল টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে রুগী (গ্রাহক) টানার চেষ্টা করার সুযোগ পাচ্ছে। আমরি থেকে অ্যাপোলো, হাসপাতালের জায়গায় পাঁচ তারা হোটেল খুলে রুগীদের ঘাড় ভেঙে টাকা নিচ্ছে। এমনকি মৃত মানুষ কে ভেন্টিলেটরে রেখে যতদিন সম্ভব টাকা রোজগার করে চলেছে।এর সাথেই তাল মিলিয়ে কেন্দ্রের মোদী সরকার ও রাজ্যের তৃণমূল সরকারের ছত্রছায়ায় একের পর এক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ব্যবসার ঝাঁপি সাজিয়ে বসছে, এমনকি কোটি কোটি টাকা ক্যাপিটেশন ফি দিয়ে এই সব কলেজে বকলমে ভর্তিও চলছে। অনেক দিন আগে, ১১ অক্টোবর ২০১২ এর আনন্দবাজার পত্রিকা কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই পিপিপি মডেলের মেডিক্যাল কলেজের বিরোধিতা করেছিলেন বিখ্যাত সার্জেন ডাঃ দেবী শেঠী। তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে এর ফলে মেডিক্যাল পড়াশুনা শুধু যে গরিবের হাতের বাইরে চলে যাবে তাই নয় বরং এই সব কলেজ থেকে পাশ করে যে সব স্বচ্ছল বাড়ির ছেলে মেয়েরা কোনোদিন গরিব মানুষের সেবা করবে না বরং এই ডাক্তারি বিদ্যা ব্যবহার করবে কোটি কোটি টাকা রোজগারের জন্যে।

ষড়যন্ত্র করে ধীরে ধীরে যে ভাবে ভারতের মতন গরিব মানুষের  দেশে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে আইএমএফ ও ডব্লিউটিও'র নির্দেশে, তার ফলে আগামী দিনে অনেক বেশি বেশি করে ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকে। ১৯৯৫ সালে ভারতের জনসংখ্যা ছিল ৯৬ কোটি আর দেশের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারি লগ্নি ছিল ১.১ শতাংশ, আর ২০১৪ সালে ১২৩ কোটি মানুষের দেশ হয় সত্বেও স্বাস্থ্যের পিছনে বরাদ্দ বেড়ে জিডিপির ১.৪ শতাংশ হয় মাত্র। মোদী সরকার স্বাস্থ্য পরিষেবার নামে শুধু নানা কায়দায় স্বাস্থ্য বীমা বিক্রি করে জনগণের ন্যূনতম স্বাস্থ্য সুরক্ষার সাথে ছিনিমিনি খেলছে। মমতা সরকারও সেই একই খেলা উন্নয়ন ও জনকল্যাণের মোড়কে মুড়ে খেলছে। বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার হাতে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বেচে দেওয়ার স্বার্থে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কে শুধু গাফিলতি করে পঙ্গু করা হচ্ছে না বরং ষড়যন্ত্র করে বিকল করে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের আশার শেষ ঠিকানা সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও হাসপাতালগুলোকে। মমতা আর চন্দ্রিমার ষড়যন্ত্রের সমীক্ষায় মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে আগুন লেগে হয়তো মৃত্যু হয়েছে তিন জনের, কিন্তু যদি সরকার আর কর্পোরেট সংস্থাগুলোর এই ষড়যন্ত্র কে আমরা আরো গভীরে গিয়ে দেখি তাহলে হয়তো দেখতে পাবো যে এই ষড়যন্ত্রের জালে পড়ে সারা দেশে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ এই জন্যে মারা যাচ্ছেন যে ইচ্ছাকৃত ভাবে গণ স্বাস্থ্য পরিষেবাকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। আগুনে জ্বলে মৃত্যু হলে সরকারকে বিরোধিতার তীরে বিদ্ধ করা সম্ভব হয়, কিন্তু সারা দেশ জুড়ে যে দানা মাঝিরা আজ সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পঙ্গুত্বের কারণে প্রিয়জনদের হারাচ্ছেন তাঁদের ক্ষতি করার মূল কু চক্রী যে সরকারি নেতা-মন্ত্রী-আমলা আর কর্পোরেট প্রভুরা, তারা খুব সহজেই এই অন্যায়ের শাস্তির থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হয়।জনগণকে হত্যা করার দায়ে এই অপরাধীদের শাস্তি কোন আদালত দেবে ?

    
   


   

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে