ল্যাপটপ নয় কাশ্মীরের জনতা শুধু স্বাধীনতা চান

মঙ্গলবার, আগস্ট ১৬, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

ল্যাপটপ নয় কাশ্মীরের জনতা শুধু স্বাধীনতা চান


কাশ্মীরের মানুষ, ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা যখন সর্বত্রে ভারতীয় সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীকে দখলদারি আর আগ্রাসী শক্তির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে পাথর ছুড়ে ছুড়ে নিজেদের স্বাধীনতার দাবি জানাচ্ছেন, যখন আধা সামরিক বাহিনীর হাতে খুন, ধর্ষণ, আর ছররার আঘাতে অন্ধ ও আহত হয়েও কাশ্মীরের মানুষ প্রাণের চেয়ে বেশি প্রিয় স্বাধীনতার দাবির থেকে এক কদম পিছিয়ে আসতে রাজি নন, যখন সমগ্র ভারতের উচ্চ জাতির হিন্দুদের প্রবল ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়েও কাশ্মীরের মানুষ মানবতার পরিচয় দিয়ে ভারতীয় জনতা ও ভারতীয় শাসকশ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য রেখা টেনে সংগ্রাম করে চলেছেন তাঁদের জন্মগত অধিকার আদায় করে নিতে, ঠিক তখনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কাশ্মীর থেকে হাজারো মাইল দূরে মধ্যপ্রদেশের মাটিতে নিজের দলের কর্মী ও ভাড়াটে ভিড়ের সামনে কাশ্মীরের প্রসঙ্গে বললো যে কাশ্মীরের সমস্যা উন্নয়নের সমস্যা, পাথরের বদলে কাশ্মীরের ছাত্র যুবদের হাতে ল্যাপটপ তুলে দিলে তাঁরা নাকি শান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন, বিদ্রোহের অবসান হবে পাকা রাস্তা গড়ে আর স্বনিযুক্তি প্রকল্পের দৌলতে। যদিও মোদীর উন্নয়নের মডেল রাজ্য গুজরাটের মাটিতে আজ ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দলিত জনগণ এক অভিনব বিদ্রোহে নেমেছেন যার তাপে নরেন্দ্র ঘনিষ্ঠ আনন্দি বেন প্যাটেলের মুখ্যমন্ত্রীর চাকরিটা গেছে। দলিতেরা লড়ছেন এবং তাঁদের তীব্র লড়াই ও ধীরে ধীরে মুসলমান আর দলিতদের মধ্যে গড়ে উঠতে থাকা ব্রাক্ষণত্ববাদ ও হিন্দুত্ববাদ বিরোধী সংগ্রামী ঐক্য শাসক শ্রেণীর বিশ্বস্ত নেড়ি আরএসএস ও বিজেপির অনেক কষ্টে সৃষ্টি করা ধর্মীয় মেরুকরণের নীতির মুখেই মলত্যাগ করছে, যার পরিণাম হলো যে উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিকে যাতে গুজরাটের দলিতদের তীব্র সংগ্রাম প্রভাবিত না করতে পারে তাই নরেন্দ্র আজ চিৎপুরের যাত্রার কায়দায় ন্যাকা ন্যাকা অভিনয় করে দলিতদের নিজেদের কোঁচরে বেঁধে রাখার প্রয়াস চালাচ্ছে, আর গুজরাটে পাঁকে পড়েও নরেন্দ্র উন্নয়নের সোনার পাথরবাটির স্বপ্ন দেশের অন্যান্য জায়গার দলিত মানুষদের দেখিয়ে চলেছে ভোটে জেতার স্বার্থে। সেই উন্নয়ন আর প্রযুক্তির গল্প মোদী কাশ্মীরের বিক্ষুব্ধ মানুষকেও শোনাতে চায়।

ভারতের শাসকশ্রেণীর জন্ম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔরসে, সাম্রাজ্যবাদের জারজ সন্তান এই শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধিরা খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষকদের রক্ত আর শ্রম শুষে নিয়ে কটা রুটির টুকরো ছুড়ে দিয়ে ভাবে গরিব মানুষগুলো চুপ করে ওই রুটি চিবিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে আর শোষণ অত্যাচারের রোলারের ছোটার পথে কোনো রকমের বাঁধার সৃষ্টি করবে না। দান খয়রাত করে শোষিত মানুষের মুখ বন্ধ করার রাজনীতি মোদী শুরু করেনি, এটা শাসকশ্রেণীর এক বহু পুরানো পদ্ধতি, তবে যেহেতু গরিবের সারি প্রচন্ড লম্বা তাই এই পাইয়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করার কৌশল বারবার ব্যর্থ হয়। গরিবের মুখ বন্ধ করার মতন খয়রাত করার সামর্থ্য তো স্বয়ং মার্কিন শাসকশ্রেণীর নেই তো মোদী বা অন্যান্য ভারতীয় নেতারা কোন ছার।

কাশ্মীরে কিছু কাশ্মীরি দালাল কিনে, উত্তরপ্রদেশে কিছু দলিতকে কিনে, মোদী ভেবেছিল সবার মুখ বন্ধ করে দেবে, কিন্তু সে আশা গুড়ে বালি। সমগ্র দক্ষিণ কাশ্মীর ৩৫ দিন কার্ফু-ছররা-লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাস সয়ে লড়াই চালিয়ে গেছে। ঠিক যেমন কিছুদিন আগেই উত্তর কাশ্মীরের হান্দারা লড়াইয়ের সময়ে কাশ্মীরি জনতা আধা সামরিক বাহিনী ও সেনার তীব্র আক্রমণের সামনেও বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছিলেন হিন্দুত্ববাদী হিংস্র ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে। এই লড়াইকে চাকরি, রেশন, বা ল্যাপটপ দিয়ে কি রোখা যাবে? নিজের জন্মভূমির স্বাধীনতার দাবি করার জন্যে যে আট থেকে আশি পর্যন্ত বয়সের মানুষেরা নির্দ্বিধায় প্রাণ দিচ্ছেন খালি হাতে পাথর ছুড়ে, তাঁদের বাড়ির লোকেরা কি মৃতের বদলে সরকারি চাকরি বা ছররায় আহত হওয়া চোখের বদলে ল্যাপটপ পেয়ে আনন্দিত হবেন? মোদী বা তার চ্যালা চামুন্ডারা যখন উন্নয়নের কথা জোর দিয়ে বারবার বলছে তার মানে হচ্ছে যে পাথর হাতে কাশ্মীরি বালক বালিকারা ভারতের শাসকশ্রেণী কে প্রচণ্ড বেগ দিচ্ছে।

যখন উন্নয়নের রাস্তার গল্প,  গণতন্ত্র-মানবতা-কাশ্মীরিত্বের গল্প মোদী মধ্যপ্রদেশে বিজেপি কর্মী ও দেশি-বিদেশি কর্পোরেট মিডিয়াকে শোনাচ্ছিল, ঠিক তখনই খুনি ফৌজের প্রতি চরম ঘৃণা নিয়ে কাশ্মীরের সন্তানেরা মাতৃ ভূমির মুক্তির দাবিতে ওই উন্নয়নের ধাপ্পার ফানুস পাথর ছুড়ে ফুঁটো করছিলেন। জনতার রক্তে যখন পথ ভেসে যাচ্ছে তখন গৃহমন্ত্রী সংসদে রেশনের ট্রাকের ফিরিস্তি দিয়ে কাশ্মীরি জনতার প্রতি নিজের কর্তব্য পূরণ করার বাহবা কুড়োচ্ছিল, আর তখনই ফৌজের গুলিতে নিহত স্কুল পড়ুয়ার অভিভাবকরা, ছররা লেগে অন্ধ হয়ে যাওয়া আবাল-বৃদ্ধ-বনিতারা সকলে করুণা বা চাকরি ভিক্ষে করছিলেন না, তথাকথিত শান্তি আলোচনা ও রাজনৈতিক সমাধান দাবি করছিলেন না, দাবি করছিলেন স্বাধীনতা, তার চেয়ে কম তাঁরা কিছুই চান না।

ঘরে বাইরে কাশ্মীরে চাপে পড়া মোদী কে নিজের কাপড় বাঁচানোর স্বার্থে দালাল আর মোসাহেবদের নিয়ে জনতার নজর উগ্র দেশপ্রেম আর হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে অন্য দিকে ঘোরাবার চেষ্টা করছে। কর্পোরেট প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে দেশের উচ্চ জাতির বাবুদের মধ্যে মুসলিম বিরোধী প্রচার তুঙ্গে তুলে, সব ব্যাপারে পাকিস্তানের কাঁধে দোষ চাপিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে  চাইছে। হিন্দুত্ববাদীদের পুরানো দোসর ও মার্কিন মুলুকের ওকালতি করা দালাল সাংবাদিক থেকে সাংসদ হওয়া স্বপন দাসগুপ্ত নির্লজ্জের মতন ব্রাক্ষণত্ববাদী সামরিক অভিযানের ও অত্যাচারের পক্ষে সংসদ ভবনে ভাষণ দিল, আর আশা করলো যে মোদী পাকিস্তান কে শাস্তি দিয়ে কাশ্মীরের সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করবে।  

ভারতের শাসকশ্রেণীর চরম প্রতিক্রিয়াশীল চেহারার প্রতিবিম্ব আরএসএস ও বিজেপি সহ অন্যান্য প্রকাশ্যে হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডা নাড়ানো শক্তিদের মধ্যে দেখা যায়। ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদের স্বরূপ এদের কার্যকলাপ দেখে চেনা যায়। কিন্তু যে সকল শক্তি ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল দালাল মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি ও জোতদার জমিদারদের ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদ ও সম্প্রসারণবাদের পক্ষে প্রগতিশীলতার  বা বামপন্থার মুখোশ পড়ে ওকালতি করে তাদের কার্যকলাপের পিছনে মূল উদ্দেশ্য কখনোই সহজে বোঝা যায় না।

যেদিন থেকে কাশ্মীরের লড়াই তুঙ্গে উঠেছে, জনতার মধ্যে স্বাধীনতার দাবি তীব্র হয়েছে ঠিক সেই সময়ের থেকেই সংঘ পরিবার ও মোদী সরকারের সমালোচক হিসেবে অনেক শক্তিই উঠে এসেছে, এরা সকলে টিভির পর্দায়, সংসদ ভবনের ভিতর, সোশ্যাল মিডিয়ায়, সংবাদপত্রের পাতায়, এবং নানা আলোচনা চক্রে কাশ্মীরের মানুষের পাথর ছোড়ার নিন্দা করছে, আর ভারতের আধা সামরিক বাহিনীর হিংসাত্মক আক্রমণের ঘটনাগুলিরও নরম নরম গলাবাজি করে বিরোধিতা করছে। আর তারা এই সমালোচনা ও নিন্দা করে দাবি জানাচ্ছে যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যেন পাকিস্তানের সাথে আলোচনায় বসে, কাশ্মীরি জনতার কথা এবং তাঁদের দাবি দাওয়া শোনে, যেন শান্তিপূর্ণ ভাবে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করে। এই সমস্ত ভাঁট যখন তারা বকছে ঠিক তখনই নব্য গান্ধীবাদ ও সুকিবাদের মণিপুরী মিশ্রণ ইরোম চানু শর্মিলা দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক বাহিনীর বিশেষ অধিকার আইন (আফস্পা) বাতিলের দাবিতে চলতে থাকা অনশন আন্দোলন পুলিশের সাথে এসে প্রত্যাহার করে নিল। সরকার ষোলো বছর তাকে গ্রেফতার করেছে ও তার অনশন ভঙ্গ করার চেষ্টা চালিয়েছে। ভারতের শাসকশ্রেণী আলোচনা বা সমালোচনা সহ্য করতে পারে না কারণ ব্রাক্ষণত্ববাদে সমালোচনা করা পাপ এবং নিম্ন জাতির নিঃশর্ত বিশ্বাসের পথে চলে সামগ্রিক ভাবে সমগ্র উচ্চ জাতির মানুষের পদলেহন করা কে শাস্ত্র সম্মত বলে গণ্য করা হয়। তাই ব্রাক্ষণত্ববাদী উচ্চ জাতির শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধিরা গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চিৎকার করেও কোনোদিনই মানুষের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক অধিকারকে মূল্য দেয়নি। অনশন আর গ্রেফতার ও অত্যাচারের সামনে ভেঙে পড়ে শেষ পর্যন্ত ইরোম শর্মিলা কে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে আর তার মধ্যে দিয়ে আবার প্রমাণিত হলো যে গান্ধীবাদের পথে চলার আমন্ত্রণ ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী সবসময়ে বিদ্রোহী জনতাকে দিলেও ওই পথে যাত্রা শুরু করার পরে কর্পোরেট সমর্থন (আন্না হাজারে মার্কা) না থাকলে কোনদিন শাসকশ্রেণী কোনো আন্দোলন কে পাত্তা দেয় না। কারণ ভীরুত্বের দর্শনে চলা সত্যাগ্রহ ও অনশন শেষ পর্যন্ত শাসকশ্রেণীর উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। ইরোম শর্মিলা এবার ভোটে দাঁড়িয়ে শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করতে চায় এবং এর মধ্যে দিয়ে আফস্পা বিরোধী আন্দোলনে তাঁর যেটুকু অবদান ছিল তাতেও জল ঢালা হয়ে গেল।

তাই যারা আজ কাশ্মীরি জনতার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওকালতি করছে তাদের আজ সকলকে জানানো উচিত যে শান্তিপূর্ণ নির্ভেজাল গান্ধীবাদ ও সুকিবাদের পথে চলে ইরোম শর্মিলা কি বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হলো? কাশ্মীরি গান্ধীদের যে আফস্পা কবলিত এবং সামগ্রিক ভাবে সংবাদ মাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকা অঞ্চলে কোনোদিনই ভারতের শাসকশ্রেণী পাত্তা দেবে না তা কি তারা জানে না? নাকি সব জেনেও ন্যাকা সাজছে টু পাইস কামানোর স্বার্থে?

ভারতের গণতন্ত্র তাদের পক্ষে, যারা কোটি কোটি টাকা খরচা করে ভোটে জেতে মদ, মাংস, হুল্লোড়, আর পেশী শক্তির দৌলতে। যে গরিব মানুষগুলো দিনের পর দিন দেশের নকশা থেকে কর্পোরেট আগ্রাসনের ফলে মুছে যাচ্ছে ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, তামিল নাদ, মহারাষ্ট্র, বা গুজরাটে, তাঁরা গান্ধীবাদের পথে চলে কোথায় অনশন বা সত্যাগ্রহ করে নিজেদের জীবন, জীবিকা, ঘর, সংসার ও পরিবেশ কে রক্ষা করতে পারবে সে কথা কোনো বিশেষজ্ঞ জানান দিতে পারে না। যে কাশ্মীরে নির্বাচন মানে ঘর থেকে বন্দুকের নলের মুখে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বুথের লাইনে দাঁড় করানো হয় প্রচারের হাওয়া টানতে, সেই রাজ্যে দিল্লির কাঠপুতুলদের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়ে যে কি পরিবর্তন আনা যায় তা ১৯৮৭ সালে কাশ্মীরি জনতা দেখেছেন। প্রতিটি বাড়িতে ১৩ থেকে ৭৫ বছর বয়সী মহিলাকে ফৌজিরা গণধর্ষণ করলে মানুষের মনের অবস্থা কি হয় তা কুনান পোশপড়ার জনতা জানেন।

আজ যদি কাশ্মীরের জনগণ প্রতিবাদ - প্রতিরোধের রাস্তা ছেড়ে দেন তাহলে ভারতের শাসকশ্রেণীরই উপকার হবে। যদি তাঁরা আমরণ অনশনে বসেন তাহলেও ভারতের শাসকশ্রেণীর বালাই ষাট, কারণ না খেয়ে লোকগুলো সব মরে গেলে ভারতের গুলির খরচা কমে যাবে আর সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের উপর যেহেতু কাশ্মীরে কঠিন নিষেধাজ্ঞা চাপানো আছে তাই এই মৃত্যুর খবরও কোনদিন কাশ্মীরের বাইরে যাবে না। যারা আজ কাশ্মীরি জনতাকে পাথর ছেড়ে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিচ্ছেন তারা সেদিন কোথায় ছিলেন যখন মিলিটারির বুটের নিচে কাশ্মীরের জনতার আত্মসম্মান লুন্ঠিত হচ্ছিল। কেন তারা ভারতের শাসকশ্রেণীকে বন্দুক আর আফ্স্পার মতন কালা আইন প্রত্যাহার করে, সমস্ত দোষী ও খুনি-অত্যাচারী সৈনিকদের শাস্তি দিয়ে, কাশ্মীরের জনতার অত্যাচার বন্ধ করে তাঁদের আলোচনায় ডাকার কথা বলার সাহস দেখাচ্ছে না? কাশ্মীরের মানুষের সাথে ভারতের শাসকশ্রেণীর কোনো আলোচনা কোনো কালে হয়নি আর কোনো কালে হতেও পারবে না কারণ ভারতের শাসন ক্ষমতায় যে দলই আসুক না কেন তারা মনেপ্রাণে ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকশ্রেণীর ভৃত্যের বেশি কিছু হবে না এবং সেই শাসকশ্রেণীর ঘোষিত গা-জোয়ারি করে কাশ্মীর কে দখলে রাখার নীতির বিরুদ্ধে হাঁটার সাহস কোনদিন দেখাতে পারবে না৷ অথবা আমরা বলতে পারি যে বর্তমান শাসন কাঠামোয় ভারতের মসনদে শুধু সেই সমস্ত রাজনৈতিক শক্তিই বসতে পারে যারা ভারতের শাসকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গী ও কার্যকলাপ কে অন্ধ সমর্থন করে। ফলে কাশ্মীর সমস্যার কোনো গণতান্ত্রিক ও পরিণত মানসিকতার পরিবেশে যে সমাধান হবে সে আশা করা হবে আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখা। শোষক আর শোষিতের মধ্যে আলোচনা হবে কি নিয়ে? ভারতের শাসকশ্রেণী আজ অবধি কোনোদিনই কোনো জাতি সত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করেনি।১৯৭৬ সালের জাতি সংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রস্তাবনায় ভারতের শাসক শ্রেণী সই করে। এই প্রস্তাবে বিশ্বের নিপীড়িত জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকৃত হয় এবং এই প্রস্তাবনায় সই করার আগেই মিজো-নাগা-খাসি জনজাতির অসংখ্য মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে লড়ার কারণে ভারত সরকার নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। কাশ্মীরের বহু আগেই নাগা ও মিজোদের গণহত্যা করে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দমনের কাজে হাত পাকিয়েছিল ভারতের শাসকশ্রেণী। নেহরু থেকে ইন্দিরা কারুর হাত রক্ত মুক্ত ছিল না। আসাম, মনিপুর, বা শ্রীলঙ্কায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দমন করতে ভারতের শাসকশ্রেণী কোন দিন পিছপা হয়নি আর অন্য কোথাও আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে ভারত সরকার সবসময়ে শর্ত রেখেছে আত্মসমর্পণের ও ভারতের শাসকশ্রেণীর নিঃশর্ত কর্তৃত্ব স্বীকার 
করে নেওয়ার।

কাশ্মীরের জনগণ ১৯৫৩ এর পরে কোনোদিনই ভারতের সাথে থাকতে চায়নি এবং কাশ্মীরের জনতার এই ইচ্ছাকে ভারতের শাসকশ্রেণী কোনোদিনই দাম দেয়নি। তাহলে আজ যে দাম দেবে সে কথা রাজনীতিতে অজ্ঞ মানুষও দাবি করবে না। কাশ্মীরের মানুষকে তাই বারবার আলোচনার টোপ দিয়ে বিভ্রান্ত করা, বারবার উন্নয়নে বিদ্রোহের সমাপ্তি হওয়ার তত্ত্ব আওড়ানো তথাকথিত সরকারের বিরোধী আর সমালোচকেরাও মুখে না বললেও ল্যাপটপ স্বাধীনতার চেয়ে বেশি ভালো এই লাইন তারাও প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট। কারণ এর মধ্যে দিয়েই বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির সেবা করা যাবে, আন্তর্জাতিক চীন বিরোধী যুদ্ধ চক্রের অংশ  ঘাঁটি অঞ্চল হিসেবে কাশ্মীরকে ব্যবহার করা যাবে। তবুও মাঝে মধ্যেই এদের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের মতন “কিক এন্ড কিসের” কৌশল ব্যবহার করতে হয় আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় কাশ্মীর নিয়ে হইচই থামাতে, দেশের জনতার নজর ঘোরাতে, আর কাশ্মীরের জনতার সংগ্রাম কে লাগাম লাগিয়ে থামাবার জন্যে।

আজ লড়াইয়ের ময়দানে পাথর হাতে লড়তে থাকা জনতা যে ল্যাপটপ আর মোবাইল নিয়ে চুপ করবেন না ইন্টারনেট আর মোবাইল নেটওয়ার্ক সংযোগ কাটা কাশ্মীরে তা মোদী আর ওর মোসাহেবদের বোঝাতে স্বাধীনতার দাবিতে, প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বার্থে, জাতির মুক্তির স্বার্থে লড়াই তীব্র করতে হবে। মৌলবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে প্রগতিশীলতার পথে এগিয়ে যেতে হবে। আর এই কাজে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসতে হবে কাশ্মীরের নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে। কাশ্মীরের লড়াইকে ভারতের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের, সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিপ্লবী সংগ্রামে যুক্ত শক্তিগুলোর সাথে ঐক্যবদ্ধ করা নিতান্ত প্রয়োজন। কারণ সামগ্রিক ভারতবর্ষ জুড়ে এক বিরাট ও সামগ্রিক গণতান্ত্রিক পরিবর্তন বাদে কাশ্মীরের জনগণের আশা ও আকাঙ্খা কে বাস্তবায়িত করতে পারা অসম্ভব। কাশ্মীরের জনতার সাথে ভারতের জনতার, বাস্তারের জনতার, তামিলনাদ, মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ডের সংগ্রামী গরিব শ্রমিক-কৃষক- জেলে- দলিত -আদিবাসীদের সংগ্রামী ঐক্য ভারত-পাকিস্তান-মার্কিন ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে কাশ্মীরে নতুন সূর্য ওঠার বন্দোবস্ত করবে আর সেই উদিত সূর্যের প্রখর উজ্জ্বলতায় মুছে যাবে ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদের অন্ধকার। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে