ভাঙন নয় জনতার ঐক্যেই আসামে NRC ও হিন্দুত্ববাদ কে উচ্ছেদ করতে পারে

শনিবার, আগস্ট ০৪, ২০১৮ 0 Comments A+ a-

Assam NRC List a conspiracy by the Hindutva camp


আসাম সরকারের জাতীয় নাগরিক রেজিস্টারের (NRC )চূড়ান্ত খসড়া তালিকায় নাম বাদ গেল ৪০ লক্ষ মানুষের, যাঁরা এই মুহূর্তে এক চরম অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়ে অপেক্ষা করছেন।
এই ৪০ লক্ষ মানুষের, যাঁদের শ্রেণী-জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ পরিচয় ও অনুপাত এখনো জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি, তাঁদের সামনে আছে এক মহা বিপদ, রুজি-রুটি ভিটে ও অনেকেরই ক্ষেত্রে পরিবারের থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বিপদ, সারা জীবন বিনা বিচারে কয়েদ থাকার বিপদ। তাঁদের হয় আবার
নিজেদের বাসস্থানের নিকট NRC কেন্দ্রে গিয়ে পুনরায় নিজেদের নথিপত্র জমা করে প্রমাণ করতে হবে
যে হয় তাঁরা অথবা তাঁদের পূর্বপুরুষেরা ২৪শে মার্চ ১৯৭১ থেকে আসামে বাস করছেন, অথবা নিজ
ভূমিতে বিদেশী তকমা নিয়ে বন্দি হতে হবে ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে।



চতুর্দিকে এই আসামের NRC গঠন ও তার সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা তর্ক বিতর্ক চলছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট করছে এবং লড়াইটা এখন মিডিয়ার দৌলতে শুধু তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে বিজেপির লড়াইতে পরিণত হয়েছে কারণ ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতি গ্রহণ করে সব রাজনৈতিক দলই, বিশেষ করে বিজেপির বিরোধীরা নিজেদের মতামত মিনমিন করে ব্যাখ্যা করে হাত তুলে দিয়েছে। তবে ভোট ব্যাঙ্কের স্বার্থে মমতা বন্দোপাধ্যায় ও বিজেপির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব কিন্তু একে অপরের সাথে বাকযুদ্ধে সামিল হয়েছে। নীতিগত ভাবে “অনুপ্রবেশ” ঠিক কি বেঠিক সেই নিয়েও ভারতের চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় অধিকারী ধনিক শ্রেণী ও সাবর্ণ শহুরে মধ্যবিত্ত কিন্তু ভীষণ তর্ক করে চলেছে, বিশেষ করে “বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের” তাড়ানোর জন্যে। যে ভারতের মানুষেরা ইউরোপ ও মার্কিন দেশে দলে দলে বেআইনি ভাবে অনুপ্রবেশ করে বাস করে নাগরিকত্ব গ্রহণ করে নিজেদের Non Residential Indian  বলে সমাজে পরিচয় দিয়ে ছেলের বিয়েতে মোটা অঙ্কের যৌতুক দাবি করে, তারাই আবার প্রতিবেশী বাংলাদেশের মানুষদের ভারতে দেখতে পেলে গুলি করে মারার পক্ষে ওকালতি করে।

এই ৪০ লক্ষ ভিটেচ্যুত হতে চলা মানুষের অধিকাংশই যে শ্রেণীগত ভাবে গরিব সে কথা আলাদা করে জানান দেওয়ার দরকার নেই কারণ ভারতবর্ষে পকেটে টাকা থাকলে পরিচয়পত্র ও বসবাসের প্রমাণ নিজে চলে আপনার হাতের মুঠোয় আসবে। বলা হচ্ছে যে NRC গঠন হয়েছে “বেআইনি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী” মানুষদের আসাম থেকে দূর করার জন্যে ১৯৮৫ সালের Assam Accord  অনুসারে। এই Assam Accord আসলে অহমীয় উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলির সাথে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রতিক্রিয়াশীল জনবিরোধী চুক্তি যার মূল ভিত্তি ছিল তীব্র বাঙালি বিদ্বেষ, যে বাঙালি বিদ্বেষ কে তুমুল ভাবে আসামে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে ছড়ানো হয়েছিল শাসকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্যে। এই Assam Accord বা আসাম চুক্তি সই হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত ছিল কিন্তু আসামের রক্তাক্ত বাঙালি বিরোধী সন্ত্রাস অভিযান।

আসামের রক্তাক্ত বাঙালি-বিদ্বেষী রাজনীতি ও তার প্রভাব

দেশ ভাগের পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর, বিশেষ করে হিন্দু বাঙালিদের উপর, পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর অত্যাচার যখন তীব্র হয়ে ওঠে, তখন পূর্ব বাংলার থেকে প্রাণ হাতে অনেক মানুষ পালিয়ে এসে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে আশ্রয় নেন। তার আগে অবশ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন কাল থেকেই বাঙালি কৃষকদের সিলেট জেলা থেকে  নিম্ন আসামের গোয়ালপাড়া, করিমগঞ্জ, কোকরাঝাড় সহ বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো চাষাবাদ করিয়ে সরকার বাহাদুরের খাজনা বাড়ানোর জন্যে। রেল লাইন পত্তন ও রেল কোম্পানির কাজের জন্যে বর্তমান বিহার থেকে অনেক শূদ্র হিন্দুদের ও দলিতদের নিয়ে আসে ব্রিটিশ শাসকেরা, ঠিক তেমনিই আবার চা বাগান গড়ে তোলার জন্যে ও চা শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্যে দলে দলে আদিবাসীদের বর্তমান ভারতের ছত্তিসগড়, ঝাড়খন্ড ও বিহার থেকে নিয়ে আসা হয় আসামে। উত্তর বঙ্গের কোচবিহার সেই সময়ে রাজবংশী কোচদের রাজ্য ছিল এবং দেশভাগের পরে যখন কোচ রাজত্ব ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় তখন অনেক অঞ্চল আসামে আসে আর কিছুটা অংশ পশ্চিমবঙ্গে। পেটের টানে অনেক নেপালি গরিব মানুষ উত্তরবঙ্গ হয়ে আসামে ঢোকেন এবং সেখানে থিতু হন, অনেকে বলেন যে দার্জিলিং জেলার চেয়ে বেশি গোর্খা জনগণ কিন্তু আসামে বাস করেন। এই নানা জাতির নানা ভাষার মানুষের সাথে সমগ্র উত্তর পূর্বের থেকে দলে দলে বিভিন্ন জনজাতির মানুষও এসে আসামে নিজেদের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন, তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন রুজি রোজগারের কোন না কোন উপায়। এই সমস্ত মানুষের আগমনের ফলেই আসাম হয়ে উঠেছিল বিবিধ ও প্রাণবন্ত এক প্রদেশ।  

তবে শ্রেণী বিভক্ত সমাজে, যে সমাজে অধিকাংশ মানুষের শ্রমের থেকে মুনাফা নিংড়ে নিয়ে নিজেদের চর্বি বাড়িয়ে চলে একটি সংখ্যালঘু শ্রেণী, আদর্শ স্থান বা সহনশীলতা ও শান্তির স্থান বলে কিছুই হয় না। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পরে যখন ভারতের মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা দেশ শাসনের অধিকার পায় ব্রিটিশ শাসকদের থেকে, তখন থেকে আসামের জনমানসে, বিশেষ করে সংখ্যাগুরু অহমীয়া মানুষের মনে বাঙালি-বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ রোপন করা শুরু করে ভারতের শাসক শ্রেণী, যারা জাতিগত ভাবে উত্তর অথবা পশ্চিম ভারতীয় হিন্দি, মারওয়াড়ি বা গুজরাটি ভাষী মুৎসুদ্দি বেনিয়া। ব্রিটিশ শাসনকাল থেকেই যেহেতু আসামে সরকারি হাকিম-আমলা থেকে চা বাগানের ম্যানেজার বা জঙ্গলের রেঞ্জার, সমস্ত উচ্চ পদেই সাবর্ণ ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের বাঙালিদের আধিপত্য ছিল এবং অত্যাচারী শাসক শ্রেণীর সাথে তাঁদের সম্পর্ক বেশ নিবিড় ছিল, তার ফলে সাধারণ অহমীয়া জনগণ ও আদিবাসী মানুষেরা এই সম্প্রদায়ের প্রতি মনে একটা বিদ্বেষ পুষে রেখেছিল। সেই বিদ্বেষ কে কাজে লাগিয়েই আসামের মাটিতে উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় শাসক শ্রেণী নিজের আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করে।

উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় মুৎসুদ্দি বেনিয়ারা ও আমলারা যখন তথাকথিত স্বাধীন ভারত সরকারের বন্দুকের জোরে বলীয়ান হয়ে আসামের সম্পদের উপর নিজেদের মালিকানা কায়েম করা শুরু করলো এবং আসামের উপর আধা ঔপনিবেশিক শাসন কে শক্তিশালী করার জন্যে যখন তাঁদের নিজেদের প্রদেশের লোকেদের আমলা-হাকিম বানিয়ে আসাম সহ সমস্ত উত্তর পূর্বাঞ্চলের উপর চাপানো দরকারি হয়ে উঠলো, ঠিক তখন নিজেদের শোষণ ও অত্যাচারের থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে তাঁরা জাতি বিদ্বেষের বিষ বৃক্ষের বীজ রোপন করা শুরু করে। এই জাতি ঘৃণার জন্যে বাঙালিদের মূলত বেছে নেওয়া হয় কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে, কয়েকজন সাবর্ণ উচ্চবিত্তের কারণে, বহুদিন ধরেই আসামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। এর সাথেই মনে রাখতে হবে যে আসামের বিস্তীর্ণ প্রান্ত জুড়ে রেল শ্রমিক, চা বাগান শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন গড়ে তোলা শুরু হয় এবং বামপন্থী রাজনীতির প্রভাবটা চীন বিপ্লবে কমিউনিস্টদের আসন্ন বিজয়ের সাথে সাথেই তীব্র হয়ে উঠতে থাকে। এই কমিউনিস্ট প্রভাব রুখতে এবং জাতি দাঙ্গার মাধ্যমে শ্রেণী সংগ্রামের আগুনে জল ঢালতে শাসক শ্রেণী বাঙালি বিদ্বেষী দাঙ্গার প্রথম আগুন জ্বালায় ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষদের কে লক্ষ করে।

১৯৪৮ এর দাঙ্গার পরে ১৯৫০ সালে আবার সমগ্র আসাম জুড়ে বাঙালি বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়, তারপর ১৯৫৫ সালে ফের দাঙ্গার আগুন লাগে। ১৯৬০ সালে শুরু হয় সবচেয়ে কুখ্যাত “বঙ্গাল খেদা” অভিযান। গোয়ালপাড়া থেকে শুরু করে সমস্ত আসামে হাজার হাজার বাঙালির উপর সংগঠিত আক্রমণ শুরু করে কংগ্রেসের মদতপুষ্ট শাসকশ্রেণীর গুন্ডা অহমীয় উগ্রপন্থীরা। অনেক আদিবাসী মানুষকেও এই জাতি দাঙ্গার অভিযানে প্ররোচনা দিয়ে এবং লোভ দেখিয়ে অংশগ্রহণ করানো হয়। সেই সময়ে ৫০,০০০ বাঙালি হিন্দু ও মুসলিমদের পালিয়ে এসে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিতে হয়। বাড়িঘর, দোকানপাট সব কিছুই কংগ্রেস সরকারের বদান্যতায় উগ্রপন্থী গুন্ডারা দখল করে এবং আসামের সমাজে নিজেদের প্রতিপত্তি গড়ে তোলে। দক্ষিণ আসামের মাটিতে কমিউনিস্ট আন্দোলন কে নিষ্পেষিত করে অঙ্কুরে বিনাশ করার কাজে অনেক এগিয়ে যায়।  কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য কাউন্সিল অহমীয়া জাতির ভাষার অধিকারের প্রতি সমর্থন জানালেও বাঙালিদের উপর জাতিগত আক্রমণের তীব্র বিরোধিতা করে। শাসক শ্রেণীর পূর্ণ সমর্থন প্রাপ্ত এই বঙ্গাল খেদা আন্দোলনের লুম্পেনরা শত শত মানুষ কে খুন করে, নারীদের ধর্ষণ করে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। শহরে শহরে এর বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং অনেক জায়গায় জনগণ ধর্মঘট পালনও করেন।

অল্প কিছু অহমীয় ও আদিবাসী গুন্ডাদের দ্বারা পরিচালিত উগ্রপন্থী বঙ্গাল খেদা অভিযানটিকে গণ প্রতিরোধ হিসেবে চিহ্নিত করতে এবং এই জঘন্য জাতি সন্ত্রাসের পক্ষে বিপুল জন সমর্থন গড়ে তুলতে বারবার করে ভারতের শাসক শ্রেণী অহমীয় ও আদিবাসী মানুষদের “বাঙালি বহিরাগতদের” দ্বারা সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে আক্রান্ত হিসেবে তুলে ধরে নিজেদের পেটোয়া বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা এবং এই ভাবে জনমানসে একটি জাতির প্রতি তীব্র বিদ্বেষ সৃষ্টি করার বৌদ্ধিক প্রকল্প চালানো হয়। এক সময়কার তাবড় তাবড় তথাকথিত বামপন্থী বুদ্ধিজীবি মানুষ আসামের জনগণের নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির স্বার্থে পরিচালিত প্রগতিশীল লড়াই কে সমর্থন করতে করতে হঠাৎ করে প্রতিক্রিয়াশীল বাঙালি-বিরোধী হিংস্র কার্যকলাপের সমর্থক হয়ে উঠলেন। তাঁরা একটি জাতির নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে সংগ্রাম করা ও অন্য জাতির প্রতি বিদ্বেষ নিয়ে দাঙ্গা করার মধ্যে মোটা দাগের পার্থক্য দেখেও দেখলেন না এবং একটি জাতির আধিপত্যবাদী মানসিকতার থেকে তাঁরাও ক্রমাগত বাঙালি-বিদ্বেষী আন্দোলন কে সমর্থন করে থেকেছেন ও আজও এই পরম্পরা বর্তমান।   

১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি’র থেকে যে কৃষক বিদ্রোহের আগুন দেশের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ে তার উত্তাপ আসামেও পৌঁছায় এবং তখন কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার ও ভারতের শাসক শ্রেণী প্রমাদ গোনে, কারণ আসামের মাটিতে সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রাম কে ঠেকিয়ে রাখতে তাঁরা যে জাল বিছিয়েছিল তা কিন্তু কৃষক ও শ্রমিকদের বিপ্লবী সংগ্রামে ছিন্ন হয়ে যেত। এহেন পরিস্থিতিতে ১৯৭০ এর দশকে বারবার বাঙালি-বিরোধী হিংসায় ইন্ধন যোগান দেওয়া হয়। কমিউনিস্ট আন্দোলনকে দমন করতে পুলিশি সন্ত্রাস সৃষ্টি করলেও আসামের সরকার কিন্তু জেনেশুনে বাঙালি-বিরোধী উগ্রপন্থী কার্যকলাপ কে বন্ধ করতে কোন উদ্যোগ নেয়নি।

যখন ১৯৭১ এ পূর্ব বাংলার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে তখন দেশ ছেড়ে দলে দলে বাঙালি হিন্দু ও মুসলিমরা পালিয়ে এসে নিম্ন আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আশ্রয় নিতে শুরু করে। ছিন্নমূল, অভুক্ত, হতদরিদ্র হয়ে ভারতের আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় আশ্রয় চাইতে আসা এই মানুষদের নিমেষে জাতীয় শত্রুর তকমা দেয় উগ্র অহমীয় জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই তাঁরা বারবার দাবি করতে থাকে যে এই ছিন্নমূল মানুষেরা আসলে “বিদেশী” এবং আসামের মাটিতে তাঁদের কোন ঠাঁই নেই। নানা জায়গায় এই বিদেশী-বিরোধী আন্দোলন এক নতুন কায়দায় দানা বাঁধা শুরু করে ১৯৮০ এর দশক থেকে। বঙ্গাল খেদা শুধু আর অহমীয় উগ্র জাতীয়তাবাদী আগ্রাসন হিসেবে আটকে না থেকে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশী ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে, যেখানে আদিবাসী ও বিভিন্ন জনজাতির মানুষ কে মিথ্যা প্ররোচনা দিয়ে বাঙালি উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় ভারতের শাসক শ্রেণী। সমগ্র ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে দাঙ্গার আগুন জ্বলে ওঠে।

অহমীয় উগ্রজাতীয়তাবাদ কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সমস্ত বাঙালিদের নিজেদের শত্রু মনে করে এবং তাঁদের বলপ্রয়োগ করে আসাম থেকে দূর করার পক্ষে ওকালতি করে। ভারতের শাসক শ্রেণীর বদন্যতায় যে অহমীয় উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, ১৯৮০ সালের থেকে তাঁর সাথে গাঁটছড়া বেঁধে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট আরএসএস সমস্ত আসামে নিজেদের সংগঠন গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। এই আরএসএস এর আগমনের সাথে সাথে কিন্তু ধীরে ধীরে বঙ্গাল খেদা থেকে উগ্রপন্থীদের  অভিযানের লক্ষ্য হয়ে ওঠে বাঙালি মুসলিম তাড়ানো। যেহেতু বাঙালি মুসলিমরা জনসংখ্যার সংখ্যালঘু অংশ, যেহেতু বাঙালি হিন্দুরাও বাঙালি মুসলিমদের ধর্মীয় কারণে ঘৃণা করে এবং যেহেতু তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাঁদের কে সহজেই বাংলাদেশী বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, তাই তাঁদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা ও ধর্মীয় জিগির তুলে আক্রমণ চালানো অনেক সোজা হয়ে ওঠে হিন্দি-হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীদের পক্ষে। এই নতুন ধারার সাম্প্রদায়িকতা মেশানো উগ্র অহমীয় জাতীয়তাবাদের ছোবল সমস্ত আসামের আবহাওয়া কে দীর্ঘ চার দশক ধরে বিষাক্ত করে এসেছে।

অটল বিহারী বাজপেয়ী কে বিজেপির মধ্যেকার  “উদারনৈতিক গণতন্ত্রী” হিসেবে সর্বদা শাসক শ্রেণী তুলে ধরতো। সেই অটল বিহারী ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আসামে গিয়ে “বিদেশী বাঙালি” তাড়ানোর জন্যে এবং অহমীয়  ও আদিবাসীদের ক্ষেপিয়ে তোলার জন্যে এক প্ররোচনামূলক ভাষণ দেয়। এই ভাষণে বাজপেয়ী বলে যে যদি আসামের জায়গায় পাঞ্জাবে এত “বিদেশী অনুপ্রবেশকারীরা” থাকতো তাহলে তাঁদের “কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হতো”। এই ভাষণের ঠিক পরেই ১৮ই ফেব্রুয়ারি, আরএসএস ও কংগ্রেসের যোগসাজেশে  সংগঠিত হয় কুখ্যাত নেলি গণহত্যাকান্ড, যাতে পুরুষ-মহিলা-বৃদ্ধ-শিশু নির্বিশেষে ৩,০০০ মানুষ কে তীর ও গুলি মেরে আহত করে তারপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকারের নাকের তলায় সংগঠিত এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের জন্যে যেমন আরএসএস ও তার দালাল হিন্দুত্ববাদী অহমীয় উগ্রপন্থীরা দায়ী ঠিক তেমনই দায়ী কংগ্রেস।

নগাওঁ এর নেলিতে সংগঠিত গণহত্যার পরেই আসামের উগ্র জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিয়ে বাঙালি বিরোধী হিংসাত্মক অভিযান শুরু করে। বাঙালি হিন্দু ও মুসলিমদের উপর তীব্র আক্রমণ শুরু করে অহমীয় জঙ্গী সংগঠনগুলি। কংগ্রেস ও আরএসএস এর মদতপুষ্ট এই সংগঠনগুলি দিল্লির সাথে সম্পর্ক খারাপ না করেও শুধু বাঙালি, কোচ-রাজবংশী ও গরিব হিন্দি-ভাষী ও নেপালি-ভাষী শ্রমিক, ভূমিহীন কৃষক এবং ব্যাপক অ-অহমীয় জাতির খেটে খাওয়া মানুষের উপর আক্রমণ শুরু করে। বামপন্থী শক্তিগুলি কে দুর্বল করে, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের উপর জাতি-বিদ্বেষী আক্রমণ করে এই সংগঠনগুলি মূলত অহমীয় মানুষের মধ্যে, অহমীয় গরিব মানুষের মধ্যে ব্যাপক হারে জাতি-বিদ্বেষের গরল ঢালা শুরু করে।  

তৎকালীন রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার, যে কংগ্রেসের এক যুব নেত্রী ছিলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়, সেই সরকার আসাম আন্দোলন নামে কুখ্যাত হওয়া এই গুটিকয়েক লুম্পেন জাতিবিদ্বেষী ফ্যাসিস্টদের সাথে বৈঠক করে আসাম চুক্তি সম্পাদন করে। এই আসাম চুক্তির ভিত্তি হলো আরএসএস এর মদতপুষ্ট নেলি হত্যাকান্ড এবং এই রকম আরও অনেক হত্যাকাণ্ডের হুমকি। সরকার দু হাত তুলে এই খুনি অহমীয় উগ্রপন্থীদের সমর্থন করে ও বাহবা দেয় এবং বাঙালিদের উপহার দেয় NRC  নামক মানবতাবিরোধী একটি চরম ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা।

ট্রাইবুনাল, NRC ও নাগরিক বাছবিচারের প্রহসন

এ যাবৎকাল অবধি NRC তৈরির জন্যে ২৪শে মার্চ ১৯৭১ কে ভিত্তি মেনে এগানো হয়েছে। যদি কোন ব্যক্তি ২৪শে মার্চ ১৯৭১ এর আগে এসে আসামে বসবাস করা শুরু করে থাকেন তাহলে তিনি ভারতের নাগরিক গণ্য হবেন আর তা না হলে হয় তাঁরা Doubtful Voter (সন্দেহজনক ভোটার) বা D-Voter হিসেবে চিহ্নিত হবেন এবং তাঁর ফলে তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে, আর না হয় তাঁরা বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ডিটেনশন সেন্টারে বা সরকারি জেলে স্থান পাবেন। কেউ কেউ যদি পুরো পরিবার সহ জেলে যান তাহলে তাঁদের সকল সদস্য কে আজীবন আলাদা করে রাখা হবে এবং তাঁদের শিশুদের আলাদা করে রাখা হবে। হর্ষ মন্দার নামক এক মানবাধিকার কর্মী সচক্ষে আসামের জেলের ঘৃণ্য ব্যবস্থা দেখে এসেছেন এবং তার বিবরণ লিখেছেন। ইংরাজীতে লেখা এই বিবরণটি পড়লে আপনারা জানবেন যে কি অমানবিক ভাবে ভারত রাষ্ট্র ও তার অহমীয় উচ্চ জাতির দালালেরা গরিব বাঙালিদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে আসামে।      

এই NRC খসড়া তৈরির আগে থেকেই সমগ্র আসাম জুড়ে অবৈধ অভিবাসী (ট্রাইব্যুনালের দ্বারা নির্ধারিত) আইন ১৯৮৩ দ্বারা গঠিত “অবৈধ অভিবাসীদের (অভিমত) ট্রাইব্যুনাল” দ্বারা কে আসামের তথা ভারতের বাসিন্দা আর কে নয় তা নিয়ে মোকাদ্দমা চলে আসছে। যে কোন ব্যক্তি অন্য কারুর বিরুদ্ধে এই ট্রাইবুনালে বা পুলিশে বেআইনী বসবাসকারী’র অভিযোগ দায়ের করতে পারে এবং সরকার সেই অভিযোগের গোপন তদন্ত করে (অভিযুক্ত কে না জানিয়ে) ট্রাইবুনালে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিত। যদি তদন্তে পাওয়া যেত যে ব্যক্তিটি বিদেশী তাহলে ট্রাইবুনালের থেকে তাঁর নামে সমন পাঠানো হয় এবং তাঁকে এসে নিজের বা নিজের পূর্বপুরুষদের ২৪শে মার্চ ১৯৭১ এর আগের থেকে আসামে থাকার নথি সহ প্রমাণ দিতে হয়। যদিও এই আইনে অভিযুক্ত নিজেই নিজের ওকালতি করতে পারেন, তবুও যাঁদের নামে নালিশ হয় তাঁদের বেশিরভাগ যেহেতু গরিব মানুষ এবং বিশেষ লেখাপড়া জানেন না তাই তাঁরা উকিল করতে বাধ্য হন এবং উকিলের ফিজ সহ নিজের পূর্বপুরুষের সমস্ত নথিপত্র জোগাড় করার জন্যে প্রচুর টাকা খরচ করতে বাধ্য হন। অনেকে এই খরচের কারণে পথে বসেন, অনেকে আবার আত্মহত্যাও করেন।

বিগত ২৫ বছরে ৪৫৮,০০০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে নাগরিকত্বের প্রশ্নে এবং তার মধ্যে আজও ১৮০,০০০ মামলা ঝুলে আছে বিভিন্ন ট্রাইবুনালে। এই মামলাগুলিতে প্রথমে রাষ্ট্র কে প্রমাণ করতে হতো যে যাঁর বিরুদ্ধে নালিশ করা হয়েছে তিনি বিদেশী। যেহেতু প্রমাণ করার দায় রাষ্ট্র যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল ছিল তাই হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের দোসর আসামের জনবিরোধী উগ্রজাতীয়তাবাদী লুম্পেনরা এই ট্রাইবুনালের পদ্ধতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং সর্বানন্দ সোনোয়ালের নেতৃত্বে আরএসএস সুপ্রিম কোর্টে NRC তৈরির কাজ কে ত্বরান্বিত করার আর্জি পেশ করে। সেই আর্জির উপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা সৃষ্ট সুপ্রিম কোর্ট যে আদেশ দেয় তার সারমর্ম হলো যে আসামে বাস করা যে কোন মানুষের বিরুদ্ধে যদি নালিশ করা হয় যে সে বিদেশী, তাহলে সেই ব্যক্তি কে এবার প্রমাণ করতে হবে যে তাঁর বিরুদ্ধে করা অভিযোগ মিথ্যা এবং তার পক্ষে তাঁকে ১৯৭১ এর পূর্বের নথিপত্র জমা দিতে হবে। তিনি যদি ট্রাইবুনালে নথি জমা দিতে অপারগ হন তাহলে তাঁকে বিদেশী অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে সহজেই বন্দি শালায় আটকে রাখা যাবে আবার তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করা হবে এবং তাঁদের কে সকলকে  ১৯৭১ এর পূর্বের থেকে আসামের সাথে যোগসূত্র প্রমাণ করতে হবে। এই ট্রাইবুনাল ব্যবস্থা যে কি রকম দুর্নীতি-পরায়ণ এবং চরম ভাবে গরিব-বিরোধী তা জানতে আপনি Raiot ম্যাগাজিনে ইংরাজীতে প্রকাশিত এই প্রবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন।

আসামে হিন্দুত্ববাদের বিষাক্ত ছোবল

এই NRC নিয়ে সমগ্র আসাম জুড়ে যে ঘৃণ্য উগ্রজাতীয়তাবাদের জোয়ার তোলা হয়েছিল তার লক্ষ্য বস্তু সকল বাঙালি হলেও বিজেপি নিজ ভোট ব্যাঙ্কের দিকে নজর দিয়ে বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ও বাঙালি মুসলিমদের শুধু বিতাড়ন করার লাইন নিয়ে আসে। প্রথমে তরুণ গগৈ এর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের আমলে বিজেপি মুসলিম অনুপ্রবেশকারী তোষণের অভিযোগ তোলে ও নানা স্থানে ২০১২ সাল থেকে মুসলিম বিরোধী গণহত্যা সংগঠিত করায় আরএসএস’র সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্যে। সমগ্র দক্ষিণ আসামের বাঙালি অঞ্চলগুলিতে বসবাস করা মুসলিমদের বিরুদ্ধে নামিয়ে আনা হয় ঘৃণ্য আক্রমণ। ২০১৪ সালের মে মাসে, যখন নরেন্দ্র মোদী নানা ধরণের মিথ্যার বেসাতির সাহায্যে নির্বাচন জিততে ব্যস্ত, ঠিক তখনই পয়লা মে থেকে ৩রা মে অবধি প্রায় ৩২ জন বাঙালি মুসলিম কে হত্যা করে নরেন্দ্র মোদীর দালাল, হিন্দুত্ববাদী বোড়ো জঙ্গীরা। সেই বছরের ডিসেম্বরে, ঠিক বড়দিনের প্রাকাল্লে, নরেন্দ্র মোদীর সরকারের মদতেই বিজেপির জোট সঙ্গী বোড়ো উগ্রপন্থীদের আক্রমণে নিহত হন সাধারণ আদিবাসী খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ। যদিও সরকার শুধুই বোড়ো জঙ্গীদের দোষ দেয়, তবুও এই হামলাগুলোয় ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্রের ও হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসের যোগসাজশ খুবই স্পষ্ট ভাবে সামনে আসে।

উগ্রজাতীয়তাবাদীদের মুসলিম বিদ্বেষী প্রচার দিয়ে প্রলুব্ধ করে আরএসএস বোঝাতে থাকে যে বাঙালি মুসলিমদের সংখ্যা নাকি আসামে এত বেড়ে গেছে যে সেখানকার ভূমিপুত্র হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে এবং তাই সেই অহমীয় মানুষদের হিন্দু বাঙালি ও অবাঙালিদের সাথে মিলে আসাম থেকে বাঙালি মুসলিমদের তাড়াতে হবে। এই প্রচার ও মুসলিমদের নিয়ে অহেতুক আতঙ্ক ছড়িয়ে গোটা আসামের জনগণ কে পুনরায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ে ভাগ করে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসামে সরকার গড়ে বিজেপি এবং সাথে সাথেই আসামের তথাকথিত জাতীয়তাবাদীদের মুখে কুলুপ মেরে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের রাজনীতির উপর ভিত্তি করে আসামের ইতিহাসের গৈরিকীকরণ শুরু করে আরএসএস। আসাম থেকে মেয়েদের পাচার করে গুজরাট ও পাঞ্জাবে নিয়ে গিয়ে হিন্দুত্ববাদী জঙ্গী বানাবার কর্মকান্ডও শুরু হয় আরএসএস এর নেতৃত্বে। NRC এর নামে এক নোংরা খেলা চলতে থাকে সমগ্র রাজ্যের বাঙালিদের সাথে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলিম ও নমঃশুদ্র (দলিত) বাঙালিদের সাথে। এর সাথে সাথেই কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর সরকার খুব সুকৌশলে নাগরিক আইনে পরিবর্তন করার খসড়া তৈরি করে সংসদে উপস্থাপন করেছে , যা বলবৎ হলে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে যদি কোন হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসী বা খ্রীস্টান ভারতে আসেন তাহলে তাঁদের নাগরিকতা দেওয়া হবে আর যেহেতু এই তালিকায় মুসলিম ধর্মের নাম লেখা নেই তাই এটা অনিবার্য যে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে গিয়ে আরএসএস ও বিজেপি’র দ্বারা পরিচালিত হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র মুসলিমদের নাগরিকতা তো দেবেই না বরং যাঁদের নাগরিকতা আছে তাঁদের সেই অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হবে।  

বিজেপির ঘৃণ্য রাজনীতির বিরুদ্ধে, হিন্দু-মুসলিম বিভাজন করার নীতির বিরুদ্ধে এবং নাগরিক আইনে রদবদল আনার বিরুদ্ধে আসামে গণ বিক্ষোভ তো প্রচুর হলো, বহু মানুষ সমস্বরে বিজেপির দ্বারা “বিদেশী অনুপ্রবেশকারীদের” হিন্দু-মুসলিম দ্বৈতে ভাগ করার বিরোধিতা করলেন, অনেক আন্দোলন হলো আর অনেক মিছিলও হলো, নব্য বামপন্থীদের অতিপ্রিয় অখিল গগৈ জেল থেকেও বিবৃতিও পাঠালেন বিজেপি কে তুলোধুনো করে; তবে এই সব বিরোধ, সব আন্দোলন, সব বিক্ষোভের পিছনে বিজেপি বিরোধিতা বা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতার চেয়েও বেশি ছিল বাঙালি-বিদ্বেষ; বাঙালি গরিব মানুষ যেন আসামে করে কম্মে খেতে না পারে তার জন্যে জেদ। যখন নব্য বাম থেকে সকল রঙের রাজনীতির ধামাধারীরা আসামে ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে এই উগ্র জাতীয়তাবাদ কে সমর্থন করে চলেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ কে জোর করে তাঁদের ভিটে মাটির থেকে উচ্ছেদ করতে চাইছে, তখন ভোটের বাজারে এটা আশা করা মূর্খতা হবে যে তাদের মধ্যে কেউ আসামে বাঙালিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে উগ্র অহমীয় জাতীয়তাবাদ ও আরএসএস এর ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে।

আসামে NRC পরবর্তী কালে কমিউনিস্টদের কর্তব্য কি হওয়া উচিত?

অনেক কমিউনিস্ট বিপ্লবী আসামের NRC নিয়ে সঠিক অবস্থান কি হবে, অহমীয় মানুষের সাথে বাঙালিদের দ্বন্ধে কমিউনিস্টদের অবস্থান কি হওয়া উচিত তাই নিয়ে চিন্তিত। অনেকে নিজ নিজ জাতীয় ও ভাষাগত অবস্থান থেকে সমস্যাটিকে দেখছেন আবার অনেকে এই সমস্যাটিকে একটি বিচ্ছিন্ন সমস্যা হিসেবে দেখছেন। আসাম ও আসামের মাটিতে অহমীয়-আদিবাসী জোটের সাথে বাঙালিদের দ্বন্ধ আসলে ভারতের শাসক শ্রেণীর নিজ লুঠ ও শোষণের স্বার্থে কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট দ্বন্ধ। এই দ্বন্ধের মূল হচ্ছে যে আসামে রোজগার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ ভীষণ কম এবং তার মধ্যে ভারতের শাসকশ্রেণী হিন্দি ও গুজরাটি-ভাষী কর্মচারীদের রাজ্যের উচ্চ পদে বসিয়ে রাজ্যের রাশ নিজের হাতে টেনে রাখতে চায় আর হিন্দি-হিন্দুত্বের স্বার্থে গরিব মানুষের মধ্যে কলহ চিরস্থায়ী করে রাখতে চায়। ইউরোপের মাটিতে উৎপত্তি হওয়া নেশন স্টেট বা জাতি রাষ্ট্রের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ কে ভারতের মাটিতেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠনের তত্ত্বের মাধ্যমে। যতদিন এই কলহ নিয়ে অহমীয় ও বাঙালিদের ব্যস্ত করে রাখা যাবে ঠিক ততদিনই কিন্তু দেশের সম্পদ কি করে নরেন্দ্র মোদী বৃহৎ কর্পোরেটদের বিক্রি করে জনগণ কে দুর্দশার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন তার থেকে মানুষের মুখ ফিরিয়ে রাখা যাবে।

কমিউনিস্টদের অবশ্যই আন্তর্জাতিকতাবাদী হতে হবে এবং সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের চেতনা থেকে মুক্ত হতে হবে। তাঁদের সকল ক্ষেত্রেই শোষিত-বঞ্চিত-অত্যাচারিত গরিব মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে হবে শাসক শ্রেণীর সৃষ্ট সকল ধরনের বৈরিতার ও কৃত্রিম বিভেদের দেওয়াল ভাঙতে হবে। কমিউনিস্টদের সর্ব ক্ষেত্রেই আশু কর্তব্য হলো শ্রেণী সংগ্রাম গড়ে তোলা ক্ষমতা দখলের জন্যে এবং এর জন্যে সকল জাতির গরিব মানুষকেই তাঁদের দরকার। আসামে বস্তুগত ভাবে দেখতে গেলে সকল গরিব মানুষের মধ্যে বাঙালি গরিব, এবং বাঙালি গরিবের মধ্যে বাঙালি মুসলিম গরিব সবচেয়ে শোষিত এবং তাঁরা প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে জীবনযাপন করেন। ফলে এই গরিব মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে অহমীয়, বোড়ো ও অন্য সকল ধরণের আদিবাসী-জনজাতির গরিব মানুষ কে এটা বোঝানো ভীষণ জরুরী যে বাঙালি গরিব, বা বিশেষ করে বাঙালি গরিব মুসলিমেরা, তাঁদের শত্রু নয় বরং যে বৃহৎ শক্তি আসামের সম্পদ লুঠ করছে, অহমীয় মানুষকে শোষণ করছে, আদিবাসীদের উপর আগ্রাসন চালাচ্ছে, সেই একই শত্রুর দ্বারা বাঙালি গরিবরাও  শোষিত। শ্রেণীর পক্ষে মানুষ কে জাগ্রত করতে পারলে, শ্রেণী ঐক্য গড়তে পারলে, এমনকি একটি ছোট অঞ্চলে হলেও তা কিন্তু সমগ্র আসামের রাজনীতিতে এক বিশাল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে এবং ভারতের শাসক শ্রেণীর ও বিদেশী কর্পোরেটদের দালাল বাম-ডান নির্বিশেষে সকল প্রকারের উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তিকে আসামে পরাস্ত করতে পারবে।

অহমীয় গরিব কৃষক, শ্রমিক, আদিবাসী জনগণ, নানা জনজাতির জনগণ কে এক ছাতার তলায় আনতে পারবে শুধু সামন্তবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবী সংগ্রাম। জমি ও ক্ষমতা দখলের রাজনীতি যদি অহমীয় বা বিভিন্ন জনজাতির দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে ঢুকতে সক্ষম হয় তাহলে কিন্তু তাঁরা চিনে নেবেন তাঁদের শত্রু কে এবং বিপ্লবী সংগ্রাম মারফত নিজেদের প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি তাঁরা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।  আর এই রাজনৈতিক শক্তির জন্ম হলেই কিন্তু বিগত সাত দশক ধরে চলতে থাকা বাঙালি-বিরোধী ঘৃণার রাজনীতি পাঁকে ডুবে মরবে।

আজ সারা আসাম জুড়ে সাধারণ অহমীয় শ্রমিক-কৃষক, মেহনতি মানুষদের, ছাত্র-যুব, নারী এবং গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মানুষদের বোঝানো উচিত যে দাবি ওঠানো হোক সমগ্র আসাম জুড়ে কৃষকদের জমি বন্টনের, চা বাগানের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির, দাবি তোলা হোক যে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল বেকার মানুষকে অবিলম্বে কর্মসংস্থান দেওয়া হোক। সকল ছাত্র-ছাত্রীর জন্যে বিনামূল্যে শিক্ষা, সকল মানুষের জন্যে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য আর সবার জন্যে রোজগারের বন্দোবস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার কে অবিলম্বে করতে হবে। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দেশ ও মানুষকে অহমীয় জাতি বা বাঙালি জাতি ভাগ করেনি, ভাগ করেছিল সাম্রাজ্যবাদী ও মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা আর তাঁদের পাপের ফল কিন্তু আজ গরিব মানুষ ভোগ করবে না। যে মানুষের শ্রমের মাধ্যমে আসামের সমাজের বৃদ্ধি ও উন্নয়ন হয়েছে সেই মানুষগুলো কে না তাড়িয়ে আসাম থেকে অবিলম্বে তাড়াতে হবে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শাসক শ্রেণীর সকল পা-চাটা কুকুরদের।

বর্তমানে যে ৪০ লক্ষ মানুষ আজ বাস্তুচ্যুত হয়ে আবার উদ্বাস্তু হতে বসেছেন, তাঁদের প্রতি এই অন্যায় দেখে যদি আজ বিপ্লবী কমিউনিস্টরা তাঁদের পাশে না দাঁড়ান, যদি ভারতের জনগণের সবচেয়ে বড় শত্রু বিজেপি-আরএসএস এর বিরুদ্ধে বর্শামুখ ঘুরিয়ে ধরে, জনগণ কে জাগ্রত করে, ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের পথে পা না বাড়ান, তাহলে তাঁরা আসলে কমিউনিস্টই নন। অহমীয় উগ্র-জাতীয়তাবাদ ও ভারতের শাসক শ্রেণীর চাঁদায় চলা হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ, এই দুটিই মানুষের শত্রু এমনকি অহমীয় জাতিরও শত্রু। তাই এই অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে, বাঙালি জনগণের প্রতি হতে চলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমগ্র অহমীয় ও আদিবাসী-জনজাতির মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে হিন্দুত্ববাদী শাসক শ্রেণী কে ও তার পদলেহী আরএসএস-বিজেপি সহ সমস্ত ঘোরতর শ্রমিক-কৃষক বিরোধী অহমীয় উগ্র-জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলি কে পরাস্ত করার সংগ্রাম করাই আজ আসামের বিপ্লবী কমিউনিস্টদের প্রধান কর্তব্য। যে বা যাঁরা জাতি স্বার্থের কথা বলে শ্রমজীবী মানুষ কে উদ্বাস্তু করার পক্ষে কথা বলবেন, সে বা তাঁরা কমিউনিস্ট তো দূরের কথা মানুষ হিসেবে পরিচিত হওয়ার যোগ্য নয়।

আসাম জুড়ে জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামই একমাত্র পথ NRC খারিজ করার

শ্রমজীবী মানুষের অধিকার রক্ষার ও ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে এমন একটি চুক্তি কে কখনোই মান্যতা দেওয়া যায় না যার ভিত্তি হলো গণহত্যা ও জাতি বিদ্বেষী দাঙ্গা। যদি আজ গুজরাটের ২০০২ সালের গণহত্যার পরে বজরং দল ও আরএসএস কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে চুক্তি করতো যে শুধুমাত্র সমস্ত মুসলিমদের জোর করে পাকিস্তান পাঠিয়ে দিলে এই গণহত্যা বন্ধ হবে আর যদি সরকার সেই চুক্তি মেনে নিত তাহলে কি কমিউনিস্টরা তা মানতেন? যাঁরা বিপ্লবের কথা বলে শ্রেণী সংগ্রামের জায়গায় জাতীয় সংগ্রাম গড়তে চান, তাঁরা কি সেই চুক্তি মানতেন? তাহলে আজ Assam Accord এর মতন চুক্তি, যা একটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথে আর একটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ক্ষমতা বাটোয়ারা করার চুক্তি, লুটের বখরার উপর অংশীদারীর চুক্তি, নেলি গণহত্যার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া চুক্তি, সেই চুক্তির ভিত্তিতে গঠিত NRC ও গরিব মানুষ কে জোর করে তাঁর দেশের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা কে তাঁরা সমর্থন করবেন কি ভাবে?

শ্রমজীবী বাঙালি ও অহমীয় জনজাতির মানুষের মধ্যে দ্বন্ধ লাগাবার খেলায় মমতা বন্দোপাধ্যায় থেকে শুরু করে নব্য ফ্যাসিস্ট বাংলা পক্ষ, সবাই এখন মাঠে নেমেছে নিজেদের বাঙালি-প্রীতি দেখাতে। গুজরাটি-মাড়োয়ারী মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের হাতের পুতুল রাষ্ট্রের বেঁধে দেওয়া সীমানায় খেলা করে তাঁরা বাঙালির স্বার্থ রক্ষা করতে চান এবং পশ্চিমবঙ্গে তীব্র অহমীয়-বিরোধী একটি জাতি ঘৃণার পরিবেশ তৈরী করতে চান। মুখে বিজেপি বিরোধিতার কথা বললেও আসলে এই ফাঁকে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য কে ভাঙার প্রচেষ্টাই মুখ্য। যে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার পশ্চিমবঙ্গে তপন ঘোষের হিন্দু সংহতির মতন সাংঘাতিক এক মার্কিন-ইজরায়েল অর্থে পরিচালিত হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী সংগঠন কে বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে বাঙালি হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে তুলতে মদত দেন, যে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস রাম নবমী থেকে হনুমান পুজোর মতন অবাঙালি উচ্চ জাতের হিন্দুদের  উৎসব কে পশ্চিমবঙ্গে জায়গা করে দিয়ে বিজেপি’র শ্রীবৃদ্ধির রাস্তা করে দিয়েছে, সেই মমতা বন্দোপাধ্যায় যে আসলে আসামের উদ্বাস্তু হতে বসা বাঙালিদের স্বার্থের কথা বলে নিজের সাথে বিজেপির দুই রাজ্যে ভোটার মেরুকরণের গুপ্ত চুক্তি কার্যকর করার পথে এগিয়ে চলেছেন সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আজ NRC তালিকার ফলে আসামে উদ্বাস্তু হতে বসা বাঙালি ও অবাঙালি শ্রমজীবী মানুষদের পক্ষ নিয়ে প্রকৃত বিপ্লবী কমিউনিস্টদের অবশ্যই পথে নামতে হবে, মানুষকে কে আসল শত্রু আর কে আসল মিত্র তা চেনাতে হবে এবং রাজনীতি দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে আসল শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলার স্বার্থে। স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক এক সমাজ, যেখানে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের জন্যে কর্মসংস্থান, মাথার উপর ছাদ, পরনের কাপড়, থালা ভর্তি ভাত, বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বন্দোবস্ত থাকবে, সেই সমাজ গঠনের জন্যে বাঙালি-অহমীয়-বিহারি সকল জাতির শ্রমজীবী মানুষ কে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। যতদিন ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় সাবর্ণ হিন্দুত্ববাদী শাসক শ্রেণী ও তার পদলেহী স্থানীয় দালালেরা টিকে থাকবে আসাম বা পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মুক্তি নেই। তাই আজ নিজেদের আলোময় ভবিষ্যতের জন্যে ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে, লড়াই করে বিজয় অর্জন করতেই হবে। ৪০ লক্ষ উদ্বাস্তু হতে চলা গরিব মানুষের সাথে যদি আসামের দুই কোটি গরিব মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন তাহলে পৃথিবীর কোন শক্তির সাধ্য নেই সেই ঐক্যবদ্ধ শক্তি কে পরাজিত করার।                

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে