উড়ালপুলের নিচে মৃত্যুর জবাব চাই, জবাব দিতেই হবে।

শনিবার, এপ্রিল ০২, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

মোটের উপর ভোটের বাজারেও দিনকাল ভালো না। এই ধরুন দুপুরে টিফিন করে ভাবলেন অফিসের বাইরে গিয়ে উড়ালপুলের নিচে একটা ডাবের জল খাবেন বা ছায়ার তলায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে সুখটান দেবেন (সতর্কবার্তা - ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকারক) তার আর জো নেই। কে জানে কখন মাথার উপর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে উড়ালপুল? বাড়িতে বাচ্চা মেয়েটা 'বাপি কখন আসবে?' জিজ্ঞাসা করে সবার মাথা খাবে আর লাশ পড়ে থাকবে কাঁটাপুকুরে। সবই তেনার ইচ্ছে ! এই কথা বলবেন তো? না, বলার আগে একটু ভেবে নিন।

প্রায় ৩০টি প্রাণ (সরকার বাহাদুরের প্রতিশ্রুতি ও পরিসংখ্যানে আঁতেল আর বাতেল বাদে কে বিশ্বাস করে?) হঠাৎ ভোগে গেল। কোনো যুদ্ধ নয়, পাক সন্ত্রাস নয়, বদমায়েশ "উন্নয়ন বিরোধী" নকশাল-মাওবাদী সন্ত্রাসও নয়, তবু কেন ঝরে গেল ৩০ টি প্রাণ? কেন হঠাৎ অন্ধকার আর অনিশ্চয়তা নেমে আসলো এতগুলো পরিবারের জীবনে? কারণ কেউ কোথাও ঘুষ খেয়ে মানুষ মারার লাইসেন্স বিক্রি করে ফেলেছে। অনেকগুলো লোক টাকার বদলে আমার আর আপনার জীবনের চুক্তি করে ফেলেছে। ধরুন বাসের ড্রাইভার রেষারেষি করে যদি দুর্ঘটনা ঘটায় আর তাতে কারুর প্রাণ যায় তাহলে পুলিশ ধরার আগেই তাঁর উত্তম মধ্যম জুটতো জনতার হাতে। কিন্তু বাস চলতে চলতে হঠাৎ যদি ব্রিজটা বা উড়ালপুলটাই ভেঙে পড়ে, তখন কাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে গায়ের ঝাল মেটানো যাবে?

একটা উড়ালপুল তৈরি হচ্ছে প্রায় সাত বছর ধরে আর শেষ পর্যন্ত তা ধ্বসে পড়লো আমার - আপনার মতন মানুষের ঘাড়ে। যদি আপনার বাড়ির কার্নিশ কোনো, মন্ত্রী বা বিধায়ক তো দূরের কথা, যদি কোনো কাউন্সিলর এর সাগরদের মাথায় ভেঙে পড়তো তাহলে আপনি কি রেহাই পেতেন এই বলে যে আপনার বাড়ি সেই ৬০ এর দশকে তৈরি হওয়ার পরে আর মেরামত হয়নি টাকার অভাবে? কিন্তু ৩০ টি মানুষের প্রাণ নিয়ে একটি কালো তালিকাভুক্ত সংস্থা নিজের দোষ আর দায় দৈব শক্তির উপর ঝেড়ে ফেলে দুঃখ প্রকাশ করছে। আর মমতা - সূর্য- অধীর- শমীকদের দল হায়েনার মতন মৃতদেহ গুলো নিয়ে রাস্তার উপর কামড়া কামড়ি করছে। এই ঘটনাগুলি নিছকই তেমন যেমনটি আমি আর আপনি দেখছি? বা, যে ভাবে আমাদের দেখাচ্ছে এই দেশের প্রচার মাধ্যম তাতে কি সত্যের লেশমাত্র আছে?

দোষটা মমতার না সিপিএমের বুদ্ধবাবুর সরকারের সেই তর্কে জড়িয়ে আমরা কি এটা দেখতে পাচ্ছি না যে আসলে এই উড়ালপুল ভেঙে মানুষ মারা আর মরা মানুষের দেহ উদ্ধার ও আহতদের চিকিৎসা নিয়ে যা চলছে তা এক প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাকান্ড ও ষড়যন্ত্র বাদে আর কিছুই নয়। একটা কয়েক কিলোমিটারের উড়ালপুল গড়তে সাত বছর ধরে কত টাকা ওই প্রাথমিক ১৬৫ কোটি টাকার সাথে জুড়েছিল তার হিসেব কে দেবে? কেন নির্মান কার্যে শ্লথ গতি দেখেও কাজের বরাত ফিরিয়ে নেয়নি সরকার? কেন বিরোধীরা চুপ ছিল?

মনে পরে ২০০৯ সাল? সেই যে বছর কংগ্রেস মমতার সখ্যতা হলো, লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের ভরাডুবি হলো, পরিবর্তনের আওয়াজ ডেসিবেল এর মাত্রা ছড়িয়ে আমাদের প্রতিটি রক্তকণায় প্রবেশ করলো, যে বছর লালগড় সহ সমগ্র জঙ্গলমহল বিদ্রোহ করলো। ভাবতে পারা যায় যে সেই বছর থেকে একটি কয়েক কিলোমিটারের উড়ালপুল তৈরি হতেই থাকলো কিন্তু শেষ হলো না? ঠিক ভোটের মুখে লোকের সামনে কিছুটা হৃত গৌরব ফেরাতে মমতা এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের হঠাৎ মনে হলো প্রোমোটার কে একটু ঠেলা দেওয়া যাক। আর ঠেলার ফলে ঠেলা সামলাচ্ছে আজ মৃত সাধারণ মানুষগুলোর পরিবার।

এই ভারতে, যে দেশে একশো টাকা পুলিশ কে দিয়ে বেমালুম জরিমানা থেকে বাঁচা যায় সেই দেশে একটা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ঠিকাদার সংস্থার উপর পুলিশি তদন্ত যে লোক দেখানো সবাই জানেন, এবং ভোটের পরেই এই ঘটনা যে বেমালুম কিছুটা চাঁদা আর সহযোগিতার ফলে চাপা পড়বে ফাইলের গাদার তলে, সে ভোটে যেই জিতুক না কেন। মমতার সাথে সিপিএমের তর্জন গর্জন ওই ভোটের মাঠেই, বিজেপির মাঝে বড়বাজারের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ভোট ব্যাংক ঠিক রাখতে আরএসএস এর সাথে মাঠে নেমে কসরত দেখানো, সেনা পাঠানো আর বাম-দক্ষিণ সকলের নানা দিকে দূর্গা পূজার মতন বারোয়ারি রক্তদান উৎসব করা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে ভোটের বাজারে ভালোই মালকড়ি খরচা হচ্ছে, মানে জিতলে, বা বেশি আসন থাকলে ফাটাফাটি কামাই করার সুযোগ আছে।

না, ওই মেকি সমাজসেবা দেখে ভুলবেন না যে পৃথিবীর সকল চোর-ডাকাত-খুনি মাফিয়ারাও সমাজসেবার সংস্থান চালায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা অন্য কোনো দরকারে পাড়ার ক্লাবের দাদারাও হঠাৎ একটু ইংলিশ গিলে ভালোই সমাজ সেবী হয়ে চাঁদা তোলেন। মোদ্দা কথা এবং সরল অঙ্ক হলো যে ব্যবসায় পুঁজি ঢালতে হয়, ভোটের ব্যবসা আলাদা নয় তাই এই লোক দেখানো ঢ্যামনামো, আর কুমভিরাশ্রু বর্ষণ করে ন্যাকা সেজেছে খুনিদের দল। ওই উড়ালপুল গড়ে ওঠা আর ভেঙে পড়ার নৈপথে বড়বাজার এলাকার সব ভোটবাজ রাজনৈতিক দল, নেতা, পৌর আধিকারিক এবং পুলিশের হাত ছিল। আজ ভগবানের রোষ বলে আর force majeure বলে পাড় পাওয়ার চেষ্টায় রত হায়দ্রাবাদের খুনি কোম্পানির বিরুদ্ধে এই দেশের মানুষ কে গর্জে উঠতে হবে। যাঁরা এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন সেই ২০১০ এর পার্ক স্ট্রিটের আগুনের শিখায় প্রাণ হারানো মানুষদের মতন তাঁদের ভুলে গেলে চলবে না।

তবুও কলকাতার নিহত মানুষগুলির ভাগ্য ভালো যে তাঁরা ভোটের মরশুমে কলকাতার প্রাণ কেন্দ্রে প্রাণ হারালেন। ধরুন যদি ভোটের এক আধ বছর পরে জঙ্গলমহলের কোনো বিচ্ছিন্ন প্রান্তরে সেতু ভেঙে ৩০ জন প্রাণ হারাতেন, বা ছত্তিশগরের অবুঝমদে যদি ৩০ জন আদিবাসী সিআরপির টিপ প্র্যাকটিসের শিকার হতেন তাহলে কি এত কথা এত চেঁচামিচি হতো ? না, সেখানে মৃতদেহ নয়, লাশ গায়েব হয়ে যেত চিরতরে। লাশ ওখানে কোনো বড় ব্যাপার নয়, যতক্ষণ না লাশটি শাসক শ্রেণীর বাহিনীর কারুর।

আজ মমতা যতই ক্ষতিপূরণ দিন, আরএসএস যত ইচ্ছে স্বয়ংসেবক নামক প্রাণীগুলোকে মাঠে ছেড়ে দিক, সিপিএম আর কংগ্রেস যত ইচ্ছে প্রতিবাদ মিছিল আর রক্তদান শিবির করুক, জনগণ এই ছিনিমিনি খেলা মেনে নেবেন না। হিসাব আজ চাইবেনা জনগণ, আর শাসককে আজ হিসাব দিতে হবেই।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে