আমরা দেশদ্রোহী তাই আমরা মানুষ হত্যার চরম বিরোধিতা করি

মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৯, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

Indian paramilitary lathicharge on Kashmiri protestors


আমরা দেশদ্রোহী তাই আমরা প্রশ্ন করি। দেশদ্রোহী বলেই তো আমরা তোমাদের সাধের কাশ্মীর নিয়ে ন্যাকা কান্না কাঁদি না বরং হান্দওয়ারা নিয়ে প্রশ্ন তুলি, তোমার রাষ্ট্রীয় সংস্করণে প্রকাশিত গল্পকে খারিজ করে চোখে চোখ রেখে রাজদ্রোহীর মতন প্রশ্ন করি যে কেন একটি কিশোরীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করার দায়ে থানায় আটকে রাখা হবে? কেন তাঁর উপর লালসা চরিতার্থ করতে যে ভারতীয় সেনার বীর পুঙ্গবটি এসেছিল তাকে গ্রেফতার করা হলো না। আমরা কুনান পোশপরা থেকে শাপিয়ানে ধর্ষণ কান্ডে জড়িত ভারতীয় সেনা কে দেশভক্তির দৃষ্টান্ত হিসাবে স্বীকার করি না বলেই আমরা দেশদ্রোহী। আমরা দেশ বিক্রি, নারী ধর্ষণ, গণ হত্যা ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি বলেই হয়তো আমরা দেশদ্রোহী।

এই দেশের উচ্চ বর্ণের পয়সাওয়ালা লোকেরা পায়ের উপর পা তুলে বলবে ওই বাচ্চা ছেলে মেয়েগুলো দেশের শত্রু, জঙ্গী, ওদের মেরে ফেলায় বা ওই মুসলমান মেয়েদের একটু ধর্ষণ করলে ক্ষতি নেই।  এর মধ্যে দিয়েই ভারতের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে, ভারতের সীমা আরও সুরক্ষিত হবে। আর যদি আমরা প্রশ্ন তুলি যে যখন প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ আমার দেশের সাথে থাকতে চাইছে না, কারণ এই দেশ কোনদিন তাঁদের দেশ ছিল না, ঠিক যেমন বাংলাদেশ কোনো কালেই নেপালের অঙ্গ ছিল না, তাহলে তাঁদের জোর করে ধরে রেখে, খুন ধর্ষণ করে, টিয়ার গ্যাস মেরে কি করে ধরে রাখা যাবে? কোনো দিনই তো কাশ্মীরের জনগণ ভারতের শাসন কে মন থেকে মেনে নিতে পারবেন না। প্রতি পাঁচ বছরে বন্দুকের নলের মুখে তাঁদের ভোট দিতে বাধ্য করিয়ে উপত্যকায় গণতন্ত্র-গণতন্ত্র খেললেই তো সেই মানুষগুলি আর দাসত্বের বন্ধন স্বীকার করবে না। এটা তো একবিংশ শতাব্দী ! ঠিক তখনই আমাদের উপর নিক্ষেপিত হবে বাছা বাছা বিশেষন ও খিস্তির বন্যা। দিল্লি - বোম্বাই হলে গেরুয়া লম্পটের দল জাতীয়তাবাদের পতাকা নিয়ে লাথি মারতে উদ্ধত হবে, কলিকাতার বুকে লকেট-রুপা-দিলীপের নাট্য মন্ডলী ক্ষিপ্ত হয়ে গুঁতা মারতে আসবে, আর সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ও সর্ব শ্রেষ্ঠ টিভি চ্যানেলগুলি দাঁত খেঁকিয়ে তাড়া করবে। দেশ প্রেম শেখোনি ? ভারত ছেড়ে পাকিস্তান যাও!

তবুও আমরা নির্লজ্জ কান কাটা বেহায়ার মতন কিছু অপ্রিয় কথা জিজ্ঞাসা করে যাব। জানতে চাইবো কেন কাশ্মীরের মহিলারা আজও ওই "শান্তির দূত" ভারতীয় সেনার ঘাঁটির সামনে দিয়ে একলা যেতে, কোথাও বা দল বেঁধে যেতেও ভয় পান? কেন মনিপুরের মহিলারা রাস্তায় নেমে নগ্ন হয়ে ভারতীয় সেনা বাহিনী কে চ্যালেঞ্জ ছোড়েন যে - আয় আমাদেরও ধর্ষণ কর? কেন ছত্তিশগড়ের আদিবাসী নারীদের উপর শুধু দল বেঁধে ধর্ষণই নয় বরং তাঁদের স্তন টিপে দেখা হয় যে তাঁরা নকশাল কিনা ? দেশের তথাকথিত অবিচ্ছেদ্য অঙ্গগুলির অর্ধেকের বেশি যখন আজ হয় সেনা বাহিনীর শাসনের অধীন বা দেশী-বিদেশী কর্পোরেশনগুলির ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে কার্যরত পুলিশ - আধা সামরিক বাহিনীর বন্দুকের শাসনে চলছে তখন কোন গণতন্ত্রের কথা আমাদের গৃহমন্ত্রী সহ তাবর মন্ত্রী সান্ত্রী ও তাদের মালিক পুঁজিপতিরা বলে? গণতন্ত্র মানে নির্বিচারে মানুষ হত্যা এবং হত্যাকারীকে সর্বোচ্চ রক্ষা কবচ প্রদান? গণতন্ত্র মানে দেশের সবচেয়ে গরিব ৮৩ কোটি মানুষের উপর যুদ্ধ ঘোষণা করা ? গণতন্ত্র মানে সাম্প্রদায়িক হত্যাকান্ড ঘটিয়ে জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করিয়ে ভোটে জেতা ? গণতন্ত্র মানে আদানি, আম্বানি, বেদান্ত, টাটা, জিন্দল, বিজয় মালয়া, রামদেব, সাক্ষী মহারাজ, যোগী আদিত্যনাথ, সাধ্বী প্রজ্ঞাদের শাসন? সেই গণতন্ত্র নামক বস্তুটিকে মুখ বুজে মেনে নিয়ে বিদেশী পুঁজির জুতো চেটে জীবন নির্বাহ করে "মোদী বাবার জয়" বলে গাধার মতন চেচানো কে দেশপ্রেম বলে না দালালি করা বলে সে কথা কি আজও স্পষ্ট করে বলার দরকার পরে?

এক কালে জহরলাল নেহরু সাহেব কাশ্মীরের জনগণ কে কথা দিয়েছিলেন যে হানাদারদের তাড়িয়ে কাশ্মীরে শান্তি ফিরিয়ে এনে ওখানকার জনগণ কে ভারত সরকার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেবে এবং রাষ্ট্র সংঘের পর্যবেক্ষণে গণভোটের মাধ্যমে সেই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ফয়সালা হবে। সংবিধান পাশ করিয়েই নেহরু ও কংগ্রেস চালাকি করে সেই প্রস্তাবকে আস্তাকুঁড়েতে ছুড়ে ফেলে দেয় এবং সেই দিন থেকে কাশ্মীরের মানুষকে নাগা-মিজো-মনিপুরীদের মতন জোর করে ভারতের অধীনে রাখার কাজ শুরু হয়। দাসত্বের বাঁধন ভেঙ্গে স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় প্রাণ যায় বহু মানুষের। ভারত আর পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী কাশ্মীরের মানুষকে নিয়ে ভয়ানক জুয়া খেলা শুরু করে। দুই দেশের শাসকশ্রেণী প্রমান করার চেষ্টা চালায় যে কাশ্মীরের স্বার্থ তার সাথে থাকায় ভালো হবে। পাকিস্তান তৈরি করে এক ঝুটো "আজাদ কাশ্মীর", আর ভারতের শাসকশ্রেণী তো আজাদী শব্দটিকেও সহ্য করতে পারে না। তারা আরও নির্লজ্জ হয়ে ঘোষণা করে যে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং তাই মিলিটারী নামিয়ে সমস্ত রকমের আন্দোলন সংগ্রাম কে দমন করতে ভারতের শাসকশ্রেণী কুন্ঠা বোধ করে না।

কিন্তু দেশপ্রেমী নই বলেই হয়তো আমরা প্রশ্ন করি যে আর কতদিন দেশপ্রেমের নামে কাশ্মীরের ছেলেমেয়েদের রক্তে লাল হবে উপত্যকার রাস্তা? আমরা জানতে চাই কেন কাশ্মীরের মানুষকে আমাদের নামে হত্যা করা হচ্ছে যখন এই দেশের অধিকাংশ মানুষ, খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণ এই হত্যা, গুম, ধর্ষণের বিরুদ্ধে? যে ঝাড়খন্ড-উড়িষ্যা-ছত্তিশগড়ের আদিবাসীদের আজ বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলির স্বার্থে ভারতের সরকার খুন করছে, জমি-জঙ্গল-জল থেকে বেদখল করছে সেই মানুষগুলির নামে কেন কাশ্মীরের মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হচ্ছে? 

আমরা দেশপ্রেমী নই বলেই হয়তো আমরা দাবি তোলার হিম্মত দেখাই যে আমাদের নামে কাশ্মীরে হত্যা ধর্ষণ চালাতে আর দেব না। আমাদের নামে কুনান পোশপরা চালাতে দেব না। আমরা আমাদের নামে নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরতে দেব না। এটাই যদি রাজদ্রোহ হয় তাহলে আমাদের সকলেরই, আমরা যাঁরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করি, আমরা যাঁরা মানব অধিকারে বিশ্বাস করি, আমরা যাঁরা ওদের কালা আইন মানতে চাই না - সেই সকলেরই রাজদ্রোহী হয়ে গর্বিত বোধ করা উচিত। কারণ আমরা সকলেই তো দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের স্বার্থের সাথে সঙ্গতি রেখে ওই ১০ শতাংশ ক্লীব ও মেরুদন্ডহীন দালালদের থেকে নিজেদের আলাদা করে নেওয়ার সাহস দেখিয়েছি। 

আমরা গর্বিত রাজদ্রোহী হয়ে, আমরা গর্বিত তোমার দেশ বিরোধী হয়ে, কারণ তোমার দেশ আমার দেশ নয় আর আমার দেশ তোমার দেশ নয়। তাই ১০ শতাংশ ওই আমাদের দেশবিরোধী কর্পোরেট তাঁবেদারদের দেশছাড়া করতে সকল গণতন্ত্র প্রেমী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান করি। মনে রাখবেন আমরা সত্যের পক্ষে - তাই জয় আমাদের হবেই। ওদের লাঠি-গুলি-বেয়নেট যত বেশি চলবে বুঝতে হবে ওরা তত বেশি ভয় পেয়েছে। যত বেশি কিশোরকে ওই কাশ্মীরে সেনা বাহিনী হত্যা করবে পাথর ছোড়ার জন্যে বা লোড শেডিং এর বিরোধিতা করার জন্যে তত বেশি বুঝতে হবে যে ওরা ভয় পেয়েছে। যত বেশি বস্তার থেকে লাতেহার, নাগাল্যান্ড থেকে মনিপুরে ওরা মানুষ মারতে সেনা পাঠাবে তত বেশি বুঝতে হবে যে রাজা আজ ভয় পেয়েছে। ওষুধে মানুষ বশ থাকবে না রাজা, জনতা শীঘ্রই দেবে ডাক - দড়ি ধরে মারো টান - রাজা হবে খান খান।
  

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে