সিঙ্গুরে মেঘে ঢেকেছে আকাশ, টাটার বিরুদ্ধে আইনি যুদ্ধে বিজয় কৃষকদের

শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৬ 0 Comments A+ a-



সিঙ্গুরের টাটা কারখানার জন্যে অধিগৃহিত জমি কৃষকদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ সহ ফেরত দেওয়ার যে রায় সুপ্রিম কোর্ট দিল তা চিরকাল কৃষক আন্দোলনের পাতায় জ্বল জ্বল করবে। ভারতবর্ষের মাটিতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকেই কৃষি জমির থেকে কৃষকদের জোতদার-জমিদারদের সাথে হাত মিলিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে পুঁজিপতিদের স্বার্থে। বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াই করে কৃষকেরা যে জিততে পারবেন না এই ধারণা দীর্ঘ এক শতাব্দী ধরে ঠুসে ঠুসে কৃষকদের মনে ঢোকানো হয়েছিল এই দেশে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকেরা কিন্তু হিসেবের খাতাটা উল্টো করে দেখালেন। তাঁরা কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে পরাজিত করলেন দেশের সব চেয়ে বনেদি মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি গোষ্ঠী টাটা কে, যে টাটা আজ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির সাথে হাত মিলিয়ে সারা বিশ্বে নিজের ব্যবসার জাল বিছিয়ে চলেছে। আইনের ঘেরাটপের মধ্যে থেকে টাটার মতন সংস্থা কে আদালতে পরাস্ত করা কিন্তু কৃষকদের পক্ষে সহজ ছিল না। যদিও নিজের ভোট ব্যাঙ্ক ও ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে এই লড়াইয়ে সরকারকে জড়াতে হয়েছে এবং তৃণমূলী উকিল দিয়ে কোর্টে কেস লড়তে হয়েছে, তবুও এই ঐতিহাসিক রায়ের পিছনে কৃষকদের নিরবিচ্ছিন্ন ও লাগাতার সংগ্রামের অবদানটাই মুখ্য।

ভারতের শাসক শ্রেণীর এক মুখ্য অঙ্গ টাটা গোষ্ঠী। আর এহেন টাটার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায় বের হওয়ায় অনেকেরই হয়তো আজ চোখ কপালে ঠেকছে। অথচ কোর্টের রায় একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে এই রায়ে কৃষকের উপকার হলেও এর মধ্যে কর্পোরেট বিরোধী গন্ধ খুঁজতে যাওয়া মূর্খতা। কোর্টের রায় গেছে বামফ্রন্ট সরকারের ঘৃণ্য নীতি ও কীর্তির বিরুদ্ধে। সর্বোচ্চ আদালত বার বার রাজ্য সরকারের জমি অধিগ্রহনের সিদ্ধান্ত কে সমালোচনা ও খন্ডন করেছে। বৃহৎ পুঁজির আগ্রাসী চরিত্র যে সরকার ও সরকারি ব্যবস্থাকে গোলাম বানিয়ে ফেলে, তা সর্বোচ্চ আদালত কখনোই স্বীকার করবে না আর এ ক্ষেত্রেও সেই ব্যবস্থার কোনো সমালোচনা আদালত করেনি। এই রায়ের মধ্যে কোথাও দোষীদের শাস্তির নির্দেশ নেই, যে বুদ্ধদেব, সূর্য, বিমান, শ্যামল, রবিন, গৌতমরা সিঙ্গুরের কৃষকদের রক্ত ঝরিয়েছিলো, যে সিপিএম আর টাটাদের হার্মাদ বাহিনী সেদিন তাপসী মল্লিক কে ধর্ষণ করে খুন করেছিল ওই সিঙ্গুরের মাটিতে, তারা কিন্তু আজও সেই অপরাধের শাস্তি ভোগ করেনি। আমাদের চোখের সামনেই তাদের অনেকেই আজ তৃণমূলের খাতায় নাম লিখিয়ে সরকারি পক্ষের লোক হয়ে দিব্যি রয়েছে, সিপিএমের বৃদ্ধ ভামেরা আজ অবসরপ্রাপ্ত জীবন যাপন করছে তৃণমূলের ছত্রছায়ায়, আর রতন বাবুর কোলের চাঁদ সাইরাসের নেতৃত্বে পরিচালিত টাটা গোষ্ঠীর প্রতি মমতা তো উদার করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের দরজা।এই নির্বাচনের কিছুদিন আগেই সিঙ্গুরের জনগণের সংগ্রামের প্রতি বিদ্রুপ করতে টাটা ন্যানো গাড়ি চেপে রবিন দেব সিঙ্গুর গেছিল সিপিএমের প্রচারে। সেদিন তৃণমূলের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে সংগঠিত মানুষ ঘৃণার সাথে আবার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সিপিএম কে। সিঙ্গুর থেকে সিপিএমের যে শ্মশান যাত্রা শুরু হয়, ২০১৬ নির্বাচনে সেই কর্পোরেট প্রেম দেখানোর কারণে চিতায় শোয়া হয়ে যায় সিপিএমের।

যেদিন রায় বেরিয়েছে সেদিনই মমতা দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছে যে টাটা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, সিঙ্গুর-কলিঙ্গনগরের হত্যাকারীর বিরুদ্ধে, লোহান্ডিগুডায় আদিবাসী উচ্ছেদের খলনায়কের বিরুদ্ধে তৃণমূল সরকারের কোনো বিদ্বেষ নেই। টাটা কে বাংলায় শিল্প গড়তে অনুরোধ জানালো কৃষক দরদী সাজা মমতা। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যদি টাটা গোষ্ঠীর গায়ে ক্ষত লাগিয়ে দেয় তাহলে মমতার আহবানে রয়েছে সেই ক্ষতে মলম লাগানোর গুপ্ত অভিলাষ।মমতা আবার ঘোষণা করে দিলে যে সে রেল মন্ত্রী থাকাকালীন অনেকবার টাটাদের অনেক টেন্ডার পাইয়ে দিয়েছে। টাটার ঘাটে নোঙর ফেলার জন্যে ব্যাতিব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছে আগামী দিনে সিপিএমের সিঙ্গুর পর্বের তৃণমূলী সংস্করণ বাজারে আসতে বেশি সময় লাগবে না। 

সিঙ্গুরে টাটা ন্যানো কারখানা গড়ার নামে ২০০৬ সালে যে জমি বামফ্রন্ট সরকার জন স্বার্থের নামে দখল করেছিল, তার আয়তন ছিল প্রায় ৯৯৭ একর (প্রায় ৪ কিমি)। রতন টাটা সেই সময়ে বুদ্ধের সাথে শুধু সিঙ্গুরের জমির শর্তেই গাঁটছড়া বেঁধেছিল। টাটার কাছে তিন ফসলি ওই হুগলির জমি হঠাৎ এতই প্রিয় হয়ে ওঠে যে তার চেয়ে কমদামে রাঢ় বাংলা বা পুরুলিয়ায় জমি তারা কিনতে আগ্রহী হয়নি। শিল্পে হতদরিদ্র পশ্চিমবঙ্গের জনগণের আবেদন ছিল চাষের অযোগ্য জমিতে যেন কারখানা হয়, রাজ্যের মানুষের যেন কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু টাটার গোঁ ছিল ওই ৯৯৭ একর জমিই। যখন কৃষকেরা বুদ্ধদেবের জমিতে শিল্প না হলে আকাশে হওয়ার তত্বের বিরোধিতা করে প্রশ্ন তোলেন যে ৯৯৭ একর জমি কেন ন্যানো কারখানার দরকার, তখন বুদ্ধরা সেই প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করে বাণিজ্যিক গোপনতার শর্ত কে তুলে ধরে। তার সাথেই সিপিএম খাড়া করে অনিচ্ছুক আর ইচ্ছুক কৃষকের তত্ব। প্রথমবার বোধহয় ভারতবর্ষের বাম আন্দোলনের ইতিহাসে এত নগ্ন ভাবে কোনো দল পুঁজিপতিদের বাণিজ্যিক গোপনতার স্বার্থে কৃষক মারতে উদ্ধত হয়েছিল। আর এই সবের মধ্যেই একেবারে হাটের মাঝে ঝুলির থেকে হুলো বেড়ালটা বেরিয়ে পড়লো।

টাটা গোষ্ঠী সিঙ্গুরে যে জমি নিয়েছিল তা কলকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে দুর্গাপুরের দিকে যাওয়ার সময় বাম দিকে অবস্থিত। এই জমি রাস্তার ডান দিকের জমির চেয়ে বেশি উর্বর ছিল। টাটার সিঙ্গুরে জমি দেখার পিছনে নাকি কারণ ছিল কলকাতার কাছে হওয়ায় পরিবহনের সুবিধা। কিন্তু যে কারখানা টাটা গোষ্ঠী করতে চাইছিল তার জন্যে মাত্র ৪০০ একর জমিই যথেষ্ট ছিল। টাটার আনসিলরি ইউনিট ওই ৬০০ একর জমি জুড়ে যে হতো না সে কথা শিল্প সম্পর্কে একটু জ্ঞান রাখা মানুষও বলতে পারতেন। এর পিছনে ছিল কলকাতার কাছেই একটা ছোট খাটো উপনগরী গড়ে তুলে চড়া দামে উচ্চ মধ্যবিত্তদের বাড়ি বিক্রি করার পরিকল্পনা। যে পরিকল্পনার কথা গোপন করার স্বার্থেই বুদ্ধ বারবার ব্যবসায়িক গোপনীয়তার দোহাই দিত। আসলে কারখানার থেকে উৎপাদিত গাড়ির বাজার যে বছর ঘুরতেই পড়ে যাবে গুণ মানের কারণে আর বেশি দিন যে এক লাখি গাড়ি উৎপাদন করা যাবে না তা রতন টাটা ভালোই বুঝতে পেরেছিল। তাই কারখানার সাথে সাথে পরিকল্পনা করেছিল জমির ফাটকাবাজি আর রিয়েল এস্টেট শিল্পের মাধ্যমে লগ্নির থেকে কয়েক শতগুণ বেশি কামিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেটে পড়ার মতলব ছিল রতন টাটার।
বর্তমানে যখন ওই জমি কারখানার কাঠামো ভেঙে নতুন করে চাষ যোগ্য করে কৃষকদের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তখন দেখার বিষয় হলো যে পশ্চিমবঙ্গে পঙ্গপালের মতন বৃদ্ধি পাওয়া সিন্ডিকেটবাজি আর প্রোমোটারির কারবার যে দলের নির্দেশে আর দাক্ষিণ্যে চলছে সেই দলের বেচারাম আর কেনারামরা কৃষকদের জমি নিয়ে নতুন করে ফাটকা খেলতে শুরু করবে না তো ? নতুন করে কৃষকদের থেকে ছলে-বলে-কৌশলে জমি হাতিয়ে নিয়ে বেচারাম আর অন্য রামেরা আবার রতনের ফেলে রাখা কাজে হাত দেবে না তো ? 


সিঙ্গুরের কৃষকদের উপর গত দশ বছর ধরে যে অবিচার হয়েছিল, সেই অবিচারের ক্ষতে হয়তো সুপ্রিম কোর্টের এই রায় সাময়িক প্রলেপের কাজ করবে, কিন্তু বাদ থেকে যাবে খুনি টাটা গোষ্ঠীর বিচার। যে গোষ্ঠী সিঙ্গুরে তাপসী মল্লিকদের ধর্ষণ করিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারতে পারে, লোহান্ডিগুডিতে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করতে পারে আর কলিঙ্গনগরে কৃষক হত্যা করতে পারে, তারা সানন্দে মোদীর সাথে হাত মিলিয়ে ন্যানো কারখানা গড়ে আইনের প্রকোপ থেকে চিরকাল বেঁচে যেতে পারে। আদালতের বকুনি শুনিয়ে আমাদের মতন ইতরজনকে বোঝানো হবে যে টাটার কারখানার বিরুদ্ধে রায় বাড়িয়ে আদালত প্রমাণ করলো যে এই দেশের প্রশাসন যেন কতই না নিরপেক্ষ।সিঙ্গুরের কৃষকদের জমি ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেমন জরুরী ঠিক তেমনই জরুরী হলো টাটা ও সিপিএমের পান্ডাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাতে দেশের অন্যান্য প্রান্তের কৃষকদের কর্পোরেট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইতে জোয়ার আসে হিম্মত আর উৎসাহের।     

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে