ভাঙড় ঘিরে আনন্দবাজারের আতঙ্কের কারণ কি ?

বুধবার, জানুয়ারী ২৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

কেন আনন্দবাজার পত্রিকা ভাঙড়ে নকশাল আর মাওবাদী ভূত শুঁকে বেড়িয়ে পুলিশ লেলিয়ে দিতে চাইছে ?


আনন্দবাজার পত্রিকা ক্রমাগত একটা ধারণা প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা করছে বাঙালি পাঠকদের মননে যে ভাঙড়ের জমি ও জীবিকা রক্ষার জন্যে যে মানুষগুলো পথে নেমেছিলেন তাঁরা নাকি “নকশালপন্থীদের” বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক প্রচারের শিকার হয়েছেন, অলীক এবং শর্মিষ্ঠা সহ সিপিআই (এম-এল) রেডস্টার গোষ্ঠীর অন্যান্য কর্মী সমর্থকেরা নাকি ভাঙড়ে “মুক্তাঞ্চল” গড়ে তুলছে এবং এলাকার সমাজবিরোধীরা নাকি তাঁদের অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে।

গোয়েবেলস এর তত্ব অনুসারে একটি মিথ্যা কথা কে বার বার বললে মানুষ সত্য হিসেবে মেনে নেবে। বনেদি বাজারী কাগজ আনন্দবাজার পত্রিকা এই শিক্ষা খুব ভাল ভাবেই রপ্ত করেছে, আর বিগত আট দশক ধরে বার বার প্রয়োগ করেছে মালিক মুৎসুদ্দি বেনিয়া পুঁজিপতিদের, সাম্রাজ্যবাদী পিতৃদেবদের সেবায়। সেই ৫০ বছর আগে যখন নকশালবাড়ি আন্দোলন হয়েছিল আর বছর আটেক আগে যখন লালগড়ে গণ অভুথ্যান ও তাকে ঘিরে রকমারি নৈরাজ্যবাদী আন্দোলন দেখেছিলাম, সেই সময়ে আনন্দবাজার বার বার করে গণতন্ত্র রক্ষা করার আর “নকশাল” দমনের পক্ষে ওকালতি করেছে।  আজ ভাঙড়েও সেই একই উপাখ্যান পুনরায় দেখা যাচ্ছে।


শুভাশিস ঘটক, সামসুল হুদা থেকে সুরবেক বিশ্বাস, রকমারি নামের আড়ালে আনন্দবাজারের ঠাণ্ডা ঘর থেকে মিথ্যার বেসাতি উপচে পড়ছে। একবার বলা হচ্ছে যে ভাঙড়ের কাণ্ডে “মাওবাদীরা” জড়িত, আর এক বার বলা হচ্ছে “নকশালপন্থীরা” জড়িত। এই ধরুন ২২শে জানুয়ারি কলকাতা থেকে সুরবেক বিশ্বাসের নামে একটা রিপোর্টে লেখা আছে যে মাওবাদীদের গণসংগঠন গড়ে আন্দোলন করার ফল হলো ভাঙড় আর অন্যদিকে সেইদিনই শুভাশিস ঘটক, ভাঙড় থেকে সামসুল হুদার থেকে সাহায্য নিয়ে রিপোর্টে লিখছে যে ভাঙড় আন্দোলনের পিছনে আছে সিপিআই(এম-এল) রেডস্টার নামক সংগঠন। সিপিআই (মাওবাদী) আর সিপিআই (এম-এল) রেডস্টারের রাজনৈতিক লাইন কিন্তু একে অপরের থেকে ১৮০ ডিগ্রী উল্টো, দুই দল যে একে অপরের চরম বিরোধী সে কথা কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকা আপনাকে বা আমাকে জানতে দেবে না। কারণ মানুষের মধ্যে “নকশাল” ভীতি সৃষ্টি করেই তো প্রভুদের থেকে চরণামৃত পাওয়া যায় !


সিপিআই (মাওবাদী) সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবে, গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার রাজনীতিতে তত্বে ও প্রয়োগে বিশ্বাস করে এবং এই নীতি মেনে এই দলটি বহুদিন ধরে সশস্ত্র লড়াই করছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। কোথাও আদিবাসীদের উপর কর্পোরেট নিপীড়ণের প্রতিরোধ গড়তে, কোথাও আবার শাসক পার্টির বিরোধী পার্টিকে সশস্ত্র সহযোগিতা করে নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করার মতন কাজে এই দলটি লিপ্ত, এবং এই দলের বহু কর্মী ও সমর্থক বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছেন। যদিও জঙ্গলে আর পাহাড়ে লুকিয়ে থেকে গ্রামাঞ্চলের জনগণের সংগ্রাম থেকে, শ্রমজীবি মানুষের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে কি ভাবে বিপ্লবের লাভ হচ্ছে তা নিয়ে বহুদিন ধরে তর্ক-বিতর্ক চলছে।


সিপিআই (এম-এল) রেডস্টার দলটির  আবার সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি এলার্জি আছে আর কানু স্যানালের মতন এরাও বিশ্বাস করে যে ভারতের মাটিতে বিপ্লব করার মতন সময় যেহেতু আসেনি অতএব ভোটের ময়দানে কুস্তি লড়ে ততদিন নাকি “লেনিনীয়” শিক্ষায় প্রস্তুতি নিতে হবে। যে কথা ষাটের দশকে প্রমোদ দাসগুপ্ত আর আশির দশকে বিনোদ মিশ্র বা অসীম চাটুজ্যের মতন লোকেরা বলতো। যাই হোক সেই কুস্তি লড়তে এরা নানা ধরণের “সরকারি” ভাবে আইনসিদ্ধ “নকশালপন্থীদের” মতন রীতিমত অফিস খুলে বসে প্রতি নির্বাচনে যেখানে পারে প্রার্থী দেয় আর কুস্তি হেরে আবার আখড়ায় ফিরে যায়। এহেন দলের রাজনৈতিক লাইন হিসেবেই সশস্ত্র বিপ্লব যখন দূরবীন দিয়ে খোঁজার বস্তু তখন সেই দলের সাথে পাহাড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে “শ্রেণী শত্রু” বাদ দিয়ে “পুলিশের চর” বলে গ্রামবাসীদের  মারা মাওবাদীদের একই গন্ডিতে তো রাজনীতির অ, আ, ক, খ শেখা ছাত্র-ছাত্রীরাও ফেলবে না, ফেলবে শুধু আনন্দবাজারের উচ্চ বেতন প্রাপ্ত, ঠাণ্ডা ঘরে বসে নানা জায়গার খবরের ভিত্তিতে শাসক শ্রেণীর স্বার্থ পূরণের জন্যে “সংবাদ লেখকেরা”, যারা আজ দেশ জুড়ে ভারতের শাসক শ্রেণীর হয়ে পার্সেপশন ম্যানেজমেন্ট এর কাজ করছে।


আনন্দবাজার পত্রিকা ধুরন্ধর, তাই ওরা বাকি ভাঁড়দের মতন খোলাখুলি ভাঙড় কাণ্ডের বাপান্ত করবে না। করবে বেশ কায়দা করে, যাতে সাপও মরে আর পৈতৃক সম্পত্তি বাঁশের লাঠিটাও পরের পশ্চাৎদেশে বেদনা দেওয়ার জন্যে অক্ষত থাকে। ফলে বারবার আনন্দবাজার জোর দিচ্ছে উন্নয়নের প্রশ্নে, তৃণমূলের গোষ্ঠী দ্বন্ধের ঘটনায় আর পুলিশকে মনোবল দিচ্ছে ভাঙড়ে তৃণমূলের সন্ত্রাসী নেতা ও ভূ-মাফিয়া আরাবুল ইসলামের দলবলের বিরুদ্ধে স্পর্ধা দেখানোর জন্যে নেতৃত্ব দেওয়া  গণআন্দোলনের কর্মীদের “মাওবাদী” ও জঙ্গী আখ্যা দিয়ে যাতে গ্রেফতার করা যায়। কারণ কানহাইয়া কুমারের চেয়ে বেশি বাম হলেই তো আবার আনন্দবাজারের গ্যাস্ট্রিক সমস্যাটা বাড়ে।


ভাঙড়ের জমি আন্দোলনের লক্ষ্য কোন সমাজ বিপ্লব নয়; ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার শিক্ষার থেকে বলা যায় যে এই আন্দোলন দীর্ঘ সময় ধরে চলবে না বা এলাকা ভিত্তিক ক্ষমতা দখলের লড়াইতে পরিণত হবে না। ভাঙড় ভারতের ইয়েনান হবে না বা ভাঙড়ের পথ ভারতের পথও হবে না। তবুও এই লড়াইকে ভয় পেয়ে হঠাৎ করে আনন্দবাজার এত প্রচার কেন চালাতে শুরু করেছে আর কেন পুলিশ কে বারবার নিপীড়ন করে এই লড়াইকে ধ্বংস করতে উস্কানি দিচ্ছে? কেন বারবার অলীক আর শর্মিষ্ঠার মতন গণআন্দোলনের নেতা-নেত্রীদের “মাওবাদী” আর সহিংস বিপ্লবে বিশ্বাসী “নকশাল” সাজিয়ে গ্রেফতার করার জন্যে পুলিশকে বলা হচ্ছে ?


তার কারণ হলো পশ্চিমবঙ্গের আকাশে লাল মেঘ দেখিয়েছে ভাঙড়, গড়ে তুলেছে সমাজ-বিরোধী, খুনি, ধর্ষক, লম্পট আর জমি দখলকারী শাসক দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সত্যিকারের গণআন্দোলন। লাল মেঘ দেখলে তো ঘর পোড়া গরু ভয় পায়ই, তায় আবার সরকার পরিবারের মালিকানা থেকে বেরিয়ে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন হয়ে একেবারে জার্সি গাঁই হওয়া আনন্দবাজার বলে কথা। যে আনন্দবাজার দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি কে দুই মেরুতে বাঁধতে, যে দুই দিকে থাকবে শাসক শ্রেণীর দুই প্রধান চ্যালা তৃণমূল আর বামফ্রন্ট, সঙ্গে নন্দী ভৃঙ্গী সেজে কংগ্রেস ও বিজেপি নিজেদের জমি শক্ত করে উঠে আসবে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে।


কিন্তু এই সমস্ত গণ আন্দোলনগুলো, যা সাধারণ মানুষ কে তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্থানীয় স্তরে ঐক্যবদ্ধ ভাবে, বিনা কোন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে বৃহৎ সংগ্রাম করার হিম্মত দেয়, তা আনন্দবাজারের সাজানো বাগান বুনো ষাঁড়ের মতন তছনছ করে দেয়।  কারণ মানুষ বোঝেন যে সিপিএম, কংগ্রেস, বা দাঙ্গাবাজ বিজেপি কে বাদ দিয়েও তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে শুধু লড়াই করা যায় তাই নয়, তৃণমূলের সন্ত্রাস কে পরাস্ত করা যায় গণসংগ্রামের ঢেউতে। এই শিক্ষাটা, এই উপলব্ধিটা আপনার মস্তিষ্কে যাতে না ঢোকে তাই লগ্নিকারীরা কোটি কোটি টাকা দিচ্ছে আনন্দবাজার আর ওদের মতনই বাজারী সংবাদ মাধ্যম কে।


মিথ্যা প্রচার ও কুৎসার বন্যা ছুটিয়ে আনন্দবাজার যে ভাবে ভাঙড়ের সাধারণ মানুষের তৃণমূলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কে কলমের প্যাঁচে হেয় করতে চেয়েছে, সেই লড়াইয়ের ফলে কিন্তু সমগ্র বাংলা জুড়ে এত ছোট-বড় তৃণমূল বিরোধী লড়াই গড়ে উঠবে যে আনন্দবাজারের কাগজ ছেঁড়া পাতার মতন উড়ে যাবে। তৃণমূলের অপশাসনের উল্টো রথ এখনো বের হয়নি ঠিকই, কিন্তু ভাঙড়ের লড়াই মন্দিরের দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে। তাই তো শাসক শিবিরে এত আর্তনাদ। শোষকের আর্তনাদ শুনলে শোষিতের ঘুম ভালো হয়, অতঃপর সাব্বা খেয়র।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে