ভাঙড়ের লড়াই আর বহিরাগতের গল্প

বুধবার, জানুয়ারী ২৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

ভাঙড়ের গণআন্দোলনের উপর পুলিশি নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে কলকাতায় প্রতিবাদ মিছিল


ভাঙড়ের কৃষিজীবি মানুষের জমিরক্ষা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে এবং তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামের মাফিয়ারাজের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে গণআন্দোলনের কর্মী শর্মিষ্ঠা কে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বীর পুঙ্গব পুলিশ বাহিনী আরাবুলের হার্মাদদের সাহায্যে গ্রেফতার করেছে।

শর্মিষ্ঠা আজ পশ্চিমবঙ্গের জন্যে, ভাঙড়ের জনগণের জন্যে নাকি ভয়ানক বিপদজনক “সন্ত্রাসবাদী” - ভারতের তথাকথিত প্রজাতন্ত্রের ৬৭তম বার্ষিক প্রতিষ্ঠা উৎসবের আগে এই ছিল রাজ্যের গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের “মা-মাটি-মানুষের” সরকারের জনগণ কে দেওয়া উপহার। হয়তো বা নিন্দুকেরা বলবেন আরাবুলকে ওর দিদির দেওয়া উপহার !

শুরুটা বোঝাই গেছিল যখন হঠাৎ করে নিউটাউনের বিধায়ক ও বর্তমান রাজারহাটের সিন্ডিকেটবাজদের পাণ্ডা, সব্যসাচী দত্ত, আরাবুল ইসলামের প্রক্সি মেরে ভাঙড়ে পুলিশ ও তৃণমূলের সশস্ত্র হার্মাদ বাহিনী নিয়ে ঢুকে গ্রামের রাস্তার থেকে অবরোধ ওঠানোর কাজ শুরু করে তৃণমূল নেত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নির্দেশে।

প্রতিটা রাস্তা থেকে বন্দুকধারী পুলিশ, আরাবুলের সশস্ত্র পদাতিক বাহিনী এবং নিউটাউনের দুষ্কৃতীদের নিয়ে গাছের গুঁড়ি, পাথর ইত্যাদী সরাতে থাকে সব্যসাচী আর সাথে ছিল বাজারী সংবাদ মাধ্যমের ও জাগো বাংলার ফটোগ্রাফারদের বিশাল বাহিনী, মুহূর্তে মুহূর্তে পোজ দিয়ে রীতিমত “নায়কসুলভ” কাজ করতে দেখানো হলো সিন্ডিকেটবাজের পান্ডাকে। বোঝাই যাচ্ছিল যে রাস্তা সাফ অভিযান চলছে পুলিশের সাহায্যে গ্রামে গ্রামে তৃণমূলী হার্মাদ বাহিনী ঢুকিয়ে অত্যাচার শুরু করার লক্ষ্যে।

মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার কে হঠাৎ পুলিশী পাহারায় হার্মাদ বাহিনী পাঠিয়ে একেবারে সিপিএমের “সূর্যোদয়” অপারেশনের মতন এলাকা দখল করতে হলো কারণ সমগ্র ভাঙড় অঞ্চলে আজ তৃণমূলের কোন শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। মমতার পেয়াদারা আর আরাবুলের হার্মাদদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ভাঙড়ের জনগণ এলাকাকে দুষ্কৃতীদের থেকে মুক্ত করেছেন। আর এতেই মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের ভিতে একটা গভীর কামড় লেগেছে। ভাঙড় যেন সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামের মতন জনগণের কাছে আদর্শ না হয়ে উঠতে পারে, যেন ভাঙড়ের অনুকরণে দিকে দিকে ভাঙড় না গড়ে উঠতে পারে তার জন্যে মমতা বন্দোপাধ্যায় আজ অন্ধকারে হাত পা ছুড়ছে আর বার বার সিপিএমের নন্দীগ্রাম পর্বের সাথে তৃণমূলের ভাঙড় পর্বের সাদৃশ্যতা জনগণের সামনে প্রকাশ করছে।

এই ধরুন বারবার করে এলাকার মানুষের স্বার্থে পাওয়ার গ্রিডের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া  জমি-জীবিকা-পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষা কমিটি মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকারের কাছে দাবি তুলেছে যে সরকার যেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে এবং সরকারি ভাবে বিজ্ঞপ্তি জারি করে পাওয়ার গ্রিডের প্রকল্প বাতিলের কথা ঘোষণা করে। কিন্তু মমতা বন্দোপাধ্যায় আজ ঘর পোড়া গরুর মতন ঈশান কোনে সিঙ্গুরে মেঘ দেখে আতংকিত হয়েছে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মমতা বন্দোপাধ্যায় আলোচনা করবে না কারণ আলোচনার কথায় মমতার অহঙ্কারে আঘাত লাগবে, কারণ তাকে বাদ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রতিনিধিত্ব কেউ করতে পারে বলে সে মনে করে  না। আর ভাঙড়ের আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনায় বসা মানে মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের সামনে, গণ আন্দোলনের সামনে মাথা ঝোঁকাচ্ছে। তা তো আলবাত হবে না!

আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দমন পীড়নের স্বার্থে মমতা বন্দোপাধ্যায়, মোদীর ঘনিষ্ঠ মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স জিও, ও পশ্চিমবঙ্গের কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যম হাতে হাত মিলিয়ে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বলছে যে আন্দোলন নাকি মাওবাদীরা করছে আর এই অভিযোগে গ্রামবাসীদের আন্দোলনে যোগ দিতে দূর দূর থেকে আসা গণ আন্দোলনের কর্মীদের পিছনে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, শর্মিষ্ঠার মতন রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে আন্দোলন নাকি বহিরাগতরা নেতৃত্ব দিয়েছে এবং তাই বহিরাগতদের প্রভাব থেকে জোর করে এলাকার মানুষ কে বের করতে হবে।

আহারে! এই তৎপরতা যদি মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূলের সরকার ধুলাগড়, হাজীনগর, চন্দননগর বা খড়্গপুরে দেখাতো তাহলে সেখানে সাম্প্রদায়িক অশান্তির আগুন জ্বালাবার সাহস সংঘ পরিবারের “বহিরাগত” আবাঙালি কর্মীদের হতো না। চরম ব্রাক্ষণত্ববাদী এই তৃণমূল নেত্রীর কাছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দু আর মুসলমানদের মেরুকরণ করাটা অন্যায় নয়, অন্যায় হলো অত্যাচার ও লুঠের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আর স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠানো।

মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার আজ যখন নিজের ব্রাক্ষণত্ববাদী চরম ঘৃণ্য চেহারাকে ধুলাগড়ের পরে আর লুকোতে পারছে না আর শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকার মতন ভাঙড়ের মাটিতে তৃণমূলের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা মানুষদের পিষতে পারছে না, ঠিক সেই সময়ে নিজের দলের আর সরকারের মুখরক্ষার জন্যে বারবার করে “বহিরাগত” লোকের তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রতি কিছু প্রশ্ন করা আজ পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্র প্রেমী মানুষের পক্ষে আবশ্যিক হয়ে উঠছে।

প্রশ্নগুলো সরাসরি মমতা বন্দোপাধ্যায় কে করা এবং এই প্রশ্নের মধ্যেই আপনি চেষ্টা করলে উত্তর খুঁজে পেতে পারেন:

১) পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কি তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া আর কোন দল করার অধিকার নেই ?
২) যদি অধিকার না থেকে থাকে তাহলে জনগণ কে জানানো হোক কোন আইনের অধীনে জনগণের নিজস্ব পছন্দের রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও কর্মী হওয়া আটকানো হচ্ছে ?

৩) যদি জনগণের অধিকার থেকেই থাকে ইচ্ছে মতন রাজনৈতিক দলে বা গণসংগঠনে যোগ দেওয়ার, তাহলে কি তাঁরা এক এলাকার থেকে অন্য এলাকার মানুষের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের সাথে একাত্ম হতে পারেন না? পশ্চিমবঙ্গের ভিতরে তৃণমূল কংগ্রেস বাদে অন্যান্য দল ও গণ সংগঠনের কর্মীদের কি এক জায়গার থেকে আর এক জায়গায় রাজনীতি করতে যেতে হলে তৃণমূল কংগ্রেসের অনুমতি প্রয়োজন ?

৪) যদি “বহিরাগতদের” নিজের পাড়া বা এলাকার বাইরে গিয়ে অন্য জায়গায় রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেওয়া এতই খারাপ কাজ হয়, তাহলে এক দশক আগে সিঙ্গুরে বা নন্দীগ্রামে যাঁরা কলকাতা সহ বিভিন্ন জায়গার থেকে গিয়ে আন্দোলন শুরু করেন তাঁরাও খারাপ কাজ করেছিলেন ? দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে মঞ্চটাও বহিরাগতরাই নাকি করেছিল বলে সিপিএমের হুগলি জেলা কমিটির নেতারা বলতো। আর বলতো সিঙ্গুরের মানুষের উন্নয়নের পক্ষে সমর্থনের গল্প। মনে পড়ে ?

৫) “বহিরাগত” শক্তির নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তোলা যেমন খারাপ তেমনই নিশ্চয় বহিরাগতদের নিয়ে এলাকার ভিতরে ঢুকে আন্দোলন ভাঙ্গার কাজও খারাপ ? সব্যসাচী দত্ত কি ভাঙড়ের “ঘরের ছেলে”? সব্যসাচীর সাথে যে সমস্ত তৃণমূলী গুন্ডারা রাজারহাট থেকে ঢুকেছিল তারা কি ভাঙড়েই হামাগুড়ি দিয়ে বড় হয়েছিল?

৬) আশা করা যায় সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে অবাঙালি পুঁজিপতি আর আড়ৎদারদের মদতে যেভাবে ভিন রাজ্য থেকে এসে আরএসএস কর্মীরা যেভাবে ঘাঁটি গেড়ে জঙ্গলমহল সহ সমস্ত রাজ্যের আদিবাসী অধ্যুষিত ও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় দাঙ্গার আগুন লাগাবার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধেও একই ভাবে রাজ্য পুলিশ, সব্যসাচীর “কমরেডগণ” ও বজ্র বাহিনীর জওয়ান নিয়ে আক্রমণ করা হবে ? আইন রক্ষকরা নিশ্চয় ভেদাভেদ করবে না ?

৭) যাঁরা মানুষের জমি, জীবিকা, ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষার কথা বলেন তাঁরা কি মাওবাদী? তাহলে তৃণমূল কংগ্রেস যখন একই ভাবে “মা, মাটি, মানুষের”  স্বার্থের কথা বলে নন্দীগ্রামে বা লালগড়ের মানুষের সিপিএমের হার্মাদদের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল তখন ওদের সাথে মাওবাদীদের গোপন যোগসাজেশ ছিল?

৮) বুদ্ধদেব  ভট্টাচার্য আর মমতা বন্দোপাধ্যায়ের, বিমান বোস আর মুকুল রায়ের মধ্যে আন্দোলনের বিরোধিতা করার ধরণের মধ্যে পার্থক্য কি ?


আসলে সত্যি বলতে কি আজ যাঁদের বয়স তিরিশের কোঠায় তাঁরা সবাই মমতার কীর্তি দেখে, তৃণমূলের ঘৃণ্য রাজনৈতিক ব্যাভিচার দেখে, জনগণের বিরুদ্ধে বেইমানি দেখে, বুঝতে পারছেন যে সেদিনের নন্দীগ্রাম আর আজকের ভাঙড়ের মধ্যে বেশি পার্থক্য নেই, সেদিনের বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে শাসকেরা যে ভাবে সদর্পে কৃষকদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ছিল তার সাথে বর্তমানে শাসক দলের বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভাঙড়ের লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বুদ্ধদেবের সরকার যেমন নির্বিচারে কৃষি জমি রক্ষার আন্দোলনে সামিল হওয়া সমস্ত রাজনৈতিক শক্তিকে হয় মাওবাদী না হয় প্রতিক্রিয়াশীল বলে আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল তার সাথে এইভাবে শর্মিষ্ঠা কে গ্রেফতার করার মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মমতা বন্দোপাধ্যায় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে না কারণ অহংকার ও দর্প মানুষ কে অন্ধ করে দেয় এবং নিজের দলের পেশিশক্তির উপর নির্ভর করে যেভাবে মমতা বন্দোপাধ্যায় বারবার নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে তা কিন্তু নিমেষে ভঙ্গ হতে পারে, কারণ সিপিএম ৩০ বছর শাসন করার পরে নন্দীগ্রামের মুখোমুখি হয়, মমতার তো সবে ছয়।

দেড় মাস পরেই মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূলের নেতারা ১৪ই মার্চ নন্দীগ্রামের সংগ্রামী কৃষক শহীদদের স্মরণে অনুষ্ঠান করে ন্যাকা কান্না কেঁদে মানুষ কে যখন বোকা বানাবার চেষ্টা করবে তখন যদি নন্দীগ্রামের মানুষ মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে আওয়াজ তোলেন বহিরাগত মমতা দূর হঠো ! তাহলে কি বলবে তৃণমূল?   

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে