মোদীর প্রতিশ্রুতির বন্যা ছুটলেও নোট বাতিলের ভোগান্তি কমবে না

মঙ্গলবার, জানুয়ারী ০৩, ২০১৭ 0 Comments A+ a-



নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর ভক্তদের উবাচ বহুদিন ধরে শোনার পরে যখন জনতার পেটে আমাশা হওয়ার উপক্রম ঠিক তখনই আমরা সেই  ৩০শে ডিসেম্বর পার করলাম, পেরিয়ে এলাম ২০১৬। সেই মহৎ সন্ধিক্ষণ যখন নরেন্দ্রীয় প্যাঁচে চিরকালের জন্যে নাকি কুপোকাৎ হয়েছে  কালো টাকা (টাকার বর্ণ বিদ্বেষটা প্রচন্ড বেশি), আর আমরা, অর্থাৎ জনতা জনার্দন, প্রবেশ করলাম নাকি এমন এক নতুন যুগে যে যুগে নগদ নাকি ঘোর অলক্ষুণে জিনিস হিসেবে গণ্য হবে আর টাকার হিসেব হবে পিওএস মেশিন আর পেটিএম অ্যাপ দিয়ে। স্বদেশী আর মেক ইন ইন্ডিয়া’র স্লোগান তুলে আর চীন বিরোধী জিগির তুলে বাজার গরম করা সংঘ পরিবার আজ চীনা বৃহৎ পুঁজির চেয়ারম্যান পেটিএম কে নিজেদের গাইডিং ম্যান মেনে নিয়েছে।

তবে সেই ৫০ দিনের সীমানা পার করেও আমাদের হাতে থাকলো পেন্সিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাতির প্রতি ভাষণ দেওয়ার সময় একবারের জন্যেও জানালো না যে কত টাকা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় ১১ই নভেম্বর থেকে ৩০শে ডিসেম্বর অবধি জমা পড়েছে। শেষ পাওয়া হিসেবে অনুযায়ী প্রায় ₹১৫ লক্ষ কোটি টাকার অচল ₹৫০০ আর ₹১০০০ টাকার মধ্যে ₹১৩ লক্ষ কোটি টাকা জমা পড়েছিল, অর্থাৎ নগদে কালো টাকার অঙ্কটা নেহাতই নস্যি আর তাই নরেন্দ্র মোদীর মাছি মারতে কামান দাগার পিছনে যে অন্য মতলব নেই সে কথা বিজেপি ও আরএসএস বাদে আর কেউ মানতে নারাজ।

এই গোলযোগের ৫০ দিনে আমরা কিন্তু অনেক কিছুই এমন দেখলাম যা দেখে আমরা থ নয় বরং থতমত খেয়ে গেলাম। প্রথম যেদিন ঘোষণা হলো যে কালো টাকা রোধ করতে বিজেপি সরকার রাজার নাক কেটে মাছি মারার মতন ₹৫০০ আর ₹১০০০ এর নোট বন্ধ করে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সেদিন সন্দেহ তো হয়েছিলই, কিন্তু একটু খোঁজ খবর করেই বোঝা গেল যে কালো টাকা উচ্ছেদ করার নামে মোদী সরকার কি ভাবে গরিবের পেটে লাথি মেরে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর লাভের পাহাড় বাড়াবার বন্দোবস্ত করে গেল।

আমাদের ৮ই নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী জানায় যে তার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত আসলে ভারতের অর্থনীতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা নগদ কালো টাকার থোকের উপর একেবারে ড্রোন হামলা না হলেও কার্পেট বোমাবর্ষণ তো বটেই। সমস্ত বাজারি হিন্দুত্ববাদী সংবাদ মাধ্যম আমাদের জানিয়েছিল যে মোদীর এই রকমের একটা “সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের” আঘাতে কালো টাকার মালিক, বড় বড় ধন কুবেররা নাকি কুপোকাৎ হয়ে গেছে।

অথচ যে বা যারা অর্থনীতির হাল হকিকৎ জানেন তাঁরা চোখ বুঁজে বলতে পারেন যে ₹৫০০ আর ₹১০০০ নোট বাতিল হওয়ার কথাটা কানাকানি আর ফিসফিসানির মধ্যে দিয়ে প্রায় আট নয় মাস ধরেই সমগ্র ভারতের অর্থ বাজারের পান্ডারা জেনে রেখেছিল। এই ধরুন রাজস্থানের কোটার বিজেপি বিধায়ক ভবানী সিংহ যেমন স্পষ্ট জানান দিল যে আদানি আর আম্বানিরা বহুদিন আগে থেকেই নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানতো আর তাই নিজেদের প্রস্তুত করতে তারা সক্ষম হয়েছে।

নামটা দুটোই নয়, কারণ আম্বানি আর আদানি মানে ভারতের সেই নব্য মুৎসুদ্দি “ক্রোনি” পুঁজিপতিদের দল যারা সমস্ত সরকারকে নির্লজ্জ ভাবে পকেটে পুরে নিজেদের স্বার্থ পূরণ করে।  আর এই নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা একবার ফলাও করে বাজারি সংবাদ মাধ্যমের মধ্যমণি টাইমস অফ ইন্ডিয়া একবার ছেপেছিল।

টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় ৮ই এপ্রিল ২০১৬ তে মুম্বাই শহর থেকে ময়ূখ শেট্টি ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদ সৌম্য কান্তি ঘোষের রিপোর্ট উল্লেখ করে লিখেছিলেন যে সেই সময়ে নির্বাচনের কারণে জনগণের মধ্যে নগদের যোগান বেড়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা নানা মহল থেকে প্রকাশ পাচ্ছিল, বিশেষ করে যে যুক্তি নগদের যোগান বাড়তে দেখে তৎকালীন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রাজন প্রকাশ করেছিলেন,  তা ভুল, কারণ সেই সময়ে নাকি কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা বড় অঙ্কের নোট বাতিল হওয়ার ঘোষণার একটা খবর চাউর হয়েছিল ফলে অনেকেই নিজেদের চেপে রাখা নগদ কালো টাকা নানা খাতে লগ্নি করা শুরু করে।  আর স্টেট ব্যাঙ্কের কর্ণধারিনী অরুন্ধতী ভট্টাচার্য’ও  এই রকমের একটা “গুজবের” অস্তিত্ব নাকি সেই সময়ে মেনে নিয়েছিলেন।

ফলে মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা গোপন ছিল আর কেউ জানতো না সে কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বরং শুরুর থেকেই এই কথা সমস্ত কালো টাকার মালিকেরা বিজেপির থেকে জানতে পারে। আর পরবর্তী কালে যে বিজেপির নেতারা নানা জায়গায় নানা ভাবে জমি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে লগ্নি করে নিজেদের নগদ কালো টাকা সাদা করে ফেলে সে কথা এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে।  আবার দেখা গেল এই গত ৫০ দিনে যখন জনগণ, বিশেষ করে শ্রমজীবি মানুষ, লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে সারাদিন কষ্ট করে হয় এটিএম থেকে ₹২৫০০ বা ব্যাঙ্ক থেকে ₹৪০০০ বা ₹৫০০০ টাকা তুলতে পারছিল, ঠিক সেই সময়ে কর্ণাটক, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, প্রভৃতি বিজেপি বিরোধী শাসিত রাজ্যে হঠাৎ একের পর এক তথাকথিত “দেশপ্রেমিক” বিজেপি কর্মী ও নেতারা কোটি কোটি টাকার নতুন নোট পাচার করার সময় ধরা পড়ে যাওয়ায় অনেকটা অস্বস্তি শুরু হলো “জাতীয়তাবাদের” ধ্বজ্জাধারী সংবাদ মাধ্যমগুলো।

প্রথমতঃ কর্পোরেট বাজারজাত সংবাদপত্রগুলো এবং বিশেষ করে তথাকথিত “দেশপ্রেমের” ন্যাপি পড়া সংবাদমাধ্যম মোদীর নোট বাতিলের  ঘোষণাটা এমন ভাবে পরিবেশন করেছিল যাতে আমাদের মতন ট্রেনে- বাসে-অটোয় ঝুলে যাতায়ত করা সাধারণ মানুষের মনে হয়েছিল এমন একটা গেরিলা আক্রমণে বড় বড় পুঁজিপতিগুলো নাই ফাঁসলো অন্তত পাড়ার মোড়ে দাদাগিরি করে সিন্ডিকেটবাজির টাকায় পাহাড় তৈরি করা তৃণমূলী মালগুলো তো ডুববেই।  কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দেখি ও হরি ! ফাঁসলো তো রামা কৈবর্ত্য আর হাসিম শেখের মতন গরিব মানুষগুলো।  

দ্বিতীয়তঃ তৃণমূলের মদন থেকে বিজেপির দিলীপ, সিপিএমের রবিন থেকে কংগ্রেসের অধীর, এরা কবে কোথায় আর কত টাকা নগদে জমা করলো সে তথ্য তো জানা দূর অস্ত, এই কিছুদিন আগেই যে লোকটা ৫৬ ইঞ্চির বুক বাজিয়ে বলছিলো যে ওর কলমের খোঁচায় নাকি বড়লোকেরা, রাজনৈতিক নেতারা, কালোবাজারির কারবারিরা, ফোঁড়েরা সবাই মুশকিলে পড়েছে সেই লোকটাই ঘোমটা ঢেকে খ্যামটা নাচার মতন হঠাৎ সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর (সংসদীয় ব্যবস্থায় নথিভুক্ত) নিজেদের নগদ টাকা ব্যাঙ্কে বিনা প্রশ্নে জমা দেওয়ার স্বাধীনতা দিল।

রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধা হলো এই যে সব নগদ টাকাকেই এরা নির্বাচন কমিশনের দ্বারা নির্দ্ধারিত ₹২০,০০০ এর নিচের চাঁদা হিসেবে দেখিয়ে চাঁদা দাতার পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ পাবে। আর নগদের উৎস নিয়েও কর বাবুরা বা নির্বাচন কমিশন কোন উচ্চবাচ্য করবে না কারণ সেখানে নরেন্দ্রের কড়া নিষেধ রয়েছে।

নরেন্দ্রীয় সমীকরণের ৫০ দিন পূরণ হওয়ার আগেই অরুণ জেটলি বলে বসলো যে ৫০ দিনের সময় সীমার পরে ভারতের জনগণ ₹৫০০ আর ₹১০০০ এর নোট বাতিলের ফলে সৃষ্ট হওয়া “worst condition” বা চরম মন্দ অবস্থার থেকে বের হয়ে আসবে, যার সোজা মানে করলে দাঁড়ায় যে আমার আর আপনার মতন খেটে খাওয়া মানুষেরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকবে আর নগদের যোগান বাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।


এত সত্বেও বার বার উত্তর প্রদেশের নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদী আর বিজেপির তাবড় তাবড় নেতারা শুধু বলে যাচ্ছে যে বিজেপি নাকি গরিবের কল্যাণ করতে চলেছে। ৩১শে ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী যে ভাষণ দিল আর যে সমস্ত ঘুরিয়ে নাক ধরার মতন প্রকল্প ও গরিব কল্যাণের কথা ঘোষণা করলো তা যে কোন বাজেট ভাষণে কোন অর্থমন্ত্রী করলে খবরের কাগজের সাতের পাতার পাশের কলমে চার লাইনে ছাপা হতো।  

সরকারে আসার পর থেকে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার বারবার তেলের দাম বাড়িয়ে, রেলের ভাড়া ও মাশুল বাড়িয়ে, জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ ছাঁটাই করে, শ্রম আইন শিথিল করে, জমি অধিগ্রহনের গোপন পরিকল্পনা করে যে ভাবে প্রতিদিন গরিব হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়ে চলেছে তার সামনে এই গরিব ও নিম্নবিত্ত জনগণ কে ব্যাঙ্কের ঋণ ও সুদের নাগপাশে বেঁধে সুদে ছাড়  বা অনলাইন কেনা বেচার উপর কর ছাড় দেওয়া আসলে জনগণ কে বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্কের ফাঁদে ফেলার উপক্রম।

২০১৭ সালে দেশের অর্থনীতির উপর নোট বাতিলের ধাক্কার রেশ চলতেই থাকবে। যে ভাবে ৮৬ শতাংশ নগদ সরিয়ে নিয়ে প্রয়োজনের মাত্র ২৫ শতাংশ নগদ অর্থনীতিতে ঢালা হয়েছে, তার ফলে আগামী দিনগুলো খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে যে সুখকর হবে না সে কথা হলফ করে বলতে গেলে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিক্স থেকে ডক্টরেট করতে হয় না।

হয়তো নরেন্দ্র মোদী উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের সময়েও অনেক মানুষকে বোকা বানাতে পারবে, তবে বৃহৎ ব্যাঙ্কের স্বার্থে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত যে অচিরেই বিজেপি কে হুল ফোটাবে তা হয়তো সঙ্ঘ পরিবারের নেতৃত্ব বুঝতে পারছে আর তাই তারা নানা রকমের ছেলে ভোলানো পরিকল্পনার মারফৎ মানুষকে বাগে আনার চেষ্টা করছে। তবুও ক্ষিদের আঁচে বড় বড় সরকার কুপোকাৎ হয়েছে আর এই যুগের তুঘলক যে বেশিদিন সিংহাসনে বসে থাকতে পারবে না সে কথা রাজপথে দাঁড়িয়ে টাকার অপেক্ষায় থাকা মানুষের ক্ষোভ বলে দিচ্ছে।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে