পেঁয়াজের পেঁয়াজি ডালের তরকা - মূল্যবৃদ্ধির সংকট কাটানোর নেই কোনও সদিচ্ছা

সোমবার, আগস্ট ২৪, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

এই সকাল সকাল বৃষ্টির জল কাদা পেরিয়ে ছাতা মাথায় বাজার গিয়ে মাথায় বজ্রাঘাত হচ্ছে জিনিসের দাম শুনে। যেমন ধরুন সবচেয়ে বেশি কাঁদিয়ে চলেছে পেঁয়াজ যা এখন ৭০-৮০ টাকা কিলোর নিচে নামতে রাজি নয়, এ ছাড়াও বিভিন্ন তরি তরকারি যেমন ঝিঙে, উচ্ছে, বেগুন, করলা, বিন্স, বরবটি, ইত্যাদীর মধ্যে কোনও কিছুই ৪০-৫০ টাকার নিচে নাই। চালের বাজারে আগুন, কোনও ভালো চাল ৩৫টাকার নিচে নেই, আর একটু মোটা চাল কিনে যে সংসারের হাঁড়ি টানবো তারও জো নেই কারণ মোটা চালও এখন আর ২২-২৩ টাকার নিচে নাই। 

গরিবের ডাল ভাত আলুসিদ্ধ পেঁয়াজ ও লঙ্কা খাদ্য বলে জেনে এসেছি এবং শৈশব থেকে খেয়ে এসেছি। কিন্তু আজ তো বাজারে ১০০ টাকার নিচে কোনও ডাল নাই, শুনছি নাকি কিছুদিনের মধ্যে আমার প্রিয় মুসুরির ডাল ১৩০ এ পৌঁছবে। এর আগে একটা হিন্দি প্রবাদ শুনেছিলাম "ঘর কি মুরগি ডাল বরাবর !", এবার দেখি এই প্রবাদ বাজারে সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। কারণ আর কিছুটা বাড়লেই ডাল আর মুরগির দামে কোনও ফারাক থাকবে না। কর্পোরেট সংস্থাগুলির মালিকানাধীন বাজারী সংবাদপত্রগুলি বলছে খরিফ শস্য উত্পাদন প্রাকৃতিক কারণে হ্রাস পাওয়ায় এবার এই পেঁয়াজের সংকট। টিভি চ্যানেলগুলিতে চলছে বিশেষজ্ঞদের চুল চেরা বিশ্লেষন এবং যারা করছে বলে দেখছি, মনে হয় না তাঁরা জীবনে কোনদিন ক্ষেতে নেমেছেন বা শস্য চাষ হওয়ার থেকে বাজারজাত হতে দেখেছেন। বারবার তাঁরা বলছেন সরকার যেন বেশি বেশি করে খাদ্য শস্য দেশে আমদানি করে যোগান বৃদ্ধি করে, এবং একমাত্র আমদানি করার পথেই মূল্যবৃদ্ধির সমস্যার সমাধান হবে বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। 

খাদ্য শস্যের যে পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে তার কারণ সর্বত্র অনাবৃষ্টির দরুণ খরিফ শস্যের কম উত্পাদন নয়। এটা সঠিক যে সাধারণ ভাবে দেখতে গেলে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির প্রচলনে দেশের মধ্যে তীব্র ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে নগরপত্তনের কাজ এবং এই সুযোগে রিয়েল এস্টেট শিল্পের বারবৃদ্ধির কথা সাধারণ মানুষের অজানা নয়। ক্রমাগত জমি অধিগ্রহণ করতে করতে আমাদের দেশের শহর ও মফত্সল পার হয়ে এখন রিয়েল এস্টেট হাঙ্গররা গত ১৫ বছর ধরে হানা দিচ্ছে গ্রামাঞ্চলের উর্বর ক্ষেতগুলির দিকে, একের পর এক গ্রামকে গ্রাস করে, বহু ফসলি জমি দখল করে চলছে উপনগরী গড়ার কাজ, যেখানে ক্ষেত থেকে উত্খাত হওয়া গরিব ও ভূমিহীন কৃষকদের আজ দিন মজুরি করে পেট চালাতে হয়। এই ক্রমবর্ধমান জমি অধিগ্রহণে দেশের কৃষি উত্পাদনে এক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, যার ফলে কৃষি উত্পাদন দেশের জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় কমছে।  কিন্তু এই রিয়েল এস্টেট এর আগ্রাসন কে রোধ করার কোনও প্রচেষ্টা কোনও সংসদীয় রাজনৈতিক দল করবে না, এর বিরুদ্ধে কোনও দেশজোড়া আন্দোলন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি করবে না, তার কারণ এই রিয়েল এস্টেট ব্যবসার থেকে এক বিশাল কাট মানি এই রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে জমা হয়, ভোট যুদ্ধে এই সব প্রমোটার ও তাদের বাহিনী রাজনৈতিক দলগুলির জন্যে বেগার খেটেও দেয়।  তাই তো আজ দেশের কৃষকদের তীব্র প্রতিবাদ সত্তেও মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার কৃষক ও কৃষি বিরোধী জমি অধিগ্রহন আইন কে জোর করে বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টায় রত। 

কৃষি জমি অধিগ্রহন ছাড়াও খাদ্যশস্যের চূড়ান্ত রকমের উর্দ্ধগামী মূল্যবৃদ্ধির পিছনে রয়েছে আরও অনেকগুলি কারণ যার মধ্যে ভারতের সাম্প্রতিক সরকারগুলির বিগত ১৫ বছর ধরে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি প্রয়োগের প্রচেষ্টার ফলগুলিই মূল।  যেমন খাদ্যশস্য সুষম বন্টন করার জন্যে যে গণবন্টন ব্যবস্থা স্বাধীনতাউত্তর ভারতে গড়ে ওঠে, সেই রেশন ব্যবস্থাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে সমস্ত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলি ধ্বংস করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর হোতা হল বাজপায়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার, যারা নির্লজ্জ ভাবে রেশন ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার জন্যে ওকালতি করে, অন্তোদয় যোজনার নামে শুধু বিপিএল গ্রাহকদের জন্যে চাল ও গম বন্টন রেখে রেশন ব্যবস্থা থেকে বেশির ভাগ পণ্য কে সরিয়ে নেওয়া হয় এক আশ্চর্য কারচুপি করে।  যদিও প্রকৃত ভাবে দরিদ্র সীমার নিচে বাস করা মানুষেরা এই সব প্রকল্পের সুফল আমলাতন্ত্রের মহিমায় খুবই কম উপভোগ করতে পেরেছেন। 

কর্পোরেট সংস্থাগুলির মালিকানাধীন বাজারী সংবাদ মাধ্যমগুলিতে বাজপায়ী শাসনকাল থেকে খাদ্য দ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলি, তেল, গ্যাস ইত্যাদীর থেকে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার ওকালতি শুরু করে দেশের ধনিক শ্রেণী।এর সাথে যুক্ত হয় খুচরো বিপণন ব্যবস্থায় বৃহত একচেটিয়া পুঁজির বিনিয়োগ, যার ফলে গড়ে ওঠে একের পর এক শপিং মল ও তার মধ্যে বিগ বাজার - রিলায়েন্স ফ্রেশ এর মতন খুচরো বিপননের দোকান। যেখানে শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের দৈনিক আনাগোনা বেড়েই চলে।  রেশন ব্যবস্থায় খাদ্য শস্য অমিল হওয়ার সাথে সাথে বাজপায়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার খুলে দেয় ফিউচার ট্রেডিং এর দরজা, যার মাধ্যমে দালাল পুঁজিপতি - জোতদার জমিদারদের যোগ সাজেশে খাদ্য শস্য ও শাঁক সবজির উপর ব্যাপক হারে ফাটকা খেলা শুরু হয়।  আলু, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে সোয়াবিন, রান্নার তেল, মশলাপাতির উপর চলতে থাকে ফাটকা খেলা। ব্যাপক হারে বেড়ে চলে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, খাদ্যদ্রব্য মজুতদারী। যাতে বৃদ্ধি পায় কৃত্রিম সংকট এবং সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কৃষি জাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটায় ফাটকাবাজরা।  সরকারী সহায়তায় এইরূপ কালোবাজারী ভারতের ইতিহাসে বিরল।  

চাষের কাজে যুক্ত কৃষকদের সঙ্গে এই একই সময়ে শুরু হয় এক নির্মম রসিকতা। সরকারী ভাবে শস্য কেনার কাজে নিযুক্ত আমলারা চিরকালই জোতদার - জমিদার - ধনী কৃষকদের থেকে ঘুষ খেয়ে সরকারী ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের বেশি দিয়ে যখন একদিকে তাদের শস্য গুদামজাত করে, অন্যদিকে সেই একই সময়ে গরিব ও মধ্য কৃষকদের সারা দেশেই ন্যুনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রি করতে জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে যায়। একদিকে যেমন নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির ফলে কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে চরম হারে, সারের উপর ইচ্ছাকৃত ভাবে ভর্তুকি হ্রাসের ফলে দাম বেড়েছে বহুগুন, এবং সর্বপরি ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুত সংকট ও হিমঘরের ভাড়া বৃদ্ধির কারণে চাষের বিনিয়োগের খরচা যেমন বেড়েছে, তেমনি সরকারী কৃষি ঋণ অমিল হওয়ার কারণে মহাজনেদের চড়া সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবসারও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে।  

এর ফলে কৃষকরা পরেছেন এক দানবীয় জাঁতাকলে। একদিকে তাঁদের কৃষিতে নিবেশ যেমন বেড়ে গেছে অন্যদিকে উত্পাদিত শস্যের সঠিক মূল্য না পাওয়ায় ও সঠিক ভাবে কম পয়সায় তার সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় কৃষকদের প্রায়ই সস্তায়, নামমাত্র মূল্যে, কৃষি পণ্য ফোঁড়েদের বিক্রি করে দিতে হয়। এই ফোঁড়েদের দলের এক বিরাট জাল সারা দেশব্যাপী ছড়ানো। আজ যে সিন্ডিকেট ও কার্টেলের কথা রিয়েল এস্টেট শিল্পে বাংলার মানুষ শুনছেন, তার এক আদি ও শক্তিশালী রূপ যে কৃষিজাত পণ্য বিপণনে বহু বত্সর ধরে বর্তমান সে কথা অনেক শহুরে মধ্যবিত্ত জানে না।  এই সিন্ডিকেটের সাথে ওতপ্রত ভাবে জড়িত আছে খাদ্য শস্যের ফাটকা ব্যবসা। তাই কৃষকের থেকে সস্তায় কুইন্টাল - কুইন্টাল মাল তোলার পরেই তা চলে যায় কালোবাজারী আর মজুতদারদের আড়তে।  যেখান থেকে মাল পাইকারী বাজারে যায় কৃত্রিম যোগানের সঙ্কট সৃষ্টি করার পর। এবং পাইকারী ব্যবসায়ীদের এই খাদ্যশস্য অনেক চড়া দামে কিনতে হয় এবং তাদের থেকে কিনে যখন খুচরো ব্যবসায়ীরা এই পণ্য সাধারণ মানুষের কাছে বেচেন তখন এর দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে যায়। 

এই সম্পুর্ন খাদ্য সংকট থেকে বের হওয়ার রাস্তা নেই তা নয়। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই তা সম্ভব হত। দরকার শুধু কড়া হাতে মজুতদারী দমন করা, কালোবাজারীদের গ্রেপ্তার করা (এক কালে খাঁটি গান্ধীবাদী বলে প্রখ্যাত জহরলাল নেহেরু আহ্বান দিয়েছিল কালোবাজারীদের ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে মারতে) ও শাস্তি দেওয়া, অবিলম্বে খাদ্য শস্যের উপর ফাটকাবাজির ব্যবসা বন্ধ করা - ফিউচার ট্রেডিং কে নিষিদ্ধ করা, রিয়েল এস্টেট ও অন্যান্য ব্যাবসার দ্বারা কৃষি জমি অধিগ্রহণ বন্ধ করানো, কৃষকের কাছে সল্প সুদে সরকারী কৃষি ঋণ পৌঁছে দেওয়া এবং সরকারী গণ বন্টন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে রেশনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে সুলভে খাদ্য দ্রব্য পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের মূল্যবৃদ্ধির উপর লাগাম পরানো সম্ভব। কিন্তু এই সদিচ্ছার অভাবে ভারতের কোনও কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারগুলি এই সংকটের থেকে মানুষ কে পরিত্রাণ দিতে কোনও রকম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়নি। কারণ এই সব বড় বড় পুঁজিপতি - ফাটকাবাজ - মজুতদার - কালোবাজারীদের চাঁদায় নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া যায়। দেশের সমস্ত দক্ষিণপন্থী দলের মাথায় আছে আড়তদার - জোতদারদের প্রতিনিধিরা, যারা কোনো ভাবেই তাদের শ্রেনীর স্বার্থ বিঘ্নিত হতে দেবে না।  
                           
তাই একদিকে যেমন এই ব্যবস্থায় কৃষক মার খাচ্ছে, যাদের কম দামে শস্য বেচে দিতে হচ্ছে চাপে পড়ে, এবং মহাজনের সুদের -আসলের চাপে অনেক কৃষক সারা দেশে আত্মহত্যা করছেন, তেমনি সাধারণ মানুষদের আজ পড়তে হচ্ছে গভীর অর্থনৈতিক সংকটে, তাঁদের সীমিত আয়ের মধ্যে বাড়ির সবার পেট ভরানো আজ বিশাল দায় হয়ে উঠছে। শ্রমিক - কৃষক - মেহনতি মানুষদের নেতৃত্বে পরিচালিত গত শতাব্দীর খাদ্য আন্দোলনে একদিন যেমন দমদম দাওয়াই দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি কে ঠেকানো হয়েছিল, আজ তেমনি সরকারী উদাসীনতায় ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে বেড়ে চলা কালোবাজারী ও ফাটকাবাজি রোধ করতে দরকার দেশব্যাপী সেইরকম এক জঙ্গি গণ আন্দোলন। কারণ একমাত্র গণ সংগ্রামেই ভীত হয় এই কালোবাজারী-মজুতদারী-জোতদারি চক্র এবং এই আন্দোলনের মাধ্যমেই ভাঙ্গা সম্ভব এদের পেঁয়াজ নিয়ে পেঁয়াজি আর ডালে মূল্যবৃদ্ধির তরকা মারার ষড়যন্ত্রগুলি।      

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে