বীরভূমের কাহিনী - গণতন্ত্র'র স্বরূপের নমুনা

শুক্রবার, আগস্ট ২১, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

গণতন্ত্রের ধ্বজ্জাধারী তৃণমূল ও বিজেপির চোখ এখন বীরভুম জেলায় আবদ্ধ। সেখানে চলছে এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের এক প্রধান কর্মযজ্ঞ, দল বদলের খেলা। জামা পাল্টাবার মতন করে সমস্ত মাথারা হঠাত দল ত্যাগ করতে শুরু করলো এবং এখানে এগিয়ে চলেছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের গোলের সংখ্যা বেশি কারণ ফরওয়ার্ড পজিশনে ফুর্তিতে খেলছে অনুব্রত ওরফে দিদির কেষ্ট।  

বীরভুম দখল করার তাগিদ বেশি কারণ এই জেলায় বিজেপি দাঁত ফুটিয়েছিল এবং আশ্চর্যজনক ভাবে মুসলমানদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তুলে।  মুসলমানদের পরিত্রাতা হিসাবে নিজেদের দাবি করা তৃণমূলের পক্ষে এই ঘটনা তীব্র যন্ত্রনাদায়ক ছিল। তাই বীরভুম কে দখল করার জন্যে জরুরি হল সংগ্রাম, মানে এলাকা দখলের জন্যে ভ্রাতৃঘাতী  দাঙ্গা।  এর পর চললো গুলি আর পেটোর খেলা, যা ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থার বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। 

হৃদয় ঘোষের হৃদয় পরিবর্তন হয়েছে সম্প্রতি। সাগর ঘোষের হত্যার কেস তুলে দিয়ে সে এখন মমতা বাড়ুজ্যের মমতা ও করুণার আঁচলের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে কেষ্টের সহায়তায়। কেষ্ট আবার দিদির নির্দেশে মাথা গরম না করে, আইন কানুন কে শ্রদ্ধা করে বুকে টেনে নিয়েছে তার বিচ্ছিন হৃদয়কে, যে এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত কেষ্টকে তার বাবার খুনি বলে গাল পাড়ছিল। বীরভূম জুড়ে বীর কেষ্টের জয় জয়কার শুরু হয়েছে, রাম ভক্ত হনুমানদের দলে ফাটল ধরেছে, দুধকুমার লেঙ্গি মেরে খাল টপকে ও পাড়ে, বাকি ঠেলে ঠুলে যারা গেরুয়া ঝান্ডা তুলে রেখেছে তাদের এখন ভয়ানক কৌষ্ট কাঠিন্যের দৌলতে ভুগতে হচ্ছে।  এক এক করে সব তালপাতার সেপাই শিবির ত্যাগ করে দিদির নীড়ে আশ্রয় নিচ্ছে কিছু ভালো খাওয়া পড়া জোটার আশায়।  সবাই আশা করে রেখেছে যে পারুইয়ের সেই গৃহবধুও এবার দিদির কাছে ছুটবেন এবং পুলিশের বিরুদ্ধে করা অভিযোগকে সিপিএমের বিরুদ্ধে বদলে দেবেন, ঠিক যেমন হৃদয় ঘোষ নিজের পিতার হত্যায় অভিযুক্ত অনুব্রতর পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেওয়ার পর হঠাত আবিষ্কার করে যে তার বাবার মৃত্যুর জন্যে দায়ি একমাত্র সিপিএম।

বীরভুম এমন এক রণাঙ্গন, যেখানে একদিকে দিদির ভক্ত বাহিনী, যার সেনাপতি খোদ কেষ্ট, অন্যদিকে ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দারের পঙ্গপাল বাহিনী। দুইয়ের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলেও যে তা হাস্যকর হবে সে কথা আজ বীরভূমের শিশুরাও স্পস্ট করে বুঝিয়ে দিতে পারবে। তাই গেরুয়া শিবিরের 'আচ্ছে দিন' এর সূর্যাস্ত  হয়ে গেছে বীরভূমের মাটিতে, সেথায় শুধু কেষ্টের জয়জয়কার। বীরভুম থেকে হাওয়া বদলের স্বপ্ন চূর্ণ হয়েছে গৈরিক বাহিনীর, এখন তারা যেন তেন প্রকারে মুখ রক্ষার প্রয়াসে ব্যস্ত।

বীরভুম এর সাম্প্রতিক তৃণমূল - বিজেপির সশস্ত্র সংঘাত আমাদের পশ্চিম বাংলার কেশপুরের ২০০০ সালের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। যেখানে এলাকা দখলের কোন্দলে ব্যস্ত সিপিএম ও তৃণমূল তাদের সংসদীয় গণতান্ত্রিক পথের পাঁচালি পড়া ছেড়ে নেমে এসেছিল খোলা খুলি মাস্কেট আর ওয়ান শাটার এর লড়াইয়ের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি কায়েম করতে।  আজ সংসদীয় গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে বিজেপি ও তৃণমূলের মতন দুই অতি দক্ষিনপন্থী দলগুলিও সেই সশস্ত্র সংগ্রাম কেই ক্ষমতা দখলের এক মাত্র পথ বলে গন্য করলো।  ভাবতে অবাক লাগে যে কমিউনিস্টদের একটি অংশের সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের রাজনীতি কে এরা এই বলে ভার্ত্সনা করে যে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে হিংসার কোনও স্থান নাই।  কিন্তু এদের কার্যকলাপ কি আমাদের মতন সাধারণ মানুষকে ভগবান বুদ্ধদেবের কথা মনে করায়? এই বিজেপির নেতারা কি স্বীকার করেনি যে তৃণমূলের আক্রমণ প্রতিহত করতে বীরভূমে এদেরও সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। আজ হঠাত রুপা গাঙ্গুলিকে কেন দুধ কুমার কে বাসায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে সোচ্চার হতে হচ্ছে ? তার কারণ বিজেপির অন্দরে এই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়েছে যে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বীরভূমে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে জমি দখল করতে গেলে ওই রকম পোড় খাওয়া সংঘ নেতাদের দরকার যারা হিন্দু মুসলমানে, বা হিন্দুতে হিন্দুতে, বা মুসলমানে মুসলমানে দাঙ্গা বাঁধাতে ওস্তাদ। 

আজ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দক্ষিনপন্থী ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলির, যারা একদিকে হিন্দু ফ্যাসিবাদ আর অন্যদিকে মুসলিম মৌলবাদ কে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে, তাদের এই উথ্বান দেখে গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ আজ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু একটু পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে যে এদের এই উথ্বানের কারণ হল ৩৪ বছর ধরে মেকি 'বামেদের' অপশাসন। যা এই রাজ্য থেকে ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধ বিশ্বাস, ও ভ্রাতৃঘাতী হিংসার রাজনীতিকে নির্মূল করার কোনও প্রচেষ্টা তো করেইনি, বরং এই সমস্ত কাজে বেশি বেশি করে ইন্ধন দিয়ে গেছে খিড়কির দরজা দিয়ে। জন সমক্ষে যখন জ্যোতি বোস - বুদ্ধদেবরা বড় গলায় মানুষের চেতনা বৃদ্ধি হওয়ার দাবি করছিল, ঠিক তখনই অন্যদিকে পাড়ায় পাড়ায় শনি পুজো থেকে নানা গুরুদেবের ভজনা বৃদ্ধি পেল, বটতলায় সিঁদুর মাখানো পাথরে মানুষের মাথা ঠোকা বাড়লো, জুম্মাবারের নামাজে নামাজিদের সংখ্যা বাড়লো, পীরের দরগায় গিয়ে মাথা ঠোকা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক বিভেদ রেখা আরও স্পস্ট হয়ে উঠলো।  যে বামপন্থীদের কাজ ছিল মানুষের চেতনা বৃদ্ধি করা, তাদের প্রগতিশীল চিন্তাধারায় সমৃদ্ধ করে তোলা, রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত করে তোলা, তারা শুধু প্রোমোটার আর জোতদারদের সাথে রফা করে চলে গুন্ডা বদমাইশদের সাহায্যে দল ভারী করেছিল আর রিগিং করে জেতার জন্যে এক বিরাট 'সম্পদ' বাহিনী গড়ে তুলেছিল। তাদের ৩৪ বছরের রাজনৈতিক শাসনে তারা পশ্চিমবাংলার খেটে খাওয়া মানুষদের, শ্রমিক ও কৃষকদের, মেহনতী মধ্যবিত্ত ও ছাত্র - যুবদের শুধুই প্রতিক্রিয়ার শিবিরের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। 

এই অবস্থায় আজ পশ্চিম বাংলার মসনদে যে দলই আসীন হোক, তার পক্ষে হিংসা - বিদ্বেষ - সন্ত্রাস না ছড়িয়ে কোনও ভাবে রাজ্য শাসন করা সম্ভব না। পেটো আর ওয়ান শাটার - মাস্কেট - ৯ মিমি পিস্তল দিয়েই এই রাজ্যের মসনদে আসা যায় ও টিকে থাকা যায় এই সত্যটি আজ শিশু মাত্র বোঝে। বীরভুম তার থেকে আলাদা নয়। হয় কেষ্ট নয় দুধকুমার এই দুইয়ের মধ্যে যে এই জেলায় নিজ দলের প্রতিপত্তি বজায় রাখতে চাইবে তাকেই এখানে পেটোর শাসন কায়েম করতে হবে। রাজনীতির মঞ্চে দাড়িয়ে মমতা - রাহুল - অধীর - বুদ্ধ সবাই এক যোগে হিংসার রাজনীতির বিরোধিতা করবে, একযোগে বলবে তারা সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে বিশ্বাস করে, আর রাত পোহালেই রাস্তায় গুলিবিদ্ধ লাশ পরে থাকবে সেই সংসদীয় দলের পদাতিক বাহিনীর এবং দোষ হবে বিরোধী সংসদীয় দলের।  

বাম জমানার হুগলি - মেদিনীপুর - ২৪ পরগণার জায়গায় আজ তৃণমূল যুগের বীরভুম, এই রাজ্যের পট পরিবর্তনের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রের রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং এই খুন - পাল্টা খুন, বাড়ি জ্বালানো, ধর্ষণ, হিংসার মাধ্যমেই আমরা শুনবো যে ভবিষ্যতে এক উন্নত রাজ্যে আমরা নাকি পৌঁছাবো, আমাদের রাজ্যে নাকি উন্নয়নের ধারা বয়ে যাবে এবং লক্ষ লক্ষ ছেলে - মেয়েরা যারা বাইরে পেটের টানে গেছেন তাঁরা সব বাড়ি ফিরে আসবেন কারণ কর্মসংস্থান নাকি এখানেই হবে। তাই পেটো ফাটবে, দানা চলবে, আর গণতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রার মধ্যে দিয়ে বাঙালি দুয়ারে বসে থাকবে 'আচ্ছে দিনের' অপেক্ষায়। 

    

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে