মাতৃভূমি তুমি কার ?

শুক্রবার, আগস্ট ২১, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

শিয়ালদহ উত্তর ডিভিশনের বনগাঁও ও মেইন লাইনে মাতৃভূমি লোকাল ট্রেনের তিনটি কামরায় পুরুষ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে মহিলা ও পুরুষ যাত্রীরা দফায় দফায় ১৯ অগাস্ট বুধবার ট্রেন অবরোধ করেন বামুনগাছি - নিউ ব্যারাকপুর - বিরাটি ইত্যাদী স্টেশনে। ছোড়া হয় ইঁট পাটকেল, পুলিশ এসে লাঠি চালায় এবং অনেক যাত্রী আহত হন, যার মধ্যে কল্যানী দত্ত নামক এক মহিলা যাত্রীর মাথা ফেটে যায় পুরুষ যাত্রীদের ছোড়া পাথরের আঘাতে। 

এই ঘটনার পর তীব্র বিতর্ক শুরু হয় মাতৃভূমি লোকাল নিয়ে যা পরবর্তিতে পৌঁছে যায় পুরুষ বনাম মহিলাদের নিয়ে বিতর্কে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভারত, যেখানে আজও আধা সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন সম্পর্ক উপস্থিত এবং মানুষের চেতনার মান পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে, সেই দেশে পুরুষদের মধ্যে নারী বিদ্বেষ যে চরমে থাকবে সে কথা যে কেউ হলফ করে বলতে পারবে, এবং এর সাথে যুক্ত হয় পুরুষ শ্রেষ্ঠ হওয়ার ধর্মীয় চেতনা যা পুরুষদের নারী কে শুধু মাত্র একটি যৌন সুখ দায়ক যন্ত্র এবং সন্তান উত্পাদনের যন্ত্র হিসেবে গন্য করতে শেখায় তাদের ছেলেবেলার থেকে। তাই এই দেশে নারীদের জন্যে একটি স্পেশাল ট্রেন অবশ্যই পুরুষদের চোখ কপালে সিটকে তোলে, এবং তাদের বিদ্বেষ বৃদ্ধি করায়।  

যে কোনো শুভ চেতনা সম্পন্ন মানুষ নিশ্চয় বাসে - ট্রামে - ট্রেনে - মেট্রোয় যাত্রা করার সময়ে বা আপিসের টিফিন টাইমে এই রকম আলোচনা শুনেই থেকেছেন, যেখানে একদল পুরুষ এর মধ্যে নারীদের বেশি স্বাধীন হওয়া নিয়ে খেদ প্রকাশ বা তাঁদের জন্যে কোনও সরকারী প্রকল্প নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ পায়, কিংবা চলে আসে বিকৃত যৌন আবেদনে ভরা কটুক্তি। ঠিক তেমনি মাতৃভূমি লোকাল নিয়ে মহিলাদের আন্দোলন কে ঘিরে তৈরি হলো দুই বিপরীত মত, একদিকে নারীদের পক্ষে নারী সমাজ ও প্রগতিশীল পুরুষ সমাজ এবং অন্যদিকে পুরুষদের পক্ষে প্রতিক্রিয়াশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধিরা। বিক্ষোভ ও অবরোধে সামিল খেটে খাওয়া মহিলাদের উপর এই পুরুষতন্ত্রের গান গাওয়া বীর পুঙ্গবরা শুধু মাত্র পাথর দিয়ে আক্রমণ করলো তাই নয়, নিজেদের সামাজিক - রাজনৈতিক প্রতিপত্তি কায়েম করতে তারা ট্রেনের মহিলা কামরায় ঢুকে শুরু করলো মহিলা যাত্রীদের যৌন হেনস্থা। কোনো মহিলা যাত্রীর ওরনা টেনে বা কারুর গায়ে হাত দিয়ে, বা কারুর শ্লীলতাহানি করে এরা প্রমাণ করার চেষ্টা করলো যে পুরুষ জাত শ্রেষ্ঠ।     

এই সমস্ত অত্যাচার লুণ্ঠনের সময়ে মহিলাদের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা, সাধারণ মানুষের করের টাকায় বেতন প্রাপ্ত রেল ও সাধারণ পুলিশ ত্রিসীমানায় ছিল না, এবং তারা এসেও মহিলাদের সম্মান রক্ষার্থে কোনও পদক্ষেপ তো করলোই না বরং বিক্ষোভরত নারীদের উপর লাঠি চালিয়ে এবার নিজেদের বীরপুঙ্গব সাজার অভিলাষ পূর্ণ করার প্রচেষ্টায় মজে উঠলো। মহিলাদের চোখের সামনে স্পস্ট হয়ে উঠলো যে এই রাষ্ট্র মহিলাদের স্বাধীন হতে দেবে না, সে মহিলাদের পুরুষের শাসনের অধীনে রাখার এবং গন্ডিবদ্ধ জীবন কাটাবার জন্যে বাধ্য করবে।  
    

মাতৃভূমি লোকাল মমতা ব্যানার্জির রেল মন্ত্রী থাকাকালীন শুরু হওয়া এক মহিলা স্পেশাল ট্রেন যা নানা রাজ্যের শহরতলির থেকে শহরে কার্য ক্ষেত্রে আসা মহিলাদের জন্যে এক সুবিধাজনক পরিবহণ মাধ্যম, কারণ সাধারণ ইএমইউ ও মেমু ট্রেনে মাত্র দুইটি কম্পার্টমেন্ট মহিলাদের জন্যে হওয়ায় তাঁদের প্রচন্ড কষ্ট করে সেই কামরাগুলিতে যেতে হয় আর নয়তো সাধারণ কামরায় পুরুষদের ভিড়ে পিষ্ট হয়ে যেতে হয়, যে সুযোগে তাঁদের সাথে নানাবিধ দুষ্কর্ম বা যৌন উত্পীড়ন করে কিছু সংখ্যার বিকৃত মানসিকতার পুরুষ যাত্রীরা। তাই মাতৃভূমি লোকাল ট্রেন হওয়ায় অসংখ্য মহিলা উপকৃত হয়েছিলেন এবং তাঁরা এই  ট্রেনে নিরুদ্বেগ হয়ে  যাতায়ত করতে পারতেন।  কিন্তু হঠাত হওয়া রেলের এই সিদ্ধান্তে তাঁদের উপর আবার নেমে আসছে সেই কষ্টকর যাতায়তের খাঁড়া।  কারণ নয়টি কামরার মধ্যে যদি তিনটি কামরা পুরুষদের জন্যে করে দেওয়া হয় তাহলে ছয়টি কামরায় তাঁদের পক্ষে আবার যাতায়ত করা মুশকিল হয়ে যাবে।  এর ফলে মহিলা যাত্রীরা আন্দোলন শুরু করেন রেলের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে এবং তাঁরা দাবি করেন যে একান্তই যদি রেল কোম্পানি এই নির্দেশ লাগু করতে চায় তাহলে মাতৃভূমি লোকালের কোচের সংখ্যা বারো করে দেওয়া হোক, যাতে অফিস টাইমে পুরুষ ও মহিলা সব যাত্রীরাই একটু স্বাচ্ছন্দে যাতায়ত করতে পারেন।  মহিলা যাত্রীদের এই ন্যায্য দাবিটি পর্যন্ত রেল কোম্পানি নাকচ করে দেয় এই বলে যে সমস্ত স্টেশনে বারো কোচের অনুসারে লম্বা প্ল্যাটফর্ম নেই, অতএব মাতৃভূমি লোকাল কে কোনও ভাবেই বারো কোচের করা চলবে না। 

প্রশ্ন হলো শিয়ালদহ উত্তর ডিভিশনে কি  বারো কোচের ট্রেন চলে না একান্তই ? নিত্য যাত্রীরা কিন্তু মেইন লাইন ও বনগাঁও - বারাসাত লাইনে বারো কোচের ট্রেন নিয়মিত একটা দুটো দেখে থাকেন, যা আশ্চর্যজনক ভাবে অফিস টাইমে কম চলে এবং খালি সময়ে বেশি চলতে দেখা যায়, এবং রেকে কোচের সংখ্যা বৃদ্ধি করে মাতৃভূমি লোকাল কে বারো কোচের করে তুলতে রেল কোম্পানির বিশেষ অসুবিধার কিছু চোখে পরে না, কারণ কয়েকটি মাত্র ট্রেনের জন্যে বাড়তি কিছু কোচ তো তাদের রোলিং স্টকে না পাওয়ার জিনিস নয়।  তবু যখন রেল কোম্পানি এই নিয়ে নাছোরবান্দা, তখন সন্দেহ হয় এই নির্দেশের রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে। 

বর্তমানে রেল কোম্পানি বিজেপি পার্টির সুরেশ প্রভুর অন্তর্গত এবং স্বাভাবিক ভাবে বিজেপি এই কোম্পানির মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়াবার সুযোগ খুঁজবে। বিজেপি হল আরএসএস এর গণসংগঠন এবং এর কাজ হলো বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ কে ভারতের মাটিতে রক্ষা করার স্বার্থে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের সাহায্যে ব্রাক্ষণ ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলা, সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলি, যেমন মুসলমান - খ্রিস্টান প্রভৃতিকে ভীত সন্ত্রস্ত করা, এবং শোষিত জাতি ও আদিবাসীদের উপর অত্যাচারের মাত্রা তীব্র করা।  এর সাথে সাথে বিজেপি চরম ভাবে আরএসএস এর নারী বিদ্বেষী ও পুরুষতান্ত্রিক হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা কে সমর্থন করে। তারা দেশের সর্ব প্রান্তে যেমন একদিকে ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এক বিশাল বিভেদ আনতে পেরেছে তেমনি তারা এবার ভারতের পুরুষ সমাজকে পুরুষতন্ত্রের বিষাক্ত চিন্তাধারা দিয়ে উত্তেজিত করে নারীদের উপর নিজ কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করছে। সম্প্রতি বিজেপির সাধু সন্ত নেতারা হিন্দু মহিলাদের মুসলমানদের পরাস্ত করতে দশটি করে বাচ্চা প্রসব করার ডাক দেয়। এই দশ বাচ্চার তত্ব হয়তো বিজেপির পক্ষে উত্তর ভারতের গো বলয়ের গ্রামে গ্রামে উচ্চ হিন্দু জাতিগুলিকে প্রভাবিত করে করা সম্ভব কিন্তু শহর ও শহরতলীতে বসবাসকারী মহিলারা এই দাবি কোনও দিন মানতে চাইবেন না। কারণ চাকরিরত বা ব্যবসায়ী নারীরা সর্বদাই চেষ্টা করেন তাঁরা সমাজে পুরুষের সমান মর্যাদা পান, যা তাঁদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দিতে চায় না।  তাই এই মহিলাদের বাগে আনতে গেলে পুরুষদের উত্তপ্ত করা দরকার ব্রাক্ষণ ফ্যাসিবাদী চিন্তায় এবং মহিলাদের বিরুদ্ধে তাদের লেলিয়ে দেওয়া জরুরী। 

তাই রেল কোম্পানির এই সিদ্ধান্ত, তার ফলে ঘটে চলা একের পর এক বিক্ষোভ অবরোধ কে ঘিরে মহিলাদের উপর অত্যাচার যে কোনও কারণ ছাড়াই হচ্ছে এই কথা বিশ্বাস করা কঠিন। হয়তো নিরপেক্ষ তদন্ত হলে স্পস্ট হতো যে যারা মহিলাদের উপর আক্রমণের হোতা  তারা হয় বিজেপি বা তৃণমূলের আড়ে লুকিয়ে থাকা আরএসএস এর জঙ্গি সমর্থক। অথবা তাদের হয়তো ইচ্ছে করেই পয়সা দিয়ে ঝামেলা করতে পাঠিয়েছিল সেই সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি যারা এই দেশে যেনতেন প্রকারে ব্রাক্ষণ ফ্যাসিবাদ কে শক্তিশালী করে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির কারবারকে আরও মজবুত করে দেওয়ার তাগিদে চলছে। হয়তো এই কারণেই যখন মহিলাদের উপর পাথর ছোড়া হচ্ছে বা তাঁদের শ্লীলতাহানি করছে একদল লম্পট লুম্পেন, সেই সময় রাষ্ট্রের বাহিনীর সন্দেহজনক অনুপস্থিতি।  

সমাজের শুভ চেতনাসম্পন্ন পুরুষ ও মহিলাদের আজ এটা উপলব্ধি করা দরকার যে ভারতীয় সমাজের পরিপ্রক্ষিত অনুসারে নারী এ দেশে পরাধীন ও শোষিত। তাঁর স্থান এই সমাজের রীতি -নীতির হিসেবে শুধু মাত্র একটি যৌন দাসীর এবং তাঁর সমগ্র জীবন অন্যের গোলামী করে কাটে।  তাই নারী স্বার্থ কে রক্ষা করা এই দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মানুষের কর্তব্য। যে কোনও ঘটনা যা নারীকে আক্রমণ করে, তাঁর সম্মান হানি করায় বা তাঁর উদ্দ্যেশে এমন কটুক্তি করায় যা তাঁর মর্যাদাকে আঘাত করে, তা অন্যায়, এবং তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের রাস্তায় চলা আজ আমাদের জরুরী কর্তব্য।  

মাতৃভূমি লোকাল নিয়ে রেলে হিংসার ঘটনা আমাদের চোখের সামনে তুলে আনলো যে নারী এই সমাজে কি ভাবে নিজ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং পদে পদে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্ষকদের হাতে আক্রান্ত হয়। 
মাতৃভূমি কার ? সে কি নারীর না পুরুষের ? সে কি আমার না তোমার ? মাতৃভূমি তো মা থেকেই এসেছে, যে মা নারীত্বের প্রতীক। সেই মা কে যে অসম্মান করে সে কি কোনও ভাবে সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য ? তাই আজ সোচ্চার হয়ে বলিষ্ঠ ভাবে ঘোষণা করতে হবে যে এই মাতৃভূমি, যা প্রজনন করে জীবন কে, তা নারীর একান্ত আপন।  সে ভাগ করে নেয় পুরুষের সাথে তাঁর আকাশ এবং ওই অর্ধেক আকাশের অধিকারিনী হয়ে তাঁকে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে দিতে হবে, তাঁর উপর পুরুষের আধিপত্য কে ধ্বংস করতে হবে, তাঁর মুক্তির জন্যে চলমান সংগ্রামে তাঁকে সব রকম ভাবে সহযোগিতা করতে হবে। কারণ যতদিন নারী স্বাধীন হবে না ততদিন সমাজ মুক্ত হবে না। 



         

         

     

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে