প্রেসিডেন্সির ছাত্রদের সংগ্রামে ভীত আনন্দবাজার থেকে রাজ্যপাল

বৃহস্পতিবার, আগস্ট ২৭, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

গত কয়েকদিন ধরে কর্পোরেট সংস্থার মালিকানাধীন সমস্ত বাজারী কাগজগুলো প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের বিক্ষোভ আন্দোলনকে সমালোচনা করে পাতার পর পাতা নষ্ট করে চলেছে। আজ বাংলার সর্ব প্রাচীন কর্পোরেট মালিকানাধীন আনন্দবাজার রাজ্যপালের বিবৃতি প্রকাশ করেছে যাতে রাজ্যপাল মহাশয় ছাত্রদের আন্দোলনের সমালোচনা করেছে 'ক্রাইম' বা অপরাধ বলে।  হঠাত করে আনন্দবাজার হাত ধুয়ে প্রেসিডেন্সির ছাত্র আন্দোলনের পিছনে কেন লাগা শুরু করলো ? এই পিছনে লাগা আর সমালোচনা কি শুধুই প্রেসিডেন্সির ছাত্র - ছাত্রীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জঙ্গি রূপের সমালোচনা না কি এর পিছনে আনন্দবাজারীয় কোনও গভীর ষড়যন্ত্র আছে ?

প্রেসিডেন্সির ছাত্র-ছাত্রী ও অধ্যাপক-গবেষেকগণ  দীর্ঘদিন ধরে নবান্নের দলদাস ভিসি অনুরাধা লোহিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। তাঁদের সংগ্রামের মূল কারণ যে ডিমড বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্সির পরিকাঠামোয় কোনও উন্নয়ন আজ অবধি করে উঠতে পারেননি লোহিয়া। তার আমলের অব্যবস্থার জন্যে অধ্যাপক ও গবেষকরা প্রেসিডেন্সি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্সির প্রবেশিকা ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে গ্রাম বাংলার ছাত্র-ছাত্রীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান তাও বিসর্জন দিতে তৈরি হলেন লোহিয়া। স্বায়ত্ব শাসন শুধু মাত্র কাগজ কলমে রেখে তৃণমূলের রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির পিছনেই বেশি করে লেগে রইলেন ভিসি। এ যেন একেবারে যাদবপুরের প্রাক্তন ভিসি অভিজিতের নব রূপে আত্মপ্রকাশ। তাই সেই যাদবপুরের সংগ্রামে পোড় খাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভিসির বিরুদ্ধে সংগ্রামে। যাতে আরও আগুন লাগলো যখন প্রথমবারের সফরে সেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কনভয় ঢুকলো। প্রেসিডেন্সির ছাত্র সংগ্রামের ঐতিহ্য বজায় রেখে ছাত্র ছাত্রীরা রুখে দাঁড়ালেন, প্রতিবাদ করলেন মমতার পুলিশের হাতে সুদীপ্ত গুপ্ত নামক বামপন্থী ছাত্র কর্মীর নির্মম হত্যার, প্রতিবাদ করলেন তৃণমূলী ছাত্র পরিষদের লুম্পেনদের দ্বারা প্রেসিডেন্সি প্রাঙ্গনে আক্রমণের। তাতেই ভীত হলো মমতা ও তৃণমূল, যারা সাথে সাথে টিএমসিপির ভাড়াটে বাহিনী এনে তান্ডব চালালো গোটা কলেজ স্ট্রিট জুড়ে।

একথা সুবিদিত যে তৃণমূলী ছাত্র পরিষদে শুধু মাত্র মধ্য মেধার, উচ্চাকাঙ্খী, কংগ্রেসী পরিবারের, বা সরকারী সুযোগ সুবিধা খোঁজা এক শ্রেনীর লুম্পেন ছাত্র - ছাত্রীরাই যোগ দেয়। রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি নিয়ে এদের না কোনও চেতনা আছে না কোনও রাজনৈতিক দিকনির্দেশ আছে।  শুধু কলেজে কলেজে ক্যাম্প করে ছাত্র ভর্তির সময় পয়সা কামাই, রাস্তায় নেমে মারামারি, কলেজ সংসদ নির্বাচনে সন্ত্রাস ছড়ানো এবং দিদির ডাকে ট্রেনে বাসে চেপে ভিড় বাড়ানোর মিছিলে সামিল হওয়া ছাড়া এদের আর কোনও ভূমিকা নাই।  তাই উচ্চ মেধা, চেতনা, সংগ্রামের পীঠস্থান প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, ইত্যাদী জায়গায় এদের দাঁত ফোটানো হয়ে ওঠে না। ফলে এরা এই সব প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের চরম ভাবে ঈর্ষা করে, তাই তো দেখা যায় যাদবপুরের ছাত্র মিছিলের প্রতিবাদে মমতার নির্দেশে শঙ্কু পান্ডার নেতৃত্বে মিছিল করতে সারা রাজ্য থেকে কলেজ তো কলেজ মায় স্কুলের ছাত্র ছাত্রিদেরও নিয়ে এসে ভিড় বাড়িয়ে এরা আস্ফালন করে, প্রেসিডেন্সির ছাত্র রাজনীতিতে নিজেদের কোনও জায়গা তৈরি করার অপরাগতার থেকে এরা বিষাদগ্রস্ত হয়ে সেই প্রতিষ্ঠানে হামলা করে। এটাই দক্ষিনপন্থী কংগ্রেসী রাজনীতির পরিচয়, যার আর একটা প্রতিবিম্ব বিজেপি -আরএসএস এর ছাত্র সংগঠন এবিভিপি'র কর্মকান্ডে দেখা যায়।

আনন্দবাজার তার বাজারমুখী কায়দায় যাদবপুরের ছাত্র সংগ্রাম নিয়ে একটা প্রচার চালিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যেন এরা ছাত্র আন্দোলনের কত বড় সমর্থক। আজ সেই আনন্দবাজার হঠাত করে প্রেসিডেন্সির ছাত্র বিক্ষোভের বিরোধিতা কেন করছে ? নিজেদের বিনোদনের পাতায় বিকিনি পরিহিত নারীর ছবি প্রদর্শনকারী, উত্তেজক যৌন উপাদানে ভরা মশলা খবরের বাজার দখল করার লড়াইয়ে  যে আনন্দ গ্রুপ টাইমস গ্রুপ কে টেক্কা দিচ্ছে সে হঠাত করে কেন ছাত্রদের আন্দোলন কে অশালীন বলছে ? কি ভাবে তারা শালীনতা - অশালীনতার মাত্রা ঠিক করছে এবং কেন আপামর ছাত্র - ছাত্রীরা তাদের এই শালীনতার মাত্রা কে স্বীকার করবেন বলে তারা ভাবছে?

এর পিছনে আছে এক গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। গত কয়েক বছর ধরে মার্কিণ মুলুকের নেতৃত্বাধীন বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজির চোখে হিন্দু ফ্যাসিবাদের প্রবক্তা বিজেপি - আরএসএস ও তাদের নেতা মোদী ভীষন প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। যার ফলে গত বছরের সাধারণ নির্বাচনে মোদীর নির্বাচনী প্রচার থেকে ভোটে জেতার পিছনে ছিল বিদেশী ও দেশী বৃহত একচেটিয়া পুঁজির লগ্নি, যার জোয়ারে দেশে 'হর হর মোদীর' স্ত্রোত পাঠ শুরু হয়।  এই জোয়ারে আমাদের বাজারী আনন্দবাজার, যার সাথে আবার রুপার্ট মুরডকের নিউজ কর্পোরেশনের খুব ভালই যোগাযোগ আছে, সে কি করে গা না ভাসিয়ে থাকতে পারত ? তাই হরহর মোদী ভজনা শুরু হলো আমাদের বাজারমুখী আনন্দবাজারে, তবে অন্যদের মতন গাড়ল হিসাবে নয়, নিজস্ব বনেদী কায়দায় তারা শুরু করলো মোদী ভজনা, অনেক সুক্ষ ভাবে যাতে বাংলার তপ্ত রাজনৈতিক মঞ্চে তাদের জলে নেমেও বেণী না ভেজে।  আনন্দবাজার বিদেশী পুঁজির একচ্ছত্র আধিপত্যের পক্ষে ওকালতি বহু বছর ধরে চালিয়েছে, তারা খোলাখুলি ভাবে দক্ষিণপন্থা ও ফ্যাসিবাদের পক্ষে বারবার দাঁড়িয়েছে, যেমন এককালে হিটলারের শাসনকালে জার্মানির তথা কথিত প্রগতির পক্ষে তারা ওকালতি করেছিল সেই ব্রিটিশ শাসনকালে। উগ্র কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচার মাধ্যম হিসাবে ৫০'র দশক থেকেই নাম কামায় আনন্দবাজার। এই আনন্দবাজার পশ্চিমবঙ্গে মমতার নেতৃত্বে তথাকথিত পরিবর্তনের সরকার গঠন করার অন্যতম কারিগর। কারণ তখন এদের খুঁটি যেখানে বাঁধা সেই মার্কিণ মুলুক থেকে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন মনমোহন সরকারকে সমর্থন করার নির্দেশ এসেছিল। কিন্তু দেশের পট পরিবর্তনের সাথে সাথে মোদীর অর্থনৈতিক সংস্কারের বাঙালি উকিল আনন্দবাজার মমতার বিরুদ্ধে কলম চালায় তার মোদীর সাথে চলমান ক্ষমতার দ্বন্ধের কারণে। সেই কারণেই যখন মমতা - মোদী দ্বন্ধ চরমে তখন যাদবপুরের লড়াইকে সমর্থন করা আনন্দবাজারের দায় হয়ে দাঁড়ায়।  কিন্তু এই বছর থেকে বাজার ও বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজির চাপে মমতাকে মোদীর সাথে সন্ধি করতে হয়। এর ফলে মমতার দল তৃণমূলের সংসদে মোদী ও বিজেপির বিরুদ্ধে রনাং দেহি মূর্তি মিলিয়ে গেল বাতাসে। দেখা গেল যে এফটি আই আই এর সংগ্রামরত ছাত্র-ছাত্রীদের বিজেপি-আরএসএস দ্বারা গজেন্দ্র চৌহান কে অধিকর্তার স্থলে অভিষিক্ত করার বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রাম কে সমর্থন করতে যাওয়ার তৃণমূলী যাত্রাও স্থগিত হয়ে গেল কোনো অজ্ঞাত কারণে। তাই মমতার বিরুদ্ধে ছাত্রদের সংগ্রাম তো আনন্দবাজারের চোখের কাঁটা হবেই। অতএব শালীনতার প্রশ্ন তুলে চললো দেশের এক নামী প্রতিষ্ঠানের ছাত্র - ছাত্রীদের লড়াইয়ের বিরোধিতা।                             

বিশ্বের দেশে দেশে বৃহত কর্পোরেট এক চেটিয়া পুঁজি চায় যে ছাত্র ছাত্রীরা তাদের বশংবদ দাস হয়ে থাকবে, আন্দোলন সংগ্রাম পরিত্যাগ করে শুধু ক্যারিয়ার গড়ার জন্যে ইঁদুর দৌড়ে ছুটবে, কে কত বড় কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী হবে তার জন্যে প্রতিযোগিতা করবে। এবং বর্তমান কর্পোরেট প্রচার মাধ্যমের দরুন অনেকাংশে এই কার্য বৃহত একচেটিয়া পুঁজি ভারতের মতন নয়া ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে সফল ভাবে প্রয়োগ করেছে। শহুরে উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যে ক্যারিয়ার গড়ার প্রতিযোগিতার বাজার বসিয়ে মার্কিণ মুলুকে বসা বৃহত লগ্নি পুঁজি হাততালি দিছে। আর ভারতে ছাত্র -ছাত্রীরা যদি তাদের বেঁধে দেওয়া ছক ভেঙ্গে রাজনৈতিক সংগ্রামে যোগদান করে তাহলে আনন্দবাজার ও রাজ্যপালদের মাধ্যমে তাঁদের উপর চোখ রাঙাতে থাকে। 

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের রেখে যাওয়া বর্তমান প্রতীকগুলির অন্যতম হলো রাজ্যপালের দফতর।  জনগণের করের টাকায় আয়েশে রাজনৈতিক জীবনের অবসর কাল কাটাবার শ্রেষ্ঠ জায়গা হলো রাজভবন।  এই ভবন আলোকিত করে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রাক্তন নেতারা। তাই উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা কেশরী নাথ ত্রিপাঠির মতন উচ্চ জাতির এক প্রাক্তন আরএসএস কর্মীর পশ্চিমবঙ্গে আগমন হয়, পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির নেতা ও মুসলমান বিদ্বেষী তথাগত রায় ত্রিপুরার রাজভবনে বসে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে টুইট করতে থাকে।  রাজ্যপাল কেশরিনাথ ত্রিপাঠি চিরকাল প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি করেছে, সে উত্তর প্রদেশের বিজেপি নেতা থাকার সময় থেকেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে উস্কানি দিয়ে এসেছে, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময় তারা একযোগে দেশ জোড়া দাঙ্গার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। সাবেক আদবানি - মুরলী মনোহর জোশী শিবিরের নেতা হওয়ায় তাকে মোদী শিবির বানপ্রস্থে পাঠায়, এর ফলে সে আসে পশ্চিম বাংলায়। কিন্তু পশ্চিম বাংলার রাজনীতি, বিশেষত: ছাত্র যুবদের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সংগ্রাম এই পোড় খাওয়া আরএসএস কর্মীর দ্বারা হজম করা সম্ভব হয় না। যে লোক সারা জীবন জাতপাত আর ধর্মের মেরুকরণের রাজনীতির মধ্যে জীবন কাটিয়েছে সে কি করে মানবে যে জাতপাত ধর্ম নির্বিশেষে ছাত্র - যুব - শ্রমিক - কৃষকরা রাজনৈতিক দাবি নিয়ে গণতান্ত্রিক লড়াই করছেন। তাই যাদবপুর নিয়ে কটুক্তি, ডিগ্রী নিতে অস্বীকার করা ছাত্রীকে ধমক দিয়ে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া আর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের 'অরাজনৈতিক' ছাত্র ইউনিয়ন' এর প্রশংসা, এই সব নিদর্শন থেকে বোঝা যায় কি রকম ফ্যাসিস্ট মানসিকতার মানুষ আজ বিপ্লব - বিদ্রোহ ও প্রগতিশীল চেতনার জন্মভূমি বাংলার রাজ্যপাল আজ। 

আজ যে ছাত্র যুব আন্দোলনের জুজু দেখছে আনন্দবাজার থেকে তৃণমূল - বিজেপি থেকে রাজ্যপাল - প্রধানমন্ত্রী হয়ে মার্কিণ দেশের ওয়াল স্ট্রিট, সেই সংগ্রাম শীঘ্রই দাবানল হয়ে জ্বালিয়ে দেবে ফ্যাসিবাদ ও বৃহত এক চেটিয়া পুঁজির সাধের সাজানো বাগান। তাই তো দেখা যায় এরা সম্মিলিত ভাবে আজ আন্দোলনের ফুলকি গুলো নেভাবার সংগ্রামে কি ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।  

            


এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে