আবার মাতৃভূমি - আবার পুরুষদের হিংসাত্মক আক্রমণের শিকার মহিলা যাত্রীরা

মঙ্গলবার, আগস্ট ২৫, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

আবার মাতৃভূমি লোকাল নিয়ে তুলকালাম কান্ড হল ২৪শে অগাস্ট সকালবেলা। প্রায় ৬ ঘন্টা অবরোধ চললো বনগাঁও - শিয়ালদহ সেকশনে এবং যথারীতি প্রশাসন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকলো। রেলের - আরপিএফ আর রাজ্য সরকারের জিআরপি'র চূড়ান্ত সমন্বয়ের অভাবে শুধু ভুক্তভোগীই হলেন না অসংখ্য অফিস যাত্রী, নির্মম ভাবে দুর্বৃত্তদের হাতে মার খেলেন অসংখ্য মহিলা। হাবরা, গোবরডাঙ্গা, প্রভৃতি জায়গায় বিজেপির মদতপুষ্ট দুষ্কৃতি বাহিনী এই অবরোধে নেতৃত্ব দেয় এবং পুরুষতন্ত্রের উগ্র জিগির তুলে মহিলাদের বিরুদ্ধে পুরুষ যাত্রীদের ক্ষেপিয়ে তুলে হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালাবার প্রস্তুতি চালায়।

এর আগে আমি "মাতৃভূমি তুমি কার ?" প্রবন্ধে লিখেছিলাম যে হঠাত করে রেল কোম্পানির মাতৃভূমি লোকালে পুরুষ প্রবেশ শুরু করালো কোন উদ্দেশ্যে ? এর পিছনে আমি লিখেছিলাম যে বিজেপির হিন্দু ফ্যাসিবাদী রাজনীতির পুরুষতান্ত্রিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার সুক্ষ প্রয়াস কাজ করছিল। গত সপ্তাহে কলকাতায় মমতা ব্যানার্জীর সাথে বৈঠকের পরে রেল মন্ত্রী সুরেশ প্রভুর দ্বারা রেলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার পরেও যে অশান্তির প্রচেষ্টা চলছিল তা অনেক নিত্য যাত্রীরা আঁচ করতে পারলেও রেল কতৃপক্ষ এই নিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে উদাসীন ছিল। গত সপ্তাহের শেষ দিক থেকেই বিজেপি সমর্থক কিছু দুষ্কৃতি রেল অবরোধের সাথে সাথে মহিলা নিত্য যাত্রীদের উপর যে আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল তা রেল কোম্পানি জেনেও না জানার ভান করে ছিল।

সোমবার যখন রেল অবরোধ শুরু হয় এবং বিভিন্ন জায়গায় রড, পাথর, লাঠি নিয়ে ট্রেনের উপর আক্রমণ চালানো হয় পরিকল্পিত ভাবে, তখনও এর পিছনে রেল কোম্পানি বা স্থানীয় প্রশাসন রাজনৈতিক শক্তিগুলির হাত দেখেনি। হাফ প্যান্ট, গেঞ্জি পরে কিছু লোক স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেনে পাথর ছুড়ছে, মহিলাদের শ্লীলতাহানি করছে এবং একের পর এক স্টেশনে পরিকল্পিত ভাবে সমন্বয় সাধন করে উত্পাত করছে তখন কি ভাবা চলে যে এই দাঙ্গা হাঙ্গামা একেবারে স্বতস্ফুর্ত। আপিস যাবার তাড়া যখন সোমবার সকালে সাধারণ কর্মচারী - খেটে খাওয়া মানুষদের তাড়া করে তখন রেল অবরোধ করে, দাঙ্গা হাঙ্গামা করে সময় কাটানো কি সেই মানুষগুলির পক্ষে সম্ভব ? নাকি একমাত্র এক শ্রেনীর দুর্বৃত্ত, যাদের পিছনে গৈরিক বাহিনীর মদত আছে শুধু মাত্র তারাই পারে ব্যস্ততার সময়ে রেল অবরোধ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই করার নামে মহিলাদের উপর অকথ্য অত্যাচার এবং শ্লীলতাহানি করার স্পর্ধা দেখাবার।

এই আক্রমণ ও অবরোধ করা হয়েছে মহিলাদের প্রতি পুরুষের হিংসাত্মক মনোভাব কে চাগিয়ে তুলে বিজেপি - আরএসএস এর নেতৃত্বে হিন্দু ফ্যাসিবাদী ব্রাক্ষণবাদী পুরুষতন্ত্র কে রাজনৈতিক ভাবে প্রসার করার স্বার্থে। যাতে পুরুষ ও নারীদের ট্রেনের অপ্রতুলতার নামে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে, রেলের প্রধান দুরবস্থাকে আড়াল করে, লিঙ্গ ঘৃণার আবহাওয়া সৃষ্টি করতে।  এই অপচেষ্টার বড় শরিক হলো সুরেশ প্রভুর রেল। একদিকে যখন রেল কোম্পানি শিয়ালদহ ডিভিশনে সঠিক ভাবে ট্রেন চালাতে ব্যর্থ উপযুক্ত পরিকাঠামো ও রোলিং স্টকের অভাবে। প্রতিদিন নাকাল হতে হয় অজস্র নিত্য যাত্রীদের, ট্রেনের ভিতর বসা তো দূর দু পায়ে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া দুস্কর হয়ে যায়। এই অবস্থায় যদি কোনও নারী সাধারণ কামরায় প্রবেশ করেন তাহলে তাঁকে চ্যাংরা ও ভদ্রবেশী পুরুষদের কাছে হয় শুনতে হয় যৌনতাযুক্ত ব্যঙ্গ না হয় তাঁদের নিগৃহিত হতে হয় চুপচাপ ভিড়ের মধ্যে কারুর কামনার শিকার হয়ে। যে সমস্ত পুরুষরা আজ মহিলা ট্রেন তুলে দেওয়ার বিজেপির রাজনৈতিক দাবির পক্ষে সাওয়াল করছেন তারা আবার নিজেদের বাড়ির মেয়ে - বউদের ট্রেনে তোলার সময় সবসময় মহিলা কামরায় তুলে দেন। কারণ তারা জানেন যে ওই দেশলাই খোপের মতন মহিলা কামরা ছাড়া নারীদের জন্যে গোটা ট্রেন সুরক্ষিত নয়।

অনেক পুরুষ যাত্রী বা তথাকথিত ট্রেনের কামরার সবজান্তা আঁতেলরা প্রশ্ন করেন মহিলাদের জন্যে এত সুবিধা দেওয়ার কারণ কি , কেউ কেউ আবার বলেন যে বিদেশে নারীদের জন্যে এত কিছু দেওয়া হয় না।  এই প্রশ্নের জবাবে উল্টো প্রশ্নই হতে পারে - যে এই দেশে মহিলাদের আসলে কি সুবিধা দেওয়া হয়েছে ? গুটিকয়েক শহরবাসী মহিলা বাদে কোথায় নারীদের মধ্যে সাক্ষরতা? কোথায় তাঁদের জন্যে কর্ম সংস্থান ? কোথায় তাঁদের জন্যে সামাজিক নিরাপত্তা ? যে দেশে নারীর উপর নিগ্রহের দায় সেই নারীর উপর চাপিয়ে দিতে সমাজ ওস্তাদ, যেখানে মহিলাদের শুধু বাড়িতে বসে রান্না করা, বাচ্চা উত্পাদন করা, এবং পুরুষের যৌন দাসী হয়ে থাকার কথা সমাজ শেখায় - সেই সমাজে মহিলাদের জন্যে একটি ট্রেন আপনাদের চোখে কাঁটার মতন বিধতে থাকে ?
পশ্চিমী দেশে মহিলাদের জন্যে আলাদা ট্রেন বা কামরা থাকে না কারণ সেখানে সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতায় সিদ্ধ পুরুষতন্ত্রের নেশায় বুঁদ হয়ে পুরুষ মানুষ মহিলাদের সাথে অভব্যতা করার সাহস করে না। পশ্চিমী উন্নত দেশে মহিলাদের চাকরি করা বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে পুরুষরা বিদ্বেষের চোখে দেখেন না।  তাই ওখানে মেয়েদের জন্যে আলাদা কামরার দরকার হয় না। এ দেশে ততদিন মেয়েদের আলাদা কামরার দরকার পরবে যতদিন এখানে পুরুষ মানুষের চেতনার বিকাশ হবে না। 

মাতৃভূমি লোকাল কে নিয়ে চলমান তুলকালাম আসলে এক গূঢ় রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে পরিচালিত লিঙ্গ বৈষম্যর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা হিংসাত্মক লড়াই, যার চরিত্র সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে চরম প্রতিক্রিয়াশীল। এই হিংসাত্মক লড়াই বাঁধানো হয়েছিল সমাজে মেয়েদের প্রতি পুরুষের ঘৃণা, ঈর্ষা ও লালসার চরিত্র কে চাগিয়ে তুলে লিঙ্গের ভিত্তিতে সামাজিক মেরুকরণ গড়ার প্রয়াস নিয়ে। সঠিক ভাবে যদি রাজ্য সরকার এই ঘটনার তদন্ত করায় তাহলে অনেক লুকোনো তথ্য সামনে আসবে।                         

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে