পশু প্রেমের নামে কোরবানি ঈদের বিরোধিতার পিছনে রয়েছে ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তির ষড়যন্ত্র

মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৬ 0 Comments A+ a-


খুশির ঈদ বলা হলেও আদতে ঈদ অন্যান্য সকল ধর্মের উৎসবের মতনই ধনী মানুষের উৎসব। ঈদ উল ফিতর করার কোনো বাণী কোরানের পাতায় নেই, বরং সত্যি বলতে ঈদ শব্দটি যীশুর শেষ আহারের ঘটনা বাদে কোরানে আর কোথাও উচ্চারিত হয়নি। মোহাম্মদের সময়ে এবং পরবর্তীকালে আরবদের নানা আদি উৎসব ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করে, ঠিক যেমন রোমানদের নানা উৎসব ক্যাথলিক ধর্মে প্রবেশ করে সরকারি মর্যাদা পায়, ঠিক সেই ভাবেই ঈদ উল ফিতর ও ইহুদিদের কোরবানির উৎসব ঈদ হিসেবে আরব ইসলামে প্রবেশ করে। যাই হোক ভারতীয় উপমহাদেশে কোরবানির ঈদ চিরকাল ধনী আর উচ্চ মধ্যবিত্তদের ধনের জৌলুস দেখানোর একটি বিশেষ দিন, কে কটা গরু, ছাগল, উট, ভেড়া কাটতে পারে তার দিন। কোরবানির সাথে জুড়ুন হিন্দুদের পাঁঠা আর মোষ বলি, যা বোধহয় প্রতি সপ্তাহে হয় আর অজস্র জানোয়ার হাঁড়ি কাঠে কাটা পড়ে ধর্মের দোহাইতে। মুসলমানের আল্লাহ আর হিন্দুর মা কালি নাকি জানোয়ারের রক্তে প্রসন্ন হন, মানুষের ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ও ভালোবাসার নিদর্শন হলো পশু বলি বা কোরবানি।


বিগত দুই দশক ধরে হিন্দুত্ববাদী শক্তির শকুনের নজর গিয়ে পড়েছে কোরবানির ঈদে, নৈপথে প্রথমে ছিল গো রক্ষা আর এবার জুটেছে নৃশংসতার প্রশ্ন। হিন্দুত্ববাদের ধবজ্জাধারী আরএসএস ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা অনেকদিন ধরে হিন্দু ধর্মের উত্তর ভারতীয়করণ করার প্রচেষ্টায় জড়িত। উত্তর ভারতীয় উচ্চ জাতির ব্রাক্ষণ ও বৈশ্য জাতির মানুষেরা নিরামিষাশী হয় জৈন ধর্মের প্রভাবে পড়ে। সেই নিরামিষাশী হিন্দুত্ব কে আজ সারা ভারতে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে আরএসএস এর শাখাগুলোর মাধ্যমে। আরএসএস ও বিজেপির কাছে চ্যালেঞ্জের রাজ্য হলো কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা, মনিপুর, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, ও গোয়ার মতন রাজ্য যেখানে হিন্দুদের মধ্যে মাংস খাওয়ার প্রবণতা চালু আছে। কেরলে হিন্দুদের একটা বড় অংশ গো মাংস ভক্ষণ করে, কলকাতা শহরেও অনেক হিন্দু বাঙালি হাপুস হুপুস করে গরুর বিরিয়ানি খান। কিন্তু এক জাতি, এক ভাষা, এক ধর্মের ভিত্তিতে যে হিন্দু রাষ্ট্র আরএসএস হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান স্লোগানের আড়ালে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেখানে ইসলামের ওয়াহাবি-সালাফি ধারার মতনই হিন্দু ধর্ম ও তার রীতিনীতি সারা দেশজুড়ে একই হবে। মোদ্দা কথা হলো দেশের মানুষ নিরামিষাশী হবে, বড় জোর মাছ আর মুরগি খাবে, আর বাকি সমস্ত পশু বিদেশে রফতানি হবে বিদেশি মুদ্রা কামাবার জন্যে। ব্রাক্ষণত্ববাদের এই নিশানায় বাঁধা সেঁধেছে অহিন্দি ভাষী হিন্দুরা আর দলিত ও আদিবাসী সমাজ, যাঁদের উপর প্রায় জোর করে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান ও গুজরাটে ব্রাক্ষণত্ববাদের নয়া নিরামিষবাদ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিগত তিন দশক ধরে সারা দেশে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার নামেও খাদ্য অভ্যাস কে অন্যের ঘাড়ে হয় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বা বাড়ি ভাড়া বা ক্রয়-বিক্রয় করার ক্ষেত্রে ভেদাভেদ করা হচ্ছে।

মুসলমান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় দোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাংস খাওয়ার অভ্যাস। ভারতবর্ষে যেন পশু হত্যা করে খাওয়া ঘৃণ্য অপরাধ হয়ে গেছে, বিজেপি শাসিত বেশির ভাগ রাজ্যে, বিশেষ করে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোয়, মহারাষ্ট্র, মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড়, ইত্যাদি রাজ্যে গরুর মাংস খাওয়া ও বিক্রি করায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, মুসলিম প্রধান কাশ্মীর উপত্যকায় রণবীর পেনাল কোডের মাধ্যমে গরুর মাংস নিষিদ্ধ হয়েছে, আর এবার সারা দেশ জুড়ে চলছে পাঁঠা, মোষ, ভেড়া ইত্যাদি নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। মাংস খাওয়া কে রোখার জন্যে ধর্ম আর আইনের বোঝা জনগণের ঘাড়ে, বিশেষ করে মুসলমান-খ্রিষ্টান-আদিবাসী ও দলিতদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে।   


পশ্চিমবঙ্গে আর অসমে যখন পুজোর নামে সারা বছর জুড়ে পশু বলি চলে, ঠিক তখনই বছরে একবার ঈদের দিন ধর্মের নামে জানোয়ার কাটার জন্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ চলছে। শহরাঞ্চলে এর প্রভাব তীক্ষ ভাবে টের পাওয়া যায়, গ্রামাঞ্চলে (দক্ষিণবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর, হুগলি, বর্ধমান এবং উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কুচবিহার বাদে) দীর্ঘদিন ধরে গরিব হিন্দু আর গরিব মুসলমান একসাথে মিলেজুলে বাস করার ফলে দ্বন্ধ ও ঘৃণা এত তীব্র হয়নি। কোরবানির ঈদের চাঁদ আকাশে দেখার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা ভারতে ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তিগুলো প্রচার শুরু করে পশু হত্যার বিরোধিতা করার নামে। মুসলমানদের নামে তীব্র অপপ্রচার চালানো হয় এবং বিশেষতঃ উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান ও গুজরাটের বিভিন্ন প্রান্তে গরু কাটার গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা লাগাবার চেষ্টা করে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ,  বজরং দল ও এদের রাজনৈতিক গণসংগঠন বিজেপি। গত বছর উত্তর প্রদেশের দাদরি জেলার বিদাসা গ্রামে কোরবানি ঈদের ঠিক পরেই গরু কাটার অভিযোগে একদল বিজেপি ও আরএসএসের লোকেরা পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে মোহাম্মদ আখলাক নামক এক প্রৌঢ় কে। এই বছর হরিয়ানার মেওয়াত এলাকায় গরু খাওয়ার অভিযোগ তুলে কোরবানি ঈদের ঠিক আগেই হঠাৎ পুলিশি অভিযান শুরু হয় আর একটি মুসলমান পরিবারের দুই সদস্যকে হত্যা করে দুই জন মহিলাকে, যার মধ্যে একজন নাবালিকা,  গণধর্ষণ করে চার জন দুষ্কৃতী যারা নিজেদের গো রক্ষক হিসেবে পরিচয় দিয়ে ধর্ষণ পীড়িতদের বলে যে এই খুন আর ধর্ষণ গরু খাওয়ার শাস্তি। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে এই অপরাধ করার জন্যে একদল মানুষ কে কি ভাবে তাঁতিয়ে তোলা হচ্ছে। আর যারা তাঁতিয়ে তুলছে তাদের সাথে প্রকাশ্যে হাত মিলিয়ে হরিয়ানায় গরু প্রেমী খাট্টার সরকার সমস্ত রকম ভাবে গরু নিয়ে, ছাগল কাটা নিয়ে বিদ্বেষের পরিবেশ সৃষ্টি করে জাঠ সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে।
উত্তরপ্রদেশেও নিরামিষ খাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কোরবানির ঈদের বিরোধিতা করা হচ্ছে প্রবল ভাবে, গ্রামে গ্রামে উঁচু জাতের জোতদাররা চেষ্টা করছে দলিত ও নিম্ন জাতির হিন্দু কৃষকদের গরুর নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে যাতে গুজরাটের উনার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা দলিত সম্প্রদায়ের ব্রাক্ষণত্ববাদ বিরোধী ঘৃণার স্রোত কে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বইয়ে দিয়ে ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগেই মেরুকরণের কাজ সম্পন্ন করা যায়।


আমাদের দেশে বৈচিত্র কে মিটিয়ে মানুষকে ভেড়ার মতন এক শ্রেণীতে ফেলার আরএসএসের পরিকল্পনা যদিও সহজ নয়, তবুও মনে রাখতে হবে যে দীর্ঘদিন ধরে আরএসএস সিনেমা, টেলিভিশন, সংবাদ মাধ্যম ও প্রচারের নানা মাধ্যমে নিজের একচেটিয়া কতৃত্বের মারফৎ সারা দেশে উত্তর ভারতের হিন্দুত্ববাদ কে সারা ভারতে পাচার করেছে। প্রায় ১৭-১৮ বছর আগে শুরু হওয়া স্টার টিভির "কিউঁকি সাঁস ভি কভি বহু থি", "কাহানি ঘর ঘর কি" ইত্যাদি সোপের কথা মনে পড়ে? এই ধারাবাহিকগুলোয় বারবার করে উত্তর ভারতের উঁচু জাতের হিন্দুদের জীবন যাত্রা কে সমগ্র দেশের জন্য অনুসরণ যোগ্য এক আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়। মহিলাদের স্বামী ও সন্তানের প্রতি দ্বায়িত্ব পালনের সনাতন জ্ঞান দেয় স্মৃতি ইরানি ও সাক্ষী তানবার। এই ধারাবাহিকগুলোর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত উত্তর ভারতের হিন্দুদের নানা অনুষ্ঠান ও পার্বন পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। দেখতে পাবেন করবাচৌত, মেহেন্দি, বিয়ের মন্ডপে উদ্দাম নাচ, ইত্যাদি বাঙালি হিন্দুর জীবনে হুহু করে প্রবেশ করেছে। ঠিক যেমন বাঙালি মুসলমানের জীবনে প্রবেশ করেছে দাড়ি-টুপি-বোরখার মতন জিনিস।


আজ আরএসএস সমগ্র দেশের বৈচিত্রময় নানা জাতির নিজস্ব জীবনশৈলী কে শেষ করে দিতে চায় হিন্দুত্বের নেশন স্টেট তৈরি করার বাসনায়। কোরবানির ঈদের নামে পশু হত্যার বিরুদ্ধে যে আরএসএস বলবে সেই আরএসএস কিন্তু কালীঘাটে বা কামাখ্যা মন্দিরে খাঁড়ার আঘাতে দ্বিখন্ডিত হওয়া পশুর প্রতি সহমর্মিতা দেখাবে না। কারণ ঈশ্বরের সাথে সাথে মনে হয় পশু হত্যায় পাপের ভার হালকা হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে এক সম্পূর্ণ বৈচিত্রময় ও বিবিধ ভারত আরএসএস ও বিজেপির হিন্দু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র গড়ার পথে এক বিশাল বাঁধা, বিশেষ করে এই দেশের দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের নিজস্ব জীবন শৈলী সংঘ পরিবারের কাছে এক চ্যালেঞ্জের বস্তু। তাকে রক্ষা করা ও নানা নিপীড়িত জাতির ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিজস্ব পরম্পরা ও উৎসব পার্বন কে পালন করার স্বাধীনতা কে রক্ষা করা বর্তমান সময়ে এক বড় দ্বায়িত্ব। এই দ্বায়িত্ব পালন করা আজ সমস্ত গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন মানুষের সবচেয়ে জরুরী কর্তব্য।  বলি বা কোরবানির থেকে ধীরে ধীরে শিক্ষিত করে মানুষ কে দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়াস অবশ্যই চালাতে হবে বৈজ্ঞানিক বিচারধারা কে প্রতিষ্ঠা করতে, কিন্তু কারুর উপর কিছু চাপিয়ে না দিয়েই এই কাজ করতে হবে জনতার মুক্তি সংগ্রামের সাথে সাথে।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে