ঢোলাহাট থেকে তারক বিশ্বাস পর্ব - মোদী ও মমতার সখ্যতা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে

শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৬ 0 Comments A+ a-


লোকমুখে ও ইন্টারনেটে মমতাকে আরএসএস ও বিজেপি মুসলমান তোষণকারী ও হিন্দু বিরোধী বলে প্রচার করছে এবং কলকাতা সহ সমস্ত শহরতলীতে একটা চাপা প্রচার চালাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা নাকি খুবই দুর্বল এবং বাংলাদেশ থেকে নাকি ভোট ব্যাঙ্ক গড়তে প্রচুর পরিমানে মুসলমান অনুপ্রবেশকারী কে ঢুকিয়ে এই রাজ্যে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি করাচ্ছে তৃণমূল। বিজেপি ও তার পিতৃপ্রতিম সংস্থা আরএসএস এর সাথে সংযুক্ত হিন্দুত্ববাদী সংবাদসংস্থাগুলো এই আষাঢ়ে গল্পের গরু কে শুধু মই দিয়ে গাছে চড়িয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, মইটাকে চুরি করে পালিয়েও যাচ্ছে।তৃণমূলের নেতৃত্বের কাছে বা খাস মমতার কাছে এই প্রচারের কথা অজানা নয়, তবুও মমতা চুপ করে থেকে এই প্রচার কে সত্য হিসেবে প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছে। যে বা যারা সাচার কমিটির রিপোর্ট পড়েছেন (সম্প্রতি বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সাচার কমিটির রিপোর্ট কে আস্তাকুঁড়েতে ছুড়ে ফেলেছে) তাঁরা জানেন যে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের দুর্দশার আসল ছবিটা কি আর সেই দুর্দশা দূর করতে যেহেতু বামফ্রন্ট সরকার কিছুই করেনি তাই মুসলমান সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়ে ভোটে জিতেছিল মমতা বন্দোপাধ্যায়। কিন্তু আদতে মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্যে ইমাম ভাতা আর ঈদের দিনে মদন আর ববি কে টুপি পড়িয়ে বাজারে ছেড়ে বা কখনো কখনো নিজের মাথায় হিজাব পড়ে দোয়া করা ছাড়া মমতা বা তৃণমূল কোনোদিন কিছুই করেনি বরং বারবার চেষ্টা করে এসেছে যাতে মুসলমান সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলমান যুব সমাজ ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুপমুণ্ডুকতার বাইরে বের হয়ে জীবনযাপন না করতে পারে, আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল না হতে পারে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তির সমকক্ষ না হতে পারে।তাই দেখুন আজও মুসলমান সম্প্রদায় ব্রাক্ষণত্ববাদী ভদ্রলোকদের তুলনায় শিক্ষা, চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কত পিছিয়ে। সকাল সন্ধ্যে মুসলমান সম্প্রদায় যাতে খালি পেটে আর খালি পকেটে শুধু আল্লা আল্লা করে শান্ত থাকে তার বন্দোবস্ত করা ছাড়া বাস্তবে মমতার সরকার আর কি করেছে মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্যে? বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের জন্যে - যাঁদের অধিকাংশ কে আজ কলকাতা শহর থেকে খেঁদিয়ে দেওয়া হয়েছে?


মমতা বন্দোপাধ্যায় বা তৃণমূল কংগ্রেস তাদের মাতৃসম পার্টি কংগ্রেসের মতনই তীব্র হিন্দুত্ববাদী - গোঁড়া ব্রাক্ষণত্ববাদী পার্টি যারা মুসলমানদের শুধু ধর্মীয় কুপমুণ্ডুক আর মৌলবাদের ঘেরাটপে বন্দী করে রাখতে চায়, ইমাম-মুফতি-মৌলানাদের হাত করে সমগ্র মুসলমান সম্প্রদায়কে অন্ধকারে ঠেলে রেখে ব্রাক্ষণত্ববাদী উচ্চ জাতিগুলোকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুড় খেতে দেয়। এই মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তার পার্টি সেই নেহরু কে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয় যার প্রচ্ছন্ন মদতে ভারত ভাগ হয় আর লক্ষ লক্ষ মুসলমান কে পাঞ্জাব, বাংলা, জম্মু ও হায়দ্রাবাদে হত্যা করা হয়। সেই নেহরুর কাছে মুসলমান উন্নয়নের রাজনীতির মূলমন্ত্র ছিল গোঁড়া ও ধর্মান্ধ মৌলবাদী মৌলানা আজাদের মতন লোককে মুসলমান সমাজের নেতা বানানো, যে লোকটা মুসলমান মহিলাদের স্বাধীনতার ও স্বাবলম্বী হওয়ার ঘোরতর বিরোধী ছিল, যাতে মুসলমান সম্প্রদায় কোনো দিন আধুনিকতার আলো না দেখতে পায়। যে নেহরু সরকার আরএসএস এর মতন সংগঠন কে ভারতে বিস্তৃত হওয়ার বকলমে সুযোগ করে দিয়েছিল, মুখে বিরোধিতা করেও। এরা সেই ইন্দিরা গান্ধীর মূর্তিতে মালা দেয় যে ইন্দিরা গান্ধীর শাসন কালে জরুরী অবস্থা জারি হয় আর অসংখ্য মুসলমান মানুষকে সঞ্জয় গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার হত্যা করে দিল্লির তুর্কমেন গেট এলাকায়। এই তৃণমূল কংগ্রেস রাজীব গান্ধী কে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়, যে রাজীব গান্ধী নিজে হাতে বাবরি মসজিদের ভিতর রামলালা মন্দিরের তালা খুলে পুজো দিয়ে আরএসএস ও বিজেপি কে রাম মন্দির আন্দোলনের ঝড় তোলার কাজে সহযোগিতা করেছিল, যার পরিণাম হয় বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং মুসলমান নিধন যজ্ঞ। এই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মমতা বন্দোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে খাল কেটে কুমির ঢোকানোর মতনই ১১৯৮ সাল থেকে বিজেপি আর তার হিন্দুত্ববাদী সহযোগীদের রাজ্যে ঘাঁটি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল কেন্দ্রে বাজপেয়ী সরকারে মন্ত্রিত্বের বিনিময়ে।১৯৯৯ সালে যখন দারা সিংহ ও অন্য্ সব বজরং দল কর্মীরা মিশনারি গ্রাহাম স্টেইন কে তাঁর দুই নাবালক পুত্র সহ পুড়িয়ে হত্যা করেছিল বা ২০০২ সালে যখন নরেন্দ্র মোদী হাজার হাজার মুসলমানের শব দেহের উপর চলে গুজরাটের ভোটে বিজেপিকে জিতিয়েছিল তখন ধর্মনিরপেক্ষ ও মুসলমান - সংখ্যালঘু দরদী মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু বিজেপির সাথে মধুর সম্পর্ক বজায় রেখেছিল, ফুলের তোড়া দিয়ে নরেন্দ্র মোদী কে অভিনন্দন জানিয়েছিল মমতা সেই সময়ে যখন মোদীর কব্জি দিয়ে চুইয়ে পড়ছিল মুসলমানের রক্ত।           
  
মোদী আর মমতার ফুলের তোড়ার যুদ্ধের আড়ালে পুরানো বন্ধুত্ব পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন কে ধ্বংস করার কাজে বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজি ও জোতদার-সামন্তপ্রভুদের একান্ত প্রয়োজনীয়। দুই জনের রাজনীতিই ব্রাক্ষণত্ববাদ কে সমর্থন করে, দলিত-আদিবাসী ও মুসলমান সম্প্রদায় সহ সকল সংখ্যালঘুদের স্বার্থের বিরুদ্ধে শুধু মাত্র অভিজাত হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা করে। আজ যে বিজেপি নেতা ও কর্মীরা, যে আরএসএস কর্মীরা মমতা কে প্রকাশ্যে গালিগালাজ করছে, মুসলমান সম্প্রদায়ের দালাল বলছে, তলে তলে তারা সবাই মমতা ও তৃণমূলের প্রশ্রয়ে পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের জমি শক্ত করতে পারছে। মমতার পুলিশ আর প্রশাসন রাজ্য জুড়ে বেড়ে চলা হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদের চাঁইদের বকলমে তোষণ করছে আর তার সাথে সাথেই তোষণ করছে একদল চরম ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল মোল্লা শ্রেণীর মুসলমানদের, যারা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ও উর্দু ভাষী মুসলমান সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দেউড়িতে গন্ডিবদ্ধ করে তাদের দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক অভিলাষা চরিতার্থ করার চক্রান্ত সফল করার কাজ করছে।আর তৃণমূলের রাজনৈতিক লক্ষ্যবস্তু হলো ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা কে পিছনের দরজা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করানো, বিদেশী পুঁজির মালিকানাধীন কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সাহায্যে মোদী সরকারের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করা এবং দাঙ্গার পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে শ্রমিক-কৃষক-খেটে খাওয়া জনতা-দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সমাজ কখনোই এক হয়ে মাটি-জল-বাতাস লুঠের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে না পারে, যাতে শ্রমিক-কৃষকের লড়াই গড়ে উঠতে না পারে, আর পশ্চিমবঙ্গকেও গুজরাটের মতন হিন্দুত্ববাদীদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলা যায়। এই কারণেই আমরা দেখতে পাই তৃণমূলের নেতৃত্বে কালিয়াচক - ঢোলাহাট কান্ড থেকে তারক বিশ্বাস নামক ব্লগারের গ্রেফতারি, সবই খোরাক যোগাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী শক্তির পেশী শক্তি বাড়ানোর প্রক্রিয়ায়।     

ঢোলাহাট নিয়ে তুলকালাম - পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় দাঙ্গা করার পরিকল্পনা করছে আরএসএস - বিজেপি



দক্ষিণ ২৪ পরগণার  ঢোলাহাটের ঘটনাই ধরুন। গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর একজন গরু ব্যবসায়ী রউফ লস্কর (২৮) হাট থেকে বাড়ি ফেরার ঠিক পরেই তাঁর মোবাইল ফোনে একটা কল আসে যে সস্তায় অনেক গরু পাওয়া যাচ্ছে, ঈদের মরশুমে যে খবরটা শুনে যে কোনো গরু ব্যবসায়ীর চোখ লোভে চক চক করে উঠবে। সেই ফোনে কথা বলেই রউফ লস্কর বাড়ি ছেড়ে গেলেন আর ফিরলেন লাশ হয়ে, তাঁর মৃতদেহ ভেসে ওঠে লক্ষীনারায়নপুরের পুকুরে, ডান চোখ উপড়ানো, ঠোঁট আর কান দুটো কেউ খাবলে নিয়েছে। রউফ লস্করের মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল যে পুকুরে সেটা তাঁর বাড়ির থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ভাজনা গ্রামের কাছে। সেই ভাজনা গ্রামে বিগত কয়েক বছর ধরে তৃণমূলের প্রচ্ছন্ন মদতে ঘাঁটি গেড়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করছে আরএসএস ও তার বিভিন্ন সহায়ক সংগঠন। ভাজনা গ্রামের উঁচু জাতের ব্রাক্ষণত্ববাদী যুবদের নিয়ে যথারীতি গো-রক্ষা সমিতি গড়া হয়েছে এবং এই এলাকায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও তপন ঘোষের হিন্দু সংহতির মতন মার্কিন মদত প্রাপ্ত দাঙ্গাবাজ সংগঠন নিজেদের ষড়যন্ত্রমূলক কাজকর্ম শুরু করেছে। গ্রামবাসীরা পুলিশের কাছে গো-রক্ষক ও আরএসএস এর বিরুদ্ধে রউফ লস্কর কে খুন করার অভিযোগ করলেও পুলিশ সেই অভিযোগ নথিভুক্ত করতে চায়নি। জনগণ পুলিশের এহেন আচরণ দেখে ক্ষিপ্ত হন এবং তীব্র প্রতিবাদ করেন, অনেকে ইঁট পাটকেল ছুড়ে পুলিশ কে দেহ নেওয়ার থেকে আটকান। পরে পুলিশের বড় কর্তারা স্থানীয় জনগণ কে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের সাথে নিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর ঢোলাহাট থানায় দেখা করতে বলে এবং তাঁদের কথামত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেহ নিয়ে যায়। ১১ সেপ্টেম্বর দলে দলে মানুষ থানায় গিয়ে জানতে পারেন যে পুলিশের বড় কর্তারা কেউ নেই আর কোনো মিটিং হবে না। ফলে স্পষ্টতঃ এলাকার মুসলমান জনগণ দেখলেন যে বকলমে হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজদের পক্ষপাতিত্ব করছে “মুসলমান-দরদী” সাজা মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ব্রাক্ষণত্ববাদী প্রশাসন। ফলে জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়েন ও পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো শুরু করেন।  সরকারের বিরুদ্ধে জনমত যাচ্ছে দেখেই এলাকার তৃণমূলের মৌলবাদী নেতারা গুন্ডা বাহিনী এনে জনতার শান্তিপূর্ণ লড়াইকে বানচাল করতে শুরু করে বোমা বর্ষণ আর আগুন লাগানো, ঠিক কালিয়াচকের কায়দায়, আর এই সুযোগে পুলিশ সরাসরি জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া শুরু করে, ঈদের দুইদিন আগেই এই হট্টগোল থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষ  যখন পালাতে থাকেন ঠিক তখন পুলিশ গুলি করে সালেম লস্কর কে।তাঁর পিঠে গুলি লাগে, যে গুলি নাকি পুলিশ আত্মরক্ষার জন্যে চালিয়েছিল। গুলিতে সালেম লস্করের মৃত্যু হয় এবং পুলিশ কেস দিয়ে ৪৯ জন কে জেলে পোরার চেষ্টায় রত। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে প্রশাসন গো-রক্ষক দল সম্পর্কে একেবারে চুপ। শুধু প্রেস কনফারেন্স চলাকালীন মমতা সেই পুরানো কায়দায় “আমি বরদাস্ত করবো না” বলে গো-রক্ষকদের শাসানি দিলেও তা যে একেবারে কোনো কাজের নয় তা গো-রক্ষকদের চেয়ে বেশি মমতার জানা আছে।     


কাকদ্বীপের নিকটবর্তী এই সকল অঞ্চলে এক কালে বামপন্থী কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী থাকায় জোতদারদের এলাকায় পসার সাজিয়ে বসতে অসুবিধা ছিল। নিচু জাতির ও নমঃশূদ্র দলিত হিন্দু এবং মুসলমান কৃষকেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জমি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্যে লড়াই করেছিলেন। পরবর্তীকালে সিপিএমের রাজত্বকালে ধীরে ধীরে কৃষকদের জঙ্গী আন্দোলন কে পিছন থেকে ছুরি মেরে মেরে ধ্বংস করা হয় এবং ধর্মীয় মৌলবাদীদের এই এলাকায় খালি মাঠে গোল করার সুযোগ করে দেয় জ্যোতি বোস ও বুদ্ধ ভট্টাচার্যের সরকার। তৃণমূল শাসন কালে এই এলাকায় ধর্মীয় মৌলবাদ আরও গভীর ভাবে প্রবেশ করতে থাকে, ধর্মের নামে কাঠি মেরে নমঃশূদ্র দলিতদের ব্রাক্ষণত্ববাদী উঁচু জাতের হিন্দুদের পতাকাতলে এনে ধর্মীয় মেরুকরণের কাজ চালায় আরএসএস ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। বেশ কয়েক মাস ধরে, বিশেষ করে বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই ঢোলাহাট অঞ্চলে গরু কে কেন্দ্র করে চক্রান্তের ফাঁদ পাতে হিন্দুত্ববাদী শক্তি। যদিও কুলপি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটে জেতে তৃণমূলের যোগরঞ্জন হালদার, কিন্তু বিজেপি এই কেন্দ্রে যে দাঁত কাটতে শুরু করেছে বিগত পাঁচ বছরে তা নির্বাচনের পরিণাম দেখে বোঝা যায়। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী এই কুলপি কেন্দ্রে ৩৬২৪টি ভোট পেয়েছিল আর ঠিক মমতার শাসনের পাঁচ বছর পরেই সংখ্যাটা হয়ে দাঁড়ালো ৮৪৩৪! ২০১৪ সালের “মোদী হাওয়ায়” সমগ্র মথুরাপুরের দলিতদের জন্যে সংরক্ষিত আসনেও বিজেপি তিন নম্বরে উঠতে সক্ষম হয়েছিল, আর তার পর থেকেই এই সমগ্র এলাকায় মুসলমান বিরোধী বিদ্বেষ বেশি বেশি করে ছড়ানো হয় তৃণমূলের সহায়তায়। কখনো গরুর অছিলায় আর কখনো হিন্দু মেয়ে কে মুসলমান ছেলে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই অছিলায় এই এলাকা সহ সমগ্র দক্ষিণ ২৪ পরগণায় দাঙ্গা করার চেষ্টা করে আরএসএস ও তাদের সহযোগী হিন্দু সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি।


তৃণমূল কংগ্রেস যে ভাবে এই গ্রামবাসীদের ন্যায়সঙ্গত লড়াইকে ভেস্তে দিতে যথেচ্ছ গুলি ও বোমা ব্যবহার করে দোষ মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দিতে পারলো তা কিন্তু বিজেপি বা আরএসএস’র দ্বারাও সম্ভব হতো না, আর এভাবেই তো হিন্দুত্ববাদী শক্তির রক্ষায় এগিয়ে এসেছে মোদীর দোসর মমতা আর তার তৃণমূল কংগ্রেস।ঢোলাহাটের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে তেমন প্রভাব ফেলতে না পারলেও সমগ্র ভারতের কর্পোরেট মিডিয়া ঘটনাটিকে মুসলমান মৌলবাদীদের তাণ্ডব বলে চিত্রিত করে হিন্দুত্ববাদীদের পয়েন্ট বাড়াতে সাহায্য করেছে আর আতংকিত করেছে সমস্ত মথুরাপুর সংসদীয় এলাকার নমঃশূদ্র দলিত সম্প্রদায় কে, যার ফলে আরএসএস ও তপন ঘোষের হিন্দু সংহতির সুবিধা হয়ে গেল এই এলাকার দলিত নমঃশূদ্রদের মুসলমানদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার থেকে আটকে ব্রাক্ষণত্ববাদের পতাকাতলে সামিল করতে। এই ঘটনার রেশ মিটতে না মিটতেই আবার তৃণমূল এগিয়ে এলো হিন্দুত্ববাদী শক্তির সমর্থনে। এবার আবার সরাসরি তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের এক জেলা স্তরের নেতা সানাউল্লাহ খান সরকারি ভাবেই বিদ্বেষ সৃষ্টির খোরাক যোগান দিল।
    

নাস্তিক ব্লগার তারক বিশ্বাসের গ্রেফতারে নতুন অস্ত্র খুঁজে পেল হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী শক্তি



কালিয়াচকের দাঙ্গার আসল কারণ এবং ঘটনাবলী আমরা আগেও পড়েছি, সম্প্রতি মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতির নামে তৃণমূল কংগ্রেস আবার বাক স্বাধীনতায় হামলা করলো কেন্দ্রীয় মোদী সরকার বা পড়শি পাকিস্তান-বাংলাদেশ সরকারের মতন। তারক বিশ্বাস নামে এক ব্লগার ইন্টারনেটে বহুদিন ধরে নানা ধর্মের সমালোচনা করে আসছিলেন জঙ্গী নয়া-নাস্তিক আন্দোলনের কায়দায়। যে আন্দোলন ধর্মের সাথে সমাজের আর্থিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রগতির স্তরের সম্পর্ক কে বাদ দিয়ে, উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্ক কে বাদ দিয়ে, শুধু ধর্মকে সমালোচনা করে, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম কে, সেই আন্দোলনের এক অংশগ্রহণকারী হলেন তারক বিশ্বাস। এই তারক বিশ্বাসের লেখায় হঠাৎ তৃণমূলের নেতা সানাউল্লাহ খানের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুভূতিতে এমন আঘাত লাগলো যে সে পুলিশে মামলা করলো আর তৃণমূলের নেতার মামলার চোটে হঠাৎ কল্যাণী থেকে না বলে কয়ে জোর করে পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে যায় তারক বিশ্বাস কে এবং ভারতীয় দন্ডবিধির ২৯৫ এ ও ২৯৮ ধারা সহ তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৬৬, ৬৭, ও ৬৭ এ’র মতন সব ভয়ঙ্কর ধারার মামলা পুলিশ এই ব্লগারের নামে করেছে। এর পিছনে তৃণমূলের ভূমিকাটা স্পষ্ট আর এই ঘটনা কে কেন্দ্র করে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের খেলায় একেবারে ফাউতে পেনাল্টি শট পেয়ে গেল সংঘ পরিবার। অন্তত ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তো বটেই। যে সানাউল্লাহ খান তারক বিশ্বাসের নামে পুলিশে অভিযোগ করেছিল সে নিজে ফেসবুকে নিজেকে ধর্ম প্রচারক তৃণমূল নেতা হিসেবে প্রতিপন্ন করে থাকে। সে তার তৃণমূলী প্রতিপত্তি ব্যবহার করে তারক বিশ্বাস কে গ্রেফতার করিয়েছে কারণ পিছনে ছিল মমতা আর শুভেন্দু অধিকারীদের মতন মন্ত্রীদের সমর্থন। এই গ্রেফতারির ফলে একদিকে হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীদের কাছে ইসলাম ধর্মালম্বীদের কে বাঁধাধরা “মৌলবাদী” ও “ধর্মান্ধ” গোত্রে ফেলে চরম বিদ্বেষমূলক প্রচার আরও সহজ হয়ে গেল। ইন্টারনেট জুড়ে আরএসএস এর ভাড়াটে বাহিনী একজন নাস্তিক আন্দোলনে জড়িতের নাম কে “অত্যাচারিত হিন্দু” ও “মমতার মুসলমান তোষণের” সাথে জুড়ে নিজেদের রাজনৈতিক প্রচার কে তুঙ্গে তুলে দিল। এর ফলে চাপা থেকে গেল যে কি ভাবে রাজ্যের গ্রামে গ্রামে হিন্দুত্ববাদী জঙ্গীরা গরু রক্ষা আন্দোলনের নামে বিষিয়ে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক আবহাওয়াকে। শুধু চারদিকে মুসলমান সম্প্রদায় মুক্ত আলোচনা ও বাক স্বাধীনতার শত্রু এই বলে সমগ্র সম্প্রদায় কে আক্রমণ করার এক ভালো সুযোগ পেয়ে গেল হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি, আর এদের সমর্থনে আলতো আলতো করে পা ফেলে এগোতে থাকলো সানাউল্লাহ খানের মতন “মুমিনেরা”। এপিডিআর এর মতন সামাজিক সংগঠন যদিও তারক বিশ্বাসের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে এবং পুলিশি হস্তক্ষেপের নিন্দা করেছে তবুও ভোটপন্থী বামেদের এখনো এই দাবি সরাসরি তুলতে দেখা যায়নি।  


পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র প্রগতিশীল মানুষকে এই সমস্ত চক্রান্ত কে আজ খুঁটিয়ে দেখতে হবে এবং বস্তুগত বিশ্লেষণ করতে হবে। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে যে ভাবে ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তি কায়দা করে মুসলমান সম্প্রদায় কে শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ভাবে পিছিয়ে রেখেছে তার ফলে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেও তথাকথিত বামপন্থীদের ৩৪ বছরের শাসনের পরেও এই রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের চেতনার মান অনেক নিম্নে। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা সহ সকল ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার মুসলমান সমাজের পক্ষে বর্তমান শাসন ব্যবস্থা ও শাসক শ্রেণীর অধীনে নিজ সম্প্রদায়ের উন্নয়ন আশা করাও হাস্যকর হবে। এহেন পিছিয়ে থাকা মুসলমান সম্প্রদায় কে, দলিত ও আদিবাসীদের সাথে নিয়ে ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে জমি-জল-জঙ্গল ও আর্থিক-রাজনৈতিক-সামাজিক স্বাধীনতার দাবিতে গড়ে ওঠা লড়াইয়ে সামিল করাতে হবে এবং তার জন্যে সমস্ত শোষিত জাতি ও সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক চেতনা কে আজ জাগ্রত করার ভীষণ দরকার, কারণ এই চেতনা জাগ্রত না হলে, উচ্চ স্তরে না উঠলে জঙ্গী হিন্দুত্ববাদের পতাকাবাহী ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তি কে পরাস্ত করা যাবে না, এমন কি ব্রাক্ষণত্ববাদের বিরুদ্ধে, হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেও সানাউল্লাহ আর মমতার মিমিঃকিরির ফলে নেপোয় মারে দই হয়ে যাবে।


সাধু সাবধান ! পর্বতে ধোঁয়া দেখা দিয়েছে, আর দেশলাই হাতে মমতা-দিলীপ-তপন ঘোষেদের ঘুরতে দেখা গেছে।  


   

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে